জীবনী

শায়খুল হাদীস হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব আবদুল হামিদ ছাহেব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)

আলহাজ্ব মাওলানা মুহাম্মদ আবু তাহের

হযরত মাওলানা আবদুল হামিদ ছাহেব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) মুহাদ্দিস জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, ষোলশহর, চট্টