শাফেয়ী মাযহাবের প্রবক্তা ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস শাফেয়ী (রা:)’র সংক্ষিপ্ত জীবনী

জন্ম ও বংশ পরিচয়

ইমাম শাফেয়ী (র.) আব্বাসীয় খেলাফতকালে ১৫০ হিজরি মোতাবেক ৭৬৭ সনে ফিলিস্তিনের গাজা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ইদরীছ ও দাদার নাম আববাস । ইমাম শাফেয়ীর উপনাম আবূ আব্দুল্লাহ্।

বংশ নামা

“মুহাম্মদ বিন ইদ্রীস বিন আববাস বিন উসমান বিন শাফেয়ী আল কুরায়েশী আল শাফেয়ী আল মাক্কী”।ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-এর বংশ- কুরাইশ বংশের অন্যতম আবদে মানাফ বিন কুসাই এর কাছে মিলিত হয়েছে, তাই ইমাম শাফেয়ীর বংশের মূল এবং রাসূল -এর বংশ একই। এ জন্য তিনি আল-মুত্তালাবী বলে পরিচিত । তিনি কুরাইশ বংশের তাই কুরায়েশী এবং তার দাদা “শাফে” সাহাবী এর দিকে সম্পৃক্ত করায় শাফেয়ী,মক্কায় প্রতিপালিত হওয়ায় মাক্কী বলে পরিচিতি লাভ করেন। ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-এর উপাধি হল, ‘‘নাসিরুল হাদীস’’ হাদীসের সাহায্যকারী বা সহায়ক,কারণ হাদীস সংগ্রহ, সংকলন, বিশেষ করে হাদীসের যাচাই-বাছাইয়ে তিনি সর্ব প্রথম অবদান রাখেন। তিনিই সর্ব প্রথম হাদীস শাস্ত্রের নীতিমালা প্রণয়নে কলম ধরেন আর রিসালাহ ও আল উম্ম’ গ্রন্থদ্বয়ে। অতঃপর সে পথ ধরেই পরবর্তী ইমামগণ অগ্রসর হন।

তিনি একজন ফিলিস্তিন-আরব মুসলমান তাত্ত্বিক, লেখক এবং পন্ডিত যিনি ইসলামের অন্যতম সেরা আইনবিদ হিসাবে পরিচিত। তিনি ইমাম শাফেয়ী নামে বেশি পরিচিত। তাঁকে শায়েখ আল-ইসলাম হিসাবেও সম্বোধন করা হয় এবং তিনি ইসলামের প্রধান চারটি মাযহাবের একটি শাফি’ঈ মাযহাবের প্রবক্তা। তিনি ছিলেন ইমাম মালিক ইবনে আনাসের অন্যতম সেরা শিক্ষার্থী এবং তিনি নাজারাহ-এর গভর্নর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

বাল্যকাল

ইমাম শাফেয়ী মাত্র ২ বছর বয়সেই পিতাকে হারান। পিতার মৃত্যুর পর অভিভাবকহীনতা ও দারিদ্রতা ইত্যাদি নানা সমস্যার সম্মুখীন হন, পিতা মারা গেলে বিচক্ষণ মা তাকে দু’বছর বয়সে পিতৃভুমি ইয়ামেনে নিয়ে আসেন । তিনি তাঁর ছেলেকে কুরআন মুখস্ত করানোয় মনোনিবেশ করান এবং ৭ বছর বয়সে ইমাম শাফেয়ী সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্ত করে ফেলেন। এর পাশাপাশি ইমাম শাফেয়ী বিভিন্ন মসজিদে ঘুরে আলেমদের শরণাপন্ন হয়ে বিভিন্ন হাদীস ও মাসআলা মুখস্ত করতে শুরু করেন । এর কিছু বছর পরেই তিনি তাঁর মায়ের সাথে মক্কায় পাড়ি জমান । ইমাম শাফেয়ী ছোটবেলা থেকেই শিক্ষানুরাগী এবং কঠোর জ্ঞান সাধনা করার ফলে ৭ বছরে কুরআনের হাফেয এবং ১০ বছরে মুয়াত্তা হাদীস গ্রন্থ (ইমাম মালিকের “মুয়াত্তা” সর্বপ্রথম প্রামান্য হাদীসগ্রন্থ) হিফয করে ১৮ বছর বয়সে থেকে ফতোয়া প্রদান শুরু করেন। সাথে সাথে মক্কায় আরবী পন্ডিতদের কাছে আরবী কবিতা ও ভাষা জ্ঞানে পূর্ণ পান্ডিত্ব লাভ করেন।

মদিনা সফর

তিনি ছোটবেলায় একবার মদীনা সফর করেন ইমাম মালিকের সংকলিত গ্রন্থ মুয়াত্তা মুখস্থ করে তাকে শুনান, ইমাম শাফেয়ীর ছোট বয়সে এই প্রজ্ঞা ও প্রতিভা দেখে তিনি অভিভূত হন। এবং তাকে স্নেহের পাত্র বানিয়ে নেন । ইমাম শাফেয়ী ইমাম মালিকের নিকট জ্ঞান চর্চা শুরু করেন । মদীনার পর তিনি ইয়ামানে শিক্ষার উদ্দেশ্যে বের হন। সেখানে শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন। জনসমাজে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে তিনি বিদ্বেষিদের প্রকোপে পড়েন, ফলে তিনি ইয়ামেন ত্যাগ করে আবার মক্কায় ফিরে আসেন।

ইরাক সফর

ইমাম শাফেয়ী ইরাকে দু’বার সফর করেন। প্রথমবার রাজনৈতিক কারণে খলীফা হারুনুর রশীদ তাকে ইরাকে জোরপূর্বক পাঠান । সেখানে গিয়ে তিনি ইরাকের প্রসিদ্ধ জ্ঞানীদের নিকট শিক্ষা সমাপন করে আবার মক্কায় ফিরে আসেন এবং পূর্ণদমে দরস-তাদরীস ও ইসলাম প্রচার-প্রসারের কাজে একটানা নয় বছর এই কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

অতঃপর ১৯৫ হিঃ ইমাম শাফেয়ী আবারো ইরাক সফর করেন । প্রথম সফর ছিল জ্ঞান শিক্ষা গ্রহণের আর এ সফর হলো শিক্ষা গ্রহণ পাশাপাশি শিক্ষাদানের জন্য।

ইমাম বায়হাকী (রহ.) স্বীয় সনদে বর্ণনা কারেন, হুসাইন কারাবিসী আমার কাছে আসলেন এবং বললেন যে, আমাদের মাঝে একজন হাদীস পন্থী (আহলে হাদীস) এসেছেন চল আমরা তার কাছে গিয়ে একটু হাসি-ঠাট্টা করি।

আবূ ছাওর বলেন, আমরা তার কাছে গেলাম, হুসাইন ইমামকে এক মাসআলা জিজ্ঞাসা করলেন, জবাবে ইমাম সাহেব আল্লাহ ও রাসূল উদ্ধৃতি দিয়ে তাদের জবাব দিতে থাকলেন এভাবে রাত হয়ে গেল । তখন আমরা তার কুরআন ও হাদীসের অগাধ পান্ডিত্ব দেখে আশ্চর্য হলাম, শেষটায় আমরা তার কাছে আত্মসমর্পণ করলাম। এ সফরেই ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.) ইমাম শাফেয়ীর সাক্ষাৎ করেন।

মিশর সফর

ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-এর ইরাকে অবস্থান যেমনি প্রশংসনীয় তেমনি আবার অপরদিক হতে কালো মেঘ নেমে আসতে লাগল। মুতাযিলা আলিমরা রাজনৈতিক প্রাঙ্গণ দখল করায় খলীফা হারুণসহ সে সময়ের আব্বাসীয় খলীফাগণ ফালসাফা ও তর্কবিদ্যা-মানতিকে প্রভাবিত হয়ে কুরআন মাখলুক বা মুতাজিলা বিশ্বাস পোষণ করে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আতের ইমাম যেমনঃ ইমাম আহমাদ, ইমাম শাফেয়ীর উপর নির্যাতন শুরু করে, যার ফলে বাধ্য হয়ে ইমাম শাফেয়ী ইরাক ত্যাগ করে মিসরে পারি জমান।

