আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি একজন কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব

কাজী মুহাম্মদ জুনাইদ জাকী

প্রাককথনঃ

ওলিয়ে কামেল আওলাদে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ রাহ. ছিলেন একাধারে একজন যুগশ্রেষ্ঠ নায়েবে রাসুল, পীরে কামেল, রাসুল কারীম (দ.)-এর বংশধর (৪০তম অধঃস্তন ব্যাক্তি) এবং তরীকায়ে আলীয়া কাদেরীয়ার অন্যতন প্রাণপুরুষ। একজন আদর্শ আওলাদে রাসুল হিসেবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুন্নাতে-রাসুল অনুযায়ী জীবন পরিচালনা পৃথিবীর ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দ্বীন, মাযহাব-মিল্লাতের খেদমতে পুরো জীবনেকে তিনি উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন।

শুভ বেলাদত ও বংশ পরিচয়ঃ

হুযুর কেবলা আল্লামা তৈয়ব শাহ রাহ. ১৩৩৬হিজরীতে, ১৯১৬খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমন্ত প্রদেশের হাজারা জিলার সিরিকোট শেতালু শরীফের আলে রাসুল আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি এর পবিত্র ঔরশে জন্মগ্রহণ করেন। বুযুর্গ পিতা শাহনশাহে সিরিকোট আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহ. ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ কামেল ওলী এবং আওলাদে রাসুল (দ.)। আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ রাহ. ছিলেন ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর বংশধর। হুসাইনী বুযুর্গদের মধ্যে হযরত গীসুদারাজ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য বাগদাদের আউস নগরী থেকে আফগানিস্তান সফর করেছিলেন। পরবর্তীতে ৪২১হিজরীতে ওই দেশের কোহ্-ই-সোলাইমানী নামক স্হানে ইনতিকাল করেন। তাঁর পুত্র প্রসিদ্ধ বুযুর্গ হযরত সৈয়দ মাসউদ মাশওয়ানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র একজন বংশধর হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ গফুর শাহ ওরফে কাফুর শাহ রাহ. ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য আফগানিস্তান ছেড়ে বর্তমান সিরিকোট শরীফের সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করেন। তাই হযরত সৈয়দ গফুর শাহ কে ‘ফাতেহে সিরিকোট’ বা ‘সিরিকোট বিজয়ী’ বলা হয়। এই প্রখ্যাত ওলীয়ে কামেল হযরত সৈয়দ কাফুর শাহ এর অধঃস্তন পুরুষ হলেন হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।

শিক্ষাজীবনঃ

বুযুর্গ পিতা হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহ. এর তত্ত্বাবধানে ১১বছর বয়সে পবিত্র কুরআন শরীফ হেফজ করেন। অতঃপর শ্রদ্ধেয় পিতার নিকট এবং পরবর্তীতে গাউছে দাঁওরা ইলমে লাদুন্নীর প্রস্রবন খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহ. প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের হরিপুর দারুল উলুম রহমানিয়া ইসলামিয়া মাদরাসায় দীর্ঘ ১৬বছর যাবৎ কুরআন, হাদীস, তাফসীর ফিকহ্, আরবী ব্যাকরণ, আকাইদ, বালাগাত, মানত্বিক ইত্যাদি ইলমে দ্বীনের শাখাগুলোতে বুৎপত্তি অর্জন করেন। তাঁর ওস্তাদগণের মধ্যে বিখ্যাত আলেমে দ্বীন, মুফতি, মুফাসসির হযরত আল্লামা সরদার আহমদ শাহ লায়লপুরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি অন্যতম যাঁর সান্নিধ্যে তিনি প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞানার্জন করেছেন৷

