উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি হযরত দাতা গঞ্জে বখশ (রহ.)

আহমদ শাহ আদীল

گنج بخش فيض عالم مظهر نور خدا
ناقصان را پیر کامل، کاملار را رهنما                        

নাম ও বংশ পরিচয়

হযরত দাতা আলী হাজবেরী এর উপনাম- আবুল হাসান, আর নাম- আলী। তিনি গযনীর অধিবাসী ছিলেন। জুল্লাব ও হাজবীর ‘গযনী’র মহল্লাগুলোর মধ্যে দু’টি মহল্লা, প্রথমে জুল্লাবে অবস্থান করতেন অতঃপর হাজবীরে স্থানান্তরিত হয়ে যান। তিনি ‘গঞ্জে বখশ’ ও ‘দাতা গঞ্জে বখশ লাহোরী’ নামে প্রসিদ্ধ।

তাঁর জন্ম প্রায় ৪০০ হিজরীতে (১০০৯ সন)। আলী হাজবেরী পিতৃ-মাতৃ উভয়দিকেই হাসানী ও হোসাইনী সৈয়দ ছিলেন। তাঁর বংশগত ধারা নিম্নরূপ:

হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)
হযরত আলী (রা.)
হযরত ইমাম হাসান (রা.)
হযরত যায়েদ (রা.)
হযরত হাসান আসগর (রা.)
হযরত আবুল হাসান আলী (রা.)
হযরত শাহ সুজা (রা.)
হযরত আবদুর রহমান (রা.)
হযরত আবুল হাসান আলী (রা.)
হযরত মুহাম্মদ উসমান (রা.)
হযরত আলী হাজবেরি (রা.)

তাঁর জ্ঞানার্জন ও উস্তাদবৃন্দ

হযরত আলী হাজবিরী তৎকালীন জগদ্বিখ্যাত ওলামা ও মাশায়েখের কাছ থেকে ইলমে শরীয়ত ও মারিফাত শিক্ষা লাভ করেছেন। তাঁর উস্তাদগণের মধ্য হতে হযরত শাইখ আবুল আব্বাস আশকানী (র), শাইখ আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনুল মিসবাহ সঈদলানী (র), শাইখ আবুল কাসিম আবদুল করীম ইবনে হাওয়াযিন আল-কুশাইরী (র), শাইখ আবুল কাসিম ইবনে আলী ইবনে আবদুল্লাহ আল-গুরগানী (র), আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আলী আল-মারাফ দাস্তানী বুস্তামী (র), আবু সাঈদ ফাজলুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ মুহাইনী (র) এবং আবু আহমদ মুজাফফর ইবনে আহমদ ইবনে হামদান (র) প্রমুখ উল্লেখযােগ্য।

বিভিন্ন দেশে সফর

সিরিয়া, ইরাক, পারস্য, কোহিস্তান, আজারবাইজান, তিবরিস্তান, খুজিস্তান, কিরমান, খােরাসান, তুর্কিস্থান এবং অন্যান্য বহু দেশ ভ্ৰমণ করেছেন হজরত আলী হাজবিরী (রহ.)। এসমস্ত দেশের অনেক বুযুর্গের সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেছেন এবং তাঁদের খেদমতে থেকে রূহানী দীক্ষা হাসিল করেছেন। খােরাসানেই তিনি প্রায় তিন’শ মাশায়েখের সাথে সাক্ষাত করেন। তিনি বলেন, “আমি খােরাসানে এরূপ তিন’শ বুযুর্গ দেখেছি, যাঁদের একজনই দুনিয়ার মানুষের হেদায়েতের জন্য যথেষ্ট।”

তরিকতের দীক্ষা লাভ

হযরত দাতা গঞ্জে বখশ (রহ.)’র আধ্যাত্মিক জগতের মুরশিদ ছিলেন হযরত শাইখ আবুল ফজল মুহাম্মদ ইবনে হাসান খাত্তালী (রহ.)। তাঁর সিলসিলার শাজরা নিম্নরূপ-

হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)
হযরত ‍আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)
হযরত হোসাইন ইবনে আলী (রা.)
হযরত জয়নুল আবেদিন (রা.)
হযরত বাকির (রা.)
হযরত জাফর সাদিক (রা.)
হযরত মুসা কাজিম (রা.)
হযরত আলী রিদা (রা.)
হযরত মারুফ কারখী (রা.)
হযরত ছিররিউ সাকতী (রা.)
হযরত জুনাইদ বাগদাদী (রা.)
হযরত আবু বকর শিবলী (রা.)
হযরত শাইখ হুসরি (রা.)
শাইখ আবুল ফজল বিন হাসান (রা.)
খাজা দাতা গঞ্জে বখশ আলী হাজবেরী (রা.)

লাহোর আগমন

হজরত আলী হাজবেরী (র) স্বীয় মুরশিদের নির্দেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে সুলতান মাহমুদ গজনির পুত্র নাসিরুদ্দীন মাসউদের শাসন আমলে ১০৩০-১০৪০খ্রি: মােতাবেক ৪২১-৪৩২ হি: লাহাের আগমন করেন। এর পূর্বে তাঁর পীরভাই হােসাইন যানজানী এই কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এজন্য যখন তাঁকে লাহাের গমনের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন তিনি স্বীয় মুর্শিদের কাছে আরজ করলেন যে, সেখানে হােসাইন যানজানী অবস্থান করছেন। সুতরাং সেখানে আমার যাওয়ার কী প্রয়ােজন রয়েছে ? তাঁর শায়েখ বললেন, না, তােমাকে সেখানে যেতে হবে। হজরত আলী হাজবিরী (র) বলেন, আমি রাতে লাহাের পৌঁছায় এবং ভােরে দেখতে পেলাম যে, হােসাইন যানজানীর জানাযা শহর থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

হিন্দু যোগী শাসকের ইসলাম গ্রহণ

এক বৃদ্ধ মহিলা দুধের কলস নিয়ে যাওয়ার কালে হযরত দাতা গঞ্জে বখশ (রহ.) তার কাছে সামান্য দুধ চান। বৃদ্ধা অপারগতা জানিয়ে বলেন, তিনি ‘রায় রাজু’র জন্য দুধ নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যদি দুধ সেখানে না পৌঁছান তাহলে তার গাভী-মহিষের ওলান হতে দুধের পরিবর্তে রক্ত নির্গত হতে আরম্ভ করবে।

দাতা সাহেব বৃদ্ধাকে অভয় দিয়ে বললেন, রক্ত বের হবে না, বরং দুধ বেড়ে যাবে। সুতরাং বৃদ্ধা তাঁর সমীপে দুধ পেশ করেন। দাতা সাহেব তার প্রয়োজন অনুপাতে দুধ গ্রহণ করেন এবং অবশিষ্ট দুধ দরিয়ায় ঢেলে দেন। দেখা গেল, এ বৃদ্ধার পশুগুলোর দুধ সত্যি সত্যিই বেড়ে গেছে। পরিণামে অন্যান্য লোকেরাও ‘রায় রাজু’র অংশ হজরত দাতা সাহেবের খেদমতে পেশ করতে লাগল।

এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ যোগী শাসক খোদ অবস্থা পর্যবেক্ষণে এবং পরিস্থিতি মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে ঘটনাস্থলে আগমন করেন এবং হযরত দাতা সাহেব (রহ.)-এর কাছ থেকে আরো কিছু কারামত দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু দাতা সাহেব বলেন, ‘আপনার নিকট কোনো অলৌকিক ঘটনা থাকলে আগে তা প্রদর্শন করুন।’

অবশেষে তিনি (রায় রাজু) তার এই কারিশমা উপস্থাপন করেন যে, তিনি বাতাসে উড়াল দিয়েছেন। তখন দাতা সাহেবের ইশারা পেয়ে তার জুতো জোড়া যোগীর মাথার ওপর আঘাত করতে লাগলে এ জুতো মারের ফলে তার মাথা ঠিক হয়ে যায় এবং রায় রাজু তাওবা করে হজরত দাতা গঞ্জে বখশের হাতে ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হন। হযরত দাতা সাহেব (রহ.) তাকে ‘শায়খে হিন্দি’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