মিসরে আগমন করলেই মিসরবাসী তাকে অভিনন্দন জানান ও মিসরের বিখ্যাত মসজিদ– আমর বিন আল আস মসজিদে কিছু আলোচনা পেশ করলে সকলেই তার আলোচনায় মুগ্ধ হয়ে যান । এবং তারা এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, মিসরের বুকে এমন প্রতিভাবান ব্যক্তির কখনও আগমন ঘটেনি, যিনি কুরাইশ বংশোদ্ভুত, যার সালাতের ন্যায় উত্তম সালাত আদায় করতে কাউকে দেখিনি, যার চেহারার ন্যায় সুন্দর চেহারা খুব কমই আছে, যার বক্তব্য ও বাচন ভঙ্গির মত আকর্ষণীয় ও শ্রুতিমধূর কাউকে দেখিনি। তার হাদীস গবেষণা ও চর্চায় যারা হানাফী বা মালিকী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন, তার অনেকেই হাদীসের আলোকে ইসলাম চর্চার সুযোগ লাভে ধন্য হন। ইমাম শাফেয়ী জীবনের শেষ পর্যন্ত মিসরেই অবস্থান করেন এবং তার মূল্যবান গ্রন্থসমূহ সেখানেই সংকলন করেন।

আকীদাহ্

ইমাম শাফেয়ী (রহ.) আহলুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামা’আতের ইমাম। যিনি ছিলেন কুরআন ও সুন্নাহর একনিষ্ঠ অনুসারী, আকীদাহ্-বিশ্বাস, আমল-আখ্লাক, ইবাদাত-বন্দেগী সকল ক্ষেত্রে তিনি সব কিছুর উর্দ্ধে কুরআন ও সুন্নাহ্কে প্রাধান্য দিতেন এবং আঁকড়ে ধরতেন, তিনি কালাম পন্থী যুক্তিবাদী বিদ’আতি ঘোর বিরোধী ছিলেন, অনুরূপ রায় ও কিয়াস পন্থীদেরও বিরোধী ছিলেন। সুতরাং কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আহ্লুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামাআতের আকীদাহ্-বিশ্বাসই ইমাম শাফেয়ীর আকীদাহ্-বিশ্বাস।

ইমামের শিক্ষকবৃন্দ

ইমাম শাফেয়ী (রহ.) স্বীয় যুগে বিভিন্ন দেশে অগণিত আলিম হতে শিক্ষালাভ করেন । তন্মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য-

(১) ইমাম সুফইয়ান বিন উয়ায়নাহ (রহ.) – (মৃত: ১৯৮ হিঃ) (মাক্কী)।

(২) ইমাম ইসমাঈল বিন আব্দুল্লাহ (রহ.) – (মৃত: ১৭০ হিঃ) (মাক্কী)।

(৩) ইমাম মুসলিম বিন খালিদ (রহ.) – (মৃত: ১৭৯ হিঃ) (মাক্কী)।

(৪) ইমাম মালিক বিন আনাস (রহ.) – (মৃত: ১৭৯ হিঃ) (মাদানী)।

(৫) ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসমাইল (রহ.) – (মৃত: ২০০ হিঃ) (মাদানী)।

(৬) ইমাম হিশাম বিন ইউসুফ (রহ.) – (মৃত: ১৯৭ হিঃ) (ইয়ামানী)।

(৭) ইমাম ওয়াকী বিন আল জাররাহ্ – (রহ.) (মৃত: ১৯৭ হিঃ) (কুফী)।

ইমামের ছাত্রবৃন্দ

ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-এর ছাত্র হওয়ার যারা সৌভাগ্য লাভ করেছেন তাদের সংখ্যা ও বর্ণনা দেয়া অসম্ভব । কারণ তিনি যে দেশেই ভ্রমণ করেছেন এবং শিক্ষার আসরে বসেছেন সেখানেই অগণিত ছাত্র তৈরী হয়েছে ।
নিম্নে কয়েকজন প্রসিদ্ধ ছাত্রের নাম উল্লেখ করা হল-
(১) ইমাম রাবী বিন সুলায়মান আল মাসরী।