খিলাফত লাভ ও সিলসিলার প্রচারে বিদেশ গমনঃ

শাহেনশাহে সিরিকোট হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বাংলাদেশে আসলে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লাস্হ কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের উপর তলায় লাইব্রেরিতে বেশিরভাগ সময় অবস্থান করতেন। ১৯৫৮সালে আখেরী সফরের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) তশরীফ আনলে চট্টগ্রামস্হ রিয়াজুদ্দীন বাজারে মরহুম শেখ আফতাব উদ্দীনের দোকানে ধর্মীয় প্রোগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। সেদিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। উক্ত দোকানে খতমে গাউছিয়া শরীফ চলাকালীন উপস্থিত অনেক পীর ভাইদের সামনে হযরত আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে খেলাফত দান করেন এবং ‘খলীফায়ে আযম’ উপাধিতে ভূষিত করেন। হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ এর সম্পর্কে আপন পিতা ও মুর্শিদ হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি বলেছেন, ‘তৈয়ব কা মকাম বহুত উঁচা হ্যাঁয়, তৈয়ব মাদারজাদ ওলী হ্যাঁয়’ অর্থাৎ ‘তৈয়ব শাহ এর মর্যাদা অনেক সুউচ্চ , তৈয়ব শাহ মাতৃগর্ভের ওলী।’ ১৯৬১খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারের মতো হুযুর কেবলা আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ বাংলাদেশে শুভ আগমন করেন।

শরীয়ত-তরীকতের প্রচার-প্রসারে ১৯৬১সাল থেকে ১৯৮৬সাল পর্যন্ত নানা সময়ে বাংলাদেশে এসে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে দ্বীন ও মাযহাব-মিল্লাতের বিশাল গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ, ভারত, বার্মা, ইরান, সৌদি আরব, মস্কো, আফ্রিকা, ব্রিটেন সহ প্রভৃতি দেশসমূহে সফর করে তরীকতের প্রচার-প্রসার এবং ইসলামের সঠিক মূলধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অতুলনীয় খেদমতের আনজাম দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, তাঁর যোগ্য প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৭৬সালে নিজ সাহেবজাদাদ্বয় রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরীকত হযরত আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ এবং পীরে বাঙ্গাল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ সাবের শাহ কে সিরিকোট দরবার শরীফে খেলাফত ও বায়আতের ইযাযত প্রদানে ধন্য করেছেন।

দ্বীনি সংস্কারে অবদানঃ

১৯৭৪সাল ছিল ঐতিহাসিক একটি বছর। স্বাধীনতার পর তিনি সিরিকোট শরীফ থেকে আনজুমান কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়ে নির্দেশ দিলেন ১২ই রাবিউল আউয়াল রাসুল কারীম (দ.)- এর শুভ আগমন উপলক্ষে ‘জশনে জুলুস’ এর আয়োজন করার জন্য। জশনে জুলুস কি এবং কিভাবে পালন করা হবে তার রুপরেখা এবং সকল ধরনের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা তিনি চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন। বাংলাদেশের জমিনে প্রথম এই জুলুস ১৯৭৪সালে বলুয়ার দিঘীস্হ খানকাহ শরীফ থেকে আলহাজ্ব নুর মুহাম্মদ সওদাগর আলকাদেরী (যিনি হুযুরের মুরিদ ও খলিফা ছিলেন) -এর নেতৃত্বে বের হয়েছিল। এরপর ক্রমান্বয়ে এটি এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় জুলুসে পরিণত হয়। প্রতিবছর হুযুর কেবলার সদারতে এই জুলুসে প্রায় ৩০লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়। তিনি এশিয়াখ্যাত দ্বীনি শিক্ষার অন্যতম প্রধান মারকাজ জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া এবং এশিয়ার অন্যতম সর্ববৃহৎ দ্বীনি সংস্হা আনজুমান -এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট এর পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে মুসলিম উম্মাহকে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবধ্য করেছেন। বিশেষত, মীলাদ-কিয়ামে সর্বপ্রথম আলা হযরতের কালজয়ী নাতে রাসুল ‘মুস্তাফা জানে রহমত পে লাখো সালাম'(সালামী)’র সংযোজক তিনিই।১৯৮৬সাল ছিল হুযুর কেবলার বাংলাদেশের শেষ সফর। শরীয়ত-তরীকতের কার্যক্রমকে সকল পীরভাইদের মধ্যে জারি করার লক্ষ্যে গাউছুল আযম আবদুল কাদের জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর নাম মুবারকে বাংলাদেশে ‘গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ ‘ এবং পাকিস্তানে ‘মজলিসে গাউছিয়া সিরিকোটিয়া’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। বর্তমানে গাউছে পাকের সৈনিকদের কার্যক্রম দেশ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে পরিলক্ষিত ও প্রশংসিত হচ্ছে।

দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও প্রকাশনায় অবদানঃ

আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বেলায়তী নজরে দেখলেন যে, রাজধানী ঢাকায় সঠিক আকিদা তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের কোনো দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। তাই ১৯৬৮সালে ঢাকার মুহাম্মদপুরে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘কাদেরীয়া তৈয়্যবীয়া কামিল (এম.এ) মাদরাসা’ যা রাজধানীর বুকে ইসলামের সঠিক মূলধারার একমাত্র উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এভাবে তিনি হালিশহর মাদরাসা-এ তৈয়্যবীয়া ইসলামিয়া ফাযিল, চন্দ্রঘোনা মাদরাসা-এ তৈয়্যবীয়া অদুদিয়া সুন্নিয়া, মাদরাসা-এ মুহাম্মদীয়া তৈয়্যবীয়া (ফরিদগঞ্জ), মাদরাসা-এ গাউছিয়া তৈয়্যবীয়া (কুমিল্লা), মাদরাসা-এ তৈয়্যবীয়া সুন্নিয়া (হাটহাজারী), মাদরাসা- তৈয়্যবীয়া সুন্নিয়া (ভৈরব), মাদরাসা-এ তৈয়্যবীয়া (করাচী,পাকিস্তান), মাদরাসা-এ আহলে সুন্নাত (রেঙ্গুন, মায়ানমার) সহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন যা দ্বীন, মাযহাব-মিল্লাত, শরীয়ত-তরীকত বিশেষত মসলকে আলা হযরত প্রচার-প্রসারে অনন্য ভূমিকা পালন করছে। প্রকাশনা ক্ষেত্রে তাঁর অবদান আজ সর্বজনস্বীকৃত। তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত এবং মসলকে আলা হযরতকে সর্বত্র পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টায় ১৯৭৮সালে তাঁর মহান নির্দেশে বাংলাদেশের আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টকে নির্দেশ দেন ‘মাসিক তরজুমান-এ আহলে সুন্নাত ‘ প্রকাশ করার জন্য। ১৯৭৮সাল থেকে এখন পর্যন্ত এটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। বলা হয়, এটি হুযুর কেবলার অনন্য পদক্ষেপ যা সুধী সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আর ১৯৮৬সাল হতে তাঁর নির্দেশে পাকিস্তানে মজলিসে গাউছিয়া কর্তৃক প্রকাশিত হচ্ছে ‘আনওয়ারে মুস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’ নামক একটি নিয়মিত প্রকাশনা।

ইন্তেকালঃ

বিংশ শতাব্দীর এই মহাপুরুষ ৭ই জুন, ১৯৯৩খ্রিস্টাব্দ, ১৪১৩হিজরী, সোমবার সকাল সাড়ে ৯টায় সিরিকোট গ্রামের নিজ বাসভবনে দরবারে আলিয়া কাদেরীয়া সিরিকোট শরীফে লক্ষ লক্ষ আশেকদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে মহান রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্যে গমন করার জন্য ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭বছর। জানাযায় ইমামতি করেন তাঁরই সুযোগ্য সাহেবজাদা আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ মুদ্দাজিল্লুহুল আলী। তাঁর জানাযায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, রাষ্ট্রীয় নেতৃবর্গ, দেশ-বিদেশের উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ সহ অসংখ্য ভক্ত-মুরীদান উপস্থিত ছিলেন। তাঁকে নিজ পিতা হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র মাযারের পার্শ্বে সমাহিত করা হয়।

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ।

Related Articles

Back to top button