অপর এক বর্ণনা অনুযায়ী মুসলমান হওয়ার পর ‘শায়খে হিন্দি’ তার দৃঢ় ও ইখলাসে এতই উন্নতি লাভ করেন যে, হিজরী ৪৬৫ (১০৭২) সালে স্বীয় মুর্শিদের ইন্তেকালের পর তিনিই তার হেদায়েত তাবলিগের আসনে আসীন হন এবং তাঁর গদিনশিন হন। সারা জীবন তিনি ইসলামের প্রচার-প্রসারে সাধ্যমতো চেষ্টা করেন এবং স্বীয় মুর্শিদের শিক্ষা ও ইসলামের বাণী লোকদের মধ্যে পৌঁছাতে থাকেন এবং এ ধারা রায় রাজুর বংশে অব্যাহত থাকে।

তারাই হযরত দাতা গঞ্জে বখশের দরগাহের ঝাড়–দার, খাদেম হিসেবে নিয়োজিত হন এবং সরকার কর্তৃক দরগাহের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার আগ পর্যন্ত তারাই খাদেমের দায়িত্ব পালন করেন। হজরত দাতা সাহেব যেখানে আসন গ্রহণ করতেন, পরবর্তীকালে সেখানে মর্মর পাথরের লগন (বারকোব) বসানো হয়, যাকে চশমা (ঝরনা) বলা হয়। এ ঝরনা হতে লোকেরা ভক্তি সহকারে পানি নিয়ে যায়।

তাঁর মাযারে আউলিয়াদের চিল্লা

বিভিন্ন জগদ্বিখ্যাত আল্লাহর অলিদের আলী হাজবেরী (রহ.)-এর দরবার থেকে ফয়েজ ও বরকত লাভের কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। বিশেষ করে হযরত খাজা মুঈনউদ্দীন চিশতী আজমীরি (রহ.) এবং খাজা ফরিদ উদ্দীন গঞ্জে শকর (রহ.) ফয়েজ ও বরকত লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর মাযারে চল্লিশ দিন পর্যন্ত অবস্থান বেশি প্রসিদ্ধ।

হজরত খাজা মুঈনউদ্দীন চিশতী (রহ.) চিল্লা শেষে এই কবিতা আবৃত্তি করেন-
گنج بخش فيض عالم مظهر نور خدا
ناقصان را پیر کامل، کاملار را رهنما

“দানের ভাণ্ডার বিশ্বের আশীর্বাদ প্রভুর নূরের আধার। অসম্পূর্ণকে পূর্ণতা দানকারী ও পূর্ণতা লাভকারীর পথপ্রদর্শক।”

রচনাবলি

হযরত দাতা গঞ্জে বখশ (রহ.) নিম্নলিখিত গ্রন্থাবলি রচনা করেছেন। কিন্তু এখন কাশফুল মাহজুব ছাড়া অন্য কোন গ্রন্থ পাওয়া যায় না।

ক. কাশফুল মাহজুব
খ. মিনহাজুদ্দীন
গ. আর-রিআইয়াতু লিহুকুকিল্লাহ
ঘ. কিতাবুল ফানা ওয়াল বাকা
ঙ. আসরারুল ফারক ওয়াল মুনাত
চ. বাহারুল কুলুব
ছ. কিতাবুল বয়ান লিআহলিল আয়ান।

তাঁর অনবদ্য গ্রন্থ ‘কাশফুল মাহজুব’

হযরত দাতা গঞ্জে বখশ (রহ.) বলেন, “আমি এই কিতাবের নাম কাশফুল মাহজুব এই জন্য রেখেছি যে, যাতে গ্রন্থের নামে এর বিষয়বস্তু পাঠকবৃন্দ অনুধাবন করতে পারেন। বিশেষ করে, যেহেতু এই কিতাব আল্লাহর পথের বর্ণনা এবং মানুষের সামনের আল্লাহপ্রাপ্তির অন্তরায় রূপ পর্দা দূর করার উদ্দেশ্যে রচনা করা হয়েছে, এই কারণে এ গ্রন্থের নাম কাশফুল মাহজুব রাখা হয়েছে।