(২) ইমাম ইসমাঈল বিন ইয়াহইয়া আল মুযানী আল মাসরী।

(৩) ইমাম আবূ আব্দুল্লাহ্ আলফাকীহ আল মাসরী।

(৪) ইমাম আবূ ইয়াকূব ইউসুফ বিন ইয়াহইয়া আল মাসরী।

(৫) ইমাম আবুল হাসান বিন মুহাম্মদ আয্যাফরানী।

ইমাম শাফেয়ী সম্পর্কে অন্যান্য ইমামদের অভিমত

(১) ইমামুল মাদীনাহ- ইমাম মালিক (রহ.) বলেন : “আমি এ যুবক ইমাম শাফেয়ী এর মত অধিক বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান আর কোন কোরাইশীকে পাইনি” ।

(২) ইমাম আবূল হাসান আয্যাফরানী বলেন : ‘‘আমি ইমাম শাফেয়ীর ন্যায় অধিক সম্মানী, মর্যাদাশীল, দানশীল, আল্লাহ ভীরু দ্বীনদার ও অধিক জ্ঞানী আর কাউকে দেখিনি’’।

(৩) ইমাম ইসহাক বিন রাহ্উয়াহ (রহ.) বলেন : আমি ইমাম আহমাদ (রহ.) সহ মক্কায় ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-এর কাছে গেলাম, তাঁকে বেশ কিছু জিজ্ঞাসা করলাম তিনি খুব ভদ্রতার সাথে সাবলীল ভাষায় প্রশ্নের জবাব দিলেন।

(৪) একদল আলেম বলেন: ইমাম শাফেয়ী হলেন স্বীয় যুগে কুরআনের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী মানুষ।’’

(৫) ইমাম ইসহাক বলেন : আমি যদি তাঁর কুরআনের পান্ডিত্ব সম্পর্কে আগে অবগত হতাম তাহলে তাঁর কাছে শিক্ষার জন্য থেকে যেতাম’’ ।

গ্রন্থাবলী

ইমাম শাফেয়ী অসংখ্য গ্রন্থ রেখে গেছেন, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

(১) ‘কিতাবুল উম্ম’ মূলতঃ এটি একটি হাদীসের গ্রন্থ, যা ফিকহী পদ্ধতিতে স্বীয় সনদসহ সংকলন করেছেন, এটি একটি বিশাল গ্রন্থ। যাহা ৯টি বড় খন্ডে প্রকাশিত।
(২) ‘আর রিসালাহ’ এটা সেই গ্রন্থ যাতে ইমাম শাফেয়ী উসূলে হাদীস ও উসূলে ফিকহে সর্বপ্রথম কলম ধরেছেন।
(৩) আহকামুল কুরআন
(৪) ইখতিলাফুল হাদীস
(৫) সিফাতুল আমরি ওয়ান্নাহী
(৬) জিমাউল ইলম
(৭) বায়ানুল ফারয
(৮) ফাযাইলু কুরাইশ
(৯) ইখতিলাফুল ইরাকিঈন
(১০) ইখতিলাফু মালিক ওয়া শাফিয়ী ইত্যাদি আরো বহু গ্রন্থ রয়েছে।

ওফাত

ইমাম শাফেয়ীও (রহ.) ৮২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জানুয়ারী মোতাবেক ২০৪ হিজরীর রজবের প্রথম অন্যবর্ণনায় শেষ দিন জুমআর রাত্রিতে ৫২/৫৪ বছর বয়সে মিশরের আল কুস্তাত শহরে ওফাত লাভ করেন। কায়রোতে তাঁর পবিত্র মাজার শরীফ কমপ্লেক্স অবস্থিত।

মহান আল্লাহ তা’আলা যেন তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং এই মহান ইমামের ফয়ুজাত আমাদের দান করেন।

(সংকলিত)

Related Articles

Back to top button
close