আজ আল্লামা শাহ্ মুহাম্মদ আনছারুল হক্ব নঈমী নক্বশবন্দী (রহ.)’র পবিত্র ওরশ
লেখক : শাহজাদা মুহাম্মদ শফিউল বশর নঈমী
ওস্তাযুল ওলামা, হাযত রাওয়া, রাহনুমায়ে শরীয়ত ওয়া পীরে তরিক্বত, মুক্বতাদায়ে আঁলিমা, সুলত্বানুল ওয়া’ ইযীন, মুহাদ্দিসে যামান হযরত শায়খ আল্লামা শাহ্ মুহাম্মদ আনছারুল হক্ব নঈমী নক্বশবন্দী (রহ.)।
সূচনা
বাংলাদেশে ইলমে দ্বীনের প্রচাারক এবং তরিক্বতের দাওয়াতী মিশনের মাধ্যমে যারা মানুষদের কে হুব্বে মোস্তফা(দ.) এর শিক্ষা দিয়েছেন,যাদের অক্লান্ত সাধনা ও বিরামহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে, বাতিলের বহুমুখী ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের সুবিস্তৃত জাল ছিন্ন করে সুন্নীয়তের অঙ্গনকে যারা আবাদ রেখেছেন, যে সকল নবী প্রেমিক মনীষীদের ক্ষুরধার লেখনী, মর্মস্পর্শী বাগ্মিতা ও আকর্ষনীয় পাঠদানে ইসলামের মূলধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা-আদর্শ, আমল-আখলাক,সমগ্র বাংলায় বিস্তৃত ও প্রতিষ্ঠিত, শানে রেসালত আর শানে বেলায়ত এর চিরশত্রু নবীদ্রোহী ও অলী বিদ্বেষীদের সকল স্বপ্ন-সাধনা ধুলিস্যাৎ করে দিল যাদের অপরিসীম দ্বীনী অবদান, যাদের তেজস্বী বক্তৃতার মাধ্যমে সিরাতুল মোস্তাকিম এর দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য যেমন মানুষকে অনুপ্রেরুা যোগাত এবং হক্বপন্থী মুসলমানদের অবস্থান কে আরো দৃঢ় করতো তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন মুহাদ্দিসে যামান, রাহনুমায়ে শরীয়ত ওয়া পীরে তরিক্বত, খলিফায়ে নায়বে সদরুল আফাযিল, উস্তাজুল ওলামা, মুনাযেরে যাঁমা, হযরত শায়খ শাহ মুহাম্মদ আনছারুল হক্ব নঈমী নক্বশবন্দী আশরাফী(রহ.)।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
১০ই মাঘ রোজ সোমবার ১৪৬৬ বাংলা মোতাবেক ১৩৮০ হিজরী মোতাবেক ১৯৬০ ইংরেজীত, বাঁশখালী থানার বাহারছড়া নামক গ্রামে এ মহান ক্ষনজন্মা মনিষী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিলো আলী আহমদ মুন্সী(রহ.)। তৎকালীন সময়ের মহান আধ্যাত্মিক সাধক এবং সাহেবে বিলায়ত হযরত গুল মুহাম্মদ ফকির(রহ.) ছিলেন হযরতের প্র-পিতামহ। একটি তাসাউফপন্থী এবং সূফীমতাদর্শে বিশ্বাসী সম্রান্ত বংশের ভবিষ্যৎ যোগ প্রতিনিধির আগমনে পিতা এবং মাতার মুখে রাব্বুল ইজ্জতের শোকরিয়া প্রকাশ পেয়েছিল। তারা মহা আয়োজনে ছেলের আক্বিকা সম্পন্ন করে নাম দিয়েছিলেন মুহাম্মদ আনছারুল হক্ব(রহ).।
হযরতের পিতাও ইসলামি চেতনাদর্শের সূফীধারনার জীবন যাপনে অভ্যস্ত ব্যক্তি ছিলেন; মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ে অভ্যস্ত ছিলেন। বিখ্যাত সূফীসাধক হাযত রাওয়া মাওলানা হযরত ইরশাদ আলী(রহ.) ছিলেন হযরতের মায়ের নানাজান। সে হিসেবে মাতৃকুলের দিক থেকেও তিনি সম্রান্ত পরিবারের উত্তরসূরী।তার মাতা ছিলেন মহীয়সী একজন আবেদা এবং পরহেজগার গুনবতী মহিলা। তাঁর সম্মানিত মায়ের নাম ছিলো মরহুমা এখলাছ খাতুন(রহ.)।
শিক্ষা জীবন
হযরত নঈমী সাহেব কিবলা(রহ.) কে তাঁর পিতা বিসমিল্লাহ শরীফ শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে ইলমের হাতেখড়ি করান। এবং পারিবারিক পরিবেশে প্রাথমিক দ্বীনি ইলম, মাসয়ালা ও কুরআন মাজীদ এর তালীম দান করেন। এরপর তিনি বাহারছড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে কৃতিত্বের সাথে পঞ্চম শ্রেণী পাস করেন। সেখান থেকে বাহারছড়া মাদ্রাসায় তিন বৎসর কৃতিত্বের সাথে পড়ালেখা শেষ করে তিনি বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে চাঁদপুর কাদেরীয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাস করেন। রাঙ্গুনিয়া নুরুল উলুম সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাশ করেন। এবং তৎকালীন শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম ওয়াজেদিয়া আলীয়া মাদ্রাসা থেকে কামিল (এম,এম) পাশ করে দস্তারে ফজিলত লাভ করেন।
এছাড়াও তিনি হাটাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় কিছুকাল পড়াশোনা করেন।
রাঙ্গুনিয়া নুরুল উলুম মাদরাসায় পড়ালকালীন সময়ে নায়েবে সদরুল আফাযিল হযরত শায়খ সৈয়্যদ নুরুচ্ছফা নঈমী নক্বশবন্দী আশরাফী(রহ.) প্রকাশ বড় হুজুরের সহচর্যে থেকে কুরআন এর তাফসির, দরসে হাদিস, মানতিক, ফিকাহ, আকাইদ, বালাগাত, হেকমত, তাসাউফ, ফরায়েয শাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে বুৎপত্তি জ্ঞান অর্জন করেন।
কর্মজীবন
হযরত মাওলানা শাহ মুহাম্মদ আনছারুল হক্ব নঈমী(রহ.) যে সময়কাল হতে নায়েবে সদরুল আফাযিল কিবলা(রহ.) এর সহচর্যে ছিলেন, তখন থেকেই বড় হুজুর কিবলা তাকে সবকিছুর দিকনির্দেশনা প্রদাান করতেন। বড় হুজুর কিবলা(রহ.) এর নির্দেশে তিনি রাঙ্গুনিয়ানুরুল উলুম কামিল মাদরাসায় দ্বীনি তালীম প্রদান শুরু করেন। এবং একই সাথে চন্দ্রঘোনা লিচু বাগান বাস স্টেশন জামে মসজিদে ইমামমতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে সময়ে বড় হুজুর কিবলা(রহ.) এর নির্দেশে বিভিন্ন এলাকায় ওয়াজ নসীহতের মাধ্যমে বহু পথাহারা মানুষকে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ দেখিয়েছেন। তাঁর জ্ঞানগর্ভ কোরআন- হাদীস ভিত্তিক যুক্তির কারণে তিনি সকলের কাছে সম্মানের পাত্র হিসেবে সমাদৃত লাভ করেন। ভিন্ন মতের লোকেরাও হযরতের জ্ঞানগরীমা এবং তাক্বওয়ার কারনে তাঁকে সম্মান করতেন।
রাঙ্গুনিয়া নুরুল উলুম মাদরাসায় সুনামের সাথে ১৮বৎসর শিক্ষকতা শেষ করে তিনি নানুপুর মাজহারুল উলুম সিনিয়র মাদরাসায় প্রায় আড়াই বৎসর প্রভাষক হিসেবে থেকে শিক্ষকতা পালন করেন। এবং একই সাথে হাটহাজারীর সরকার হাটস্থ তরিকত খান জামে মসজিদে খেতাবতের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রামস্থ আশেকানে আউলিয়া কামিল মাদরাসার মুহাদ্দিস হিসেবে নিযুক্ত হন, এবং সেখান সুদীর্ঘকাল দরসে হাদিস এর তালিম দেন। একই সাথে চট্টগ্রাম মহানগরের ঐতিহাসিক চর চাক্তাই আব্দুল কাদের জিলানী জামে মসজিদে সুনামের সাথে খেতাবতের দায়িত্ব পালন করেন।
খিলাফত লাভ
রাঙ্গুনিয়ার বিখ্যাত দরবার রাহাতিয়া নক্বশবন্দিয়া দরবার শরীফের মহান রাহ্বার, নায়েবে সদরুল আফাযিল, সনদুল মুহাদ্দেসিন,পীরে কামিল, শায়খে যামান, মুরশিদে বরহক্ব হযরত শাহ্ সৈয়্যদ মুহাম্মদ নুরুচ্ছফা নঈমী নক্বশবন্দী আশরাফি (রহ.) এর পবিত্র নূরানী হাতে তরিক্বতের বায়াত গ্রহণ করেন। মহান মুর্শিদ বড় হুযুর কিবলা (রহ.) এর তত্বাবধানে তিনি ইলমে হাদিস, ইলমে তাফসিরের বিশেষ জ্ঞান আহরণ করেন। মহান মুর্শিদ (রহ.) কর্তৃক বিভিন্ন রিয়াযত এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে হযরতের নেগাহ্ েকরম অর্জন করেন। এবং বড় হুযুর কিবলা হযরত সৈয়্যদ নুরুচ্ছফা নঈমী (রহ.) হতে তরিক্বতে নক্বশবন্দিয়া আলীয়া এর খিলাফত এবং হাদিসের সনদ, দালায়িলুল খয়রাত এর সনদ সহ ইযাযত লাভ করেন। মহান মুর্শিদ কিবলা বড় হযুর (রহ.) এর সাথে হযরতের রূহানী সম্পর্কের গাঢ়তা-ই প্রমান করে, তিনি মুর্শিদের দরবারের মকবুল হয়েছিলেন।
দ্বীনি এদারা প্রতিষ্ঠা
