আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ রাহাতুল্লাহ্ নকশবন্দী মুতাওয়াক্কালী (রহঃ)’র সংক্ষিপ্ত জীবনী

প্রতিবেদন, নিজস্ব প্রতিনিধি

শায়খুল মাশায়িখ রাহনুমায়ে শরীয়ত ওয়া ত্বরীকত মুজাদ্দিদে দ্বীনে মিল্লত পেশােয়ায়ে আহলে সুন্নাত ওয়াকেফে আছরারে শরীয়াত মুশকিল কুশা হাজত রাওয়া মাখদুমে আলম হযরতুল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ রাহাতুল্লাহ্ নকশবন্দী মুতাওয়াক্কালী (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।

বংশ পরিচয় ও জন্ম

নাম মুহাম্মদ রাহাতুল্লাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। তাঁর পূর্ব পুরুষের আদি নিবাস ছিল আরবে। তাঁর প্রপিতামহ হযরত সৈয়দ আহমদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ইসলাম প্রচারের আকাঙ্খা নিয়ে ভারত উপমহাদেশে এসেছিলেন। তখন ভারত বর্ষের মসনদ অলংকৃত করছিলেন শাহ্ আলম বাহাদুর শাহ্। যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী সৈয়দ আহমদ যুদ্ধের কলাকৌশল শিক্ষাদানে অভিজ্ঞ ছিলেন। তাই তিনি প্রথমে বাহাদুর শাহের সেনা বিভাগে কাজ নেন। হঠাৎ ইংরেজদের হাতে ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের পতন এবং খৃষ্টান শাসনের প্রবর্তন হলে হযরত সৈয়দ আহমদ সুদুর চীনে হিজরত করেন। পরে ইসলাম প্রচারের তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে তিনি চট্টগ্রামে আসেন। তারপর জীবিকা নির্বাহের নিমিত্তে শহরের কেন্দ্রস্থল চকবাজারে একটি দোকান খুলে বসেন। একদা বাজারে আগুন লেগে তাঁর দোকানটি সহ সকল দোকান ভস্মিভূত হয়ে যায়। তখন তাঁর একছেলে হযরত আজগর আলী চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ত্রিশ কিলােমিটার উত্তর পূর্বে রাঙ্গুনীয়া থানার মরিয়ম নগরে এসে বসতি স্থাপন করেন। কর্ণফুলীর তীর ঘেষে পাহাড়ের কোলে প্রকৃতির লীলা ভূমি এ গ্রামেই হযরত আজগর আলীর ঘরে জন্মগ্রহণ করে ভাগ্যবান হযরত রজব আলীর ঘরে যুগ শ্রেষ্ঠ অলিয়ে কামিল, মুশকিল কুশা, হযরত শাহ্ সৈয়দ রাহাতুল্লাহ নকশবন্দী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ১৩০০ হিজরী সনে ১লা ভাদ্র ১২৩৯ বাংলা বৃহস্পতিবার শেষ রাতে জন্ম গ্রহণ করেন।

বাল্যকাল ও কর্মজীবন

বাল্যকাল থেকেই তাঁর চাল চলন উঠা-বসা খাওয়া অন্যান্য শিশুর তুলনায় ভিন্ন ছিল। মায়ের স্নেহ পিতার আদরে ক্রমান্বয়ে বড় হয়ে উঠেন তিনি কুরআন ও সুন্নাহ তথা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ছিল তার অকৃত্রিম অনুরাগ ও ভালবাসা। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ধর্মীয় জ্ঞানে যেমন তিনি পারদর্শী হয়ে উঠেন, তেমনি তাঁর খােদা ভক্তি ও রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রমও বৃদ্ধি পায় ক্রমান্বয়ে।তাঁর জীবনী বর্ণনা করতে গিয়ে মাওলানা আব্দুল মজীদ আল মক্কী আছলকী রাহমাতল্লাহি আলাইহি বলেন, আমি জীবনে সৈয়্যদ রাহাতুল্লাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর চেয়ে বেশী সুন্নাতের অনুসরণ করতে কাউকে দেখিনি।অযু সমাপ্তির পরই দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করতেন। এমনকি সারা বছর ধরে রােজা পালন করতেন। তিনি মিষ্টভাষী ছিলেন। কবরের মত ছােট্ট একটি কুঠিরে রাত যাপন করতেন। যার দৈর্ঘ্য ছিল সাড়ে ৩ গজ এবং প্রস্থ ছিল ১.৫ (দেড়) গজ। তিনি প্রায় সারা রাতই নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত ও তাসবীহ পাঠের মাধ্যমে রাত কাটাতেন যদিও স্বল্প সময়ের জন্য শুয়ে পড়তেন, তাও বালিশ ব্যতিত নাকের একটি ছিদ্র রুঈ দ্বারা আটকে দিতেন। যার ফলে উম্মুক্ত ছিদ্রটি দিয়ে শ্বাস নেয়ার সময় ‘আল্লাহ’ নিশ্বাস ত্যাগের সময় ‘হু’ শব্দ ধ্বণিত হতাে। বর্ণিত আছে যে, তিনি তাঁর জীবদ্দশায় কুরআন দশ হাজার বার শরীফ খতম করেছেন।

খিলাফত লাভ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা

প্রখ্যাত অলীয়ে কামিল হযরতুল আল্লামা আব্দুল হক মুহাজিরে মক্কী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর কাছে তিনি বায়াত গ্রহণ করেন এবং তার কাছে থেকে খিলাফতও লাভ করেন। হুজুর নিজের একটি জুব্বা ও একটি লাঠি তাকে উপহার দেন। আর তাকে সুদূর মক্কা হতে স্বদেশ (রাঙ্গুনীয়ায়) এসে দ্বীনে ইসলামের খিদমতে নিজেকে নিয়ােজিত রাখার নির্দেশ প্রদান করেন। নির্দেশিত হয়ে তিনি মক্কা শরীফ হতে রাঙ্গুনীয়া প্রত্যাবর্তন করে পূর্ব সৈয়্যদ বাড়ীতে দিঘীর পাড় সংলগ্ন একটি গাছের নীচে বসে নিয়মিত কুরআন ও হাদীছ পাকের তালীমসহ দ্বীনি শিক্ষাদান শুরু করেন।পরে পর্যায়ক্রমে যখন শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন “তাওয়াকুলীয়া মাদ্রাসা” নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এবং বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদানে আত্মনিয়ােগ করেন। তাঁর অমূল্য শিক্ষালাভ করে অসংখ্য আলেম তৈরি হয়ে পথভ্রষ্ট মানব জাতিকে সঠিক পথের সন্ধান প্রদান করতঃ ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি লাভে ধন্য করেন।

চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য

তিনি মহৎ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। শরীয়ত পরিপন্থী যাবতীয় কর্মকান্ড তিনি কঠোর হস্তে দমন করতেন।ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রতি উদাসীনতা এবং পরকালীন চিরস্থায়ী শান্তিময় জীবন লাভের আগ্রহ ছিল তার সরল হৃদয়ে প্রবল, তিনি সাধারণ লােকের ন্যায় জীবন যাপন করতেন। আর পরিধেয় পােষাক পরিচ্ছদের পবিত্রতা রক্ষার ব্যাপারে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতেন। তিনি ফরজ কার্যাদি আদায়ের সাথে সাথেই নফল ইবাদতে নিমগ্ন হয়ে যেতেন।যেমন- ছালাতুদ্দোহা, ছালাতুল আউয়াবীন সহ নানা ধরণের নফল নামাজ আদায় করতেন। যে দিন তিনি উন্নত মানের খাবার গ্রহণ করতেন সেদিন অন্য দিনের তুলনায় বেশী ইবাদত করতেন যাতে আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় হয়। একদা তিনি মারাত্মক রােগে আক্রান্ত হয়ে বিছানা হতে উঠতে বসতেও অক্ষম হয়ে পড়েন। অথচ আযানের ধ্বনি শ্রবণ মাত্রই ঈমানী শক্তিতে ‘আলাহু আকবর’ বলে দাড়িয়ে যেতেন এবং যথাসময়ে নামাজ আদায় করতেন। কি বিরল দৃষ্টান্ত! এতে তার খােদাভীতির মহা প্রমাণ মিলে তাঁর চেহারা মুবারকে সর্বদা নূরের আলাে উদ্ভাসিত হত। যে কোন অহংকারী তার দর্শন লাভ মাত্রই নেহায়ত বিনয়ী হয়ে যেত।