হযরত দাতা গঞ্জে বখশ (রহ.) এ বই লেখার কারণ সম্পর্কে বলেন, গজনির আবু সাঈদ নামে এক ব্যক্তি আমাকে নিম্নলিখিত বিষয়ে একটি গ্রন্থ লেখার অনুরােধ করেন।

ক. তাসাউফের তরিকার গবেষণা।
খ. তাসাউফের বিভিন্ন স্তরের অবস্থা।
গ. তাসাউফের বিভিন্ন মাযহাব ও তার বর্ণনা।
ঘ, তাসাউফের রহস্য আলােচনা।
ঙ. আল্লাহ তায়ালার মহব্বত এবং এর প্রতিক্রিয়া কিভাবে অন্তরে স্থায়ী হয়।
চ. মানুষের জ্ঞান কেন আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বের রহস্য পর্যন্ত পৌছতে সক্ষম হয় না।
ছ. আল্লাহ তায়ালার হাকিকত থেকে মানুষের নফসের মুখ ফিরিয়ে থাকা এবং আত্মা তার গুণাবলীর সাথে কেন শান্তি লাভ করে।

হযরত দাতা গঞ্জে বখশ (র) বলেন, আমি এ প্রশ্নাবলির মাঝে ইখলাস, ন্যায়-নিষ্ঠা এবং সত্য অনুসন্ধানের বিষয়টি অনুভব করি। ফলে এ গ্রন্থ রচনার কাজ আরম্ভ করি।

এই বইটি সম্পর্কে বিখ্যাত তাপসগণের মন্তব্য

১. হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়া (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তির কোন মুরশিদ নেই কাশফুল মাহজুব পাঠের মাধ্যমে সে তা পেয়ে যাবে।

২. মােল্লা জামী (রহ.) বলেন, কাশফুল মাহজুব ইলমে তরিকতের প্রসিদ্ধ এবং নির্ভরযােগ্য কিতাব। এ কিতাবে ইলমে তরীকত ও মারেফাতের সমস্ত রহস্য জমা করা হয়েছে।

৩. দারাশিকো এ গ্রন্থ সম্পর্কে বলেন, হযরত আলী হাজবিরী (রহ.) একজন কামিল মুরশিদ ছিলেন এবং কাশফুল মাহজুব তাঁর সুপ্রসিদ্ধ কিতাব। এ কিতাব সম্পর্কে কারাে কোন সমালােচনা নেই।

৪. হযরত জাহাঙ্গীর আশরাফ সিমনানি (রহ.) তাঁর মালফুজাতের বহু স্থানে কাশফুল মাহজুব-এর উদ্ধৃতি দিয়েছেন।

দিদারে ইলাহী

হিজরি ৪৬৫ (১০৭২) সনে হযরত দাতা গঞ্জে বখশ (রহ.) লাহােরে দিদারে ইলাহীতে মিলিত হন এবং সেখানেই এ মহান মনীষীকে সমাহিত করা হয়।

ইতিহাসে জানা যায়, নাসিরুদ্দীন মাসউদের পুত্র জহিরুদ্দৌলাহ তাঁর মাজার তৈরি করেন এবং তাঁর খানকাহ বাদশাহ জালালুদ্দীন আকবর (১৫৫৫-১৬০৫ খ্রি: মােতাবেক ৯৬৩-১০১৪হি:) নির্মাণ করেন। বর্তমানে প্রতি বছর মাযার যিয়ারত করেন সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মুসলমান এবং ওরশের দিন লাহোরে সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয় যাতে মানুষ নির্বিঘ্নে যিয়ারতে অংশগ্রহণ করতে পারে।

তথ্যসূত্র:
১| উইকিপিডিয়া
২| কাশফুল মাহজুব

লেখক: শিক্ষার্থী- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া

Related Articles

Back to top button
close