দ্বীনি ইলমের প্রচারে আজীবন খেদমত করার পাশাপাশি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদার প্রচাার প্রসার এবং দ্বীনি ইলমের চর্চা যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝেও বহমান থাকে সে লক্ষ্যে হযরত নিজ গ্রামে দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর হাতেগড়া প্রতিষ্ঠানগুলো হল –
১. বাঁশখালী বাহারছড়া গাউছিযা সুন্নীয়া মাদ্রাসা।বাহারছড়া, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম। (স্থাপনের তারিখ ১৯৯৭সালের ২রা ডিসেম্বর)
২. গাউসিয়া সুন্নীয়া হিফযখানা। বাহারছড়া, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম
৩. গাউসিয়া সুন্নীয়া জামে মসজিদ। স্থাপনের তারিখ ২০১৩ সালের ২৭ রমজান।
এছাড়াও তিনি হাটহাজারী মির্জাপুরস্থ মির্জাপুর বাকেরীয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূৃমিকা পালন করেন।
খিদমতে খলায়েক্ব
হযরত নঈমী সাহেব কিবলা(রহ.) বহু প্রতিবাধর গুনবান ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে তালীম প্রদান করে বহু নায়েবে রাসূল তৈরী করেছেন, যারা আজ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে সুনামের সাথে কর্মরত আছেন। আর অপর দিকে মসজিদের মিম্বরে এবং ওয়াজ-ময়দানের মঞ্চ হতে সাধারু মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছেন দ্বীনের সুমহান বার্তা। একদিকে নায়েবে রাসূল প্রতিষ্ঠার মিশন এবং অপরদিকে সাধারন মানুষের প্রতি দ্বীনি দাওয়াত পৌছানোর মিশনের সাথে সাথে বহু হাজতী মানুষের নানাবিধ সমস্যার সমাধান যেমন করেছেন, একই সাথে মানুষের তাজকিয়ায়ে নাফস তথা কলব পরিশুদ্ধতার মিশনেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
তাঁর জীবদ্দশায় বহু মানুষ তার সোহবত গ্রহন করে তাঁদের প্রয়োজনীয় মকসদ হাসিল করতেন। দেশ এবং বিদেশের বহুলোক হযরত নঈমী সাহেব কিবলা (রহ.) এর দোয়ার মাধ্যমে জাগতিক সমস্যার সমাধান যেমন পেয়েছেন একই সাথে তাদের ক্বলবের পরিশুদ্ধতার তালিমও গ্রহন করেছন। উল্লেখ্য যে, উনার কাছে ওলামায়ে কেরামগণও তাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান গ্রহণ করতেন। একদিকে দ্বীনী ইলমের প্রচারক, একই সাথে তরিক্বতের একজন রাহবার হিসেবে তিনি অপরিসীম খিদমত আনজাম দিয়েছেন।।
খিলাফত প্রদান
এ মহান রাহবার তাঁর জীবদ্দশায় বহু মানুষকে কলব পরিশুদ্ধতার পথ দেখিয়েছেন। বলা বাহুল্য যে, তিনি তাঁর ইন্তেকালের এক সপ্তাহ পূর্বে তাঁর মেঝ সাহিবজাদা হযরত মাওলানা শায়খ শফিউল বশর নঈমী এবং হাজীপাড়া বড় মাওলানা নক্বশবন্দীয়া দরবার শরীফের শাহজাদা মাওলানা সৈয়্যদ মোহাম্মদ মুহিব উল্লাহ নক্বশবন্দীকে তরিক্বায়ে আলীয়া নক্বশবন্দীয়ার খিলাফত এবং ইজাজত প্রদান করেন। উল্লেখ্য যে, তাঁর নিকট হতে বহু আলেম দরসে হাদিস এবং দালায়েলে খায়রাতের ইযাযত গ্রহণ করেন।
আওলাদগণ
হযরত আল্লামা আনছারুল হক নঈমী রহ. এর ঔরসে চার পুত্রসন্তান যথাক্রমে শাহজাদা মাওলানা খায়রুল বশর, শাহজাদা মাওলানা শায়খ শফিউল বশর, শাহজাদা আলী হায়দার বিন আনছার, শাহজাদা আলী কাইছার এবং এক কন্যা শাহজাদী হাফসা বিনতে আনছার জন্মগ্রহণ করেন।
ইন্তেকাল
তিনি ২০১৯ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী, ১৭ই জামাদিউস সানী ১৪৪০ হিজরী, ১০ ফাল্গুন ১৪২৫ বঙ্গাব্দ মোতাবেক রোজ জুমাবার দিবাগত রাতে ইন্তেকাল করেন। পরদিন আসরের নামাজের পর তাঁর মেজ শাহজাদা শায়খ মাওলানা মুহাম্মদ শফিউল বশর নঈমী (মা. জি.আ.) এর ইমামতিতে নামাজে জানাযা শেষে মাদরাসা সংলগ্ন নির্দেশিত স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।