মাশায়িখ কিরামের মতামত

শায়খুল হাদীছ ওয়াল ফিক্বহ ওয়াত্ তাফসীর আল্লামা সৈয়দ নূরুচ্ছাফা নঈমী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (বড় ছাহেবজাদা) বিরচিত “নূরুল মুগীছ নামক অমূল্য গ্রন্থের ৪৫ পৃষ্ঠায় উলেখ রয়েছে আল্লামা সৈয়দ আব্দুল হামীদ বাগদাদী রাহমাতল্লাহি আলাইহি (যিনি আল্লামা গাজী আজীজুল হক শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর পীর ছিলেন)। তাঁকে (আল্লামা রাহাতুল্লাহ নকশবন্দী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি অপূর্ব জ্ঞানের সাগর বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লামা আব্দুল হামীদ ফখরে বাঙ্গাল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (যিনি তার ভগ্নিপতি ছিলেন) তাকে ‘জ্ঞানের খনি’ বলে উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ ও সূক্ষ্ম মাসায়ালা উদঘাটনের অভিজ্ঞতায় তাঁকে সমসাময়িক শ্রেষ্ঠতম আল্লামা ছৈয়দ মুফতী আমীনুল হক ফরহাদাবাদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাকে প্রিয় নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একজন একনিষ্ঠ প্রেমিক ও অনুসারী এবং প্রকৃত সূফীর প্রতীক বলে আখ্যায়িত করেছেন। ভারত উপমহাদেশের যুগশ্রেষ্ঠ অলিয়ে কামিল আল্লামা সৈয়্যদ নঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর শিক্ষারগুরু আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ গুল কাহেলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি মেধা ও সদাচারণের জন্যে তাঁকে অতি ভালবাসতেন। গাজীয়ে দ্বীনােমিল্লাত আল্লামা আজিজুল হক শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর রচিত দিওয়ানে আজিজে তাঁকে ‘মুজাদ্দিদে ফিল আছর’ বলে আখ্যায়িত করেন।

ইন্তিকাল পরবর্তী অলৌকিক ঘটনা:

ইনতিকালের পূর্ব মুহুর্তে তাঁর মুরশিদ আল্লামা আব্দুল হক মুহাজিরে মক্কী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি হতে তুহফা হিসেবে অর্জিত জুববা ও লাঠি মুবারক তাঁর সাথে কবরে দাফন করার জন্য তিনি অসিয়ত করে যান। ঠিক সেইরূপ করা হয়েছিল। তিনি আরাে অসিয়ত করেন, “আমার জানাযার নামাজের পূর্ব মুহুর্তে একজন সম্মানিত লােক আগমন করবেন। তার অনুমতির পর তােমরা নামাজ পড়াবে। সত্যিই ভবিষ্যদ্বাণী মতে জানাযার ঠিক পূর্ব মূহুর্তে পশ্চিম দিক হতে ধবধবে সাদা জুব্বা মাথায় পাগড়ী পরিহিত একজন বুজুর্গ হঠাৎ তশরীফ এনে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিস কে? জিজ্ঞেস করলে, বড় হুজুর কিবলাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (হুজুরের বড় ছাহেবজাদা) উপস্থিত হন। তারপর তিনি বড় ছাহেবজাদাকে নামাযের জন্য অপেক্ষমান অগনিত লােকের সম্মুখে পাগড়ী পড়িয়ে দেন এবং নামাজের ইমামতী করার অনুমতি দেন। নামাজ আদায় করার পরে লােকটির পরিচয় সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর ছিদ্দিক রাদ্বিয়ালাহু তায়ালা আনহু এর বংশধর বলে জানান। তিনি আরাে বলেন, রাত্রে আমি স্বপ্নে দেখলাম ঠিক এ জায়গায় একজন মাকবুল অলীয়ে কামিলের ইনতিকাল হয়েছে এবং সায়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র রওজা মুবারক হতে আমাকে তাঁর জানাযায় শরীক হওয়ার জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং তাঁর ইনতিকালের চার বছর নয় মাস পর একরাতে তাঁর একজন খাদেম মরিয়ম নগর নিবাসী মাওলানা রুহুল কুদ্দুস রাহমাতুল্লাহি আলাইহি কে স্বপ্নে দেখানাে হল যে, তাঁর কবরের তাবুর এক কোণে উই পােকা ধরেছে। এভাবে কয়েক রাত দেখানাের পর তিনি বড় হুজুর ক্বিবলাকে (হুজুরের বড় ছাহেবজাদা) স্বপ্নের কথা অবহিত করেন। বড় হুজুর তা শ্রবণ মাত্রই তাঁকে ধমক দেন। অতঃপর সেই রাত্রিতেই বড় হুজুর স্বপ্নে দেখলেন, ঘটনা সত্যি।তারপর দিন দিবাগত রাতে বড় হুজুর কয়েকজন একনিষ্ঠ শিষ্যকে নিয়ে গভীর রাতে তাঁবু পাল্টানাের কাজ শুরু করেন। মাটিতে কোদালের কোপ দেয়া মাত্রই এক অপূর্ব আলাে এসে চর্তুদিক আলােকিত হয়ে যায়। কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তা বিদ্যমান ছিল। আর কবরে মিশকের ন্যায় সুগন্ধি বয়ে যাচ্ছিল। বড় হুজুর কিবলা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, মাওলানা রুহুল কুদ্দুস রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, মৌলভী আহমদ শুকুর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ও সৈয়দুর রহমান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রমুখ শিষ্যগণ কবরে নামেন। তাঁরা আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলেন যে, আমরা হুজুরের কাফনের কাপড় অক্ষতঅবস্থায় পেয়েছি। আমরা হুজুরের চেহারা মােবারক দেখতে পেয়েছি।হুজুরের দাঁড়ি মুবারক টেনে দেখেছি তা পূ্বের তুলনায় বহুগুণ শক্ত পেয়েছি।
(সুবাহানাল্লাহ)।

তাঁর রচিত অমূল্য গ্রন্থাবলী

১. “ফাতওয়ায়ে তাওয়াককুলীয়া (৭ খন্ড সম্বলিত)।
২. মানতিক শাস্ত্রে – “দানিশ মানদী”।
৩. নাহু শাস্ত্রে “খরদ মানদী”।
৪. ছরফ শাস্ত্রে “আকৃল মানদী”।
৫. হাদীছ শাস্ত্রে “মাজমুয়ায়ে জারায়িফ ওয়াল গারায়িব”।
৬. দাফিউল বালায়ি ওয়াল ওয়াবায়ি।

ওফাত

তিনি ১৩৭২ হিজরী সনের ২৪শে জমাদিউছ ছানী, ২৬শে ফালগুন,সালের ১১ মার্চ রােজ বুধবার পূর্বাহ্নের সময় নিজ বাস ভবনে ইন্তিকাল করেন(ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন) বৃহস্পতিবার বাদে আছর তাঁর নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। বড় হুজুর ক্বিবলাহ অর্থাৎ তাঁর বড় ছাহেবজাদা শায়খুল হাদীছ হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব সৈয়দ ওবাইদুল মুস্তফা মুহাম্মদ নুরুচ্ছফা নঈমী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর জানাযা নামাজের ইমামতি ১৯৫৩ করেন।

Related Articles

Back to top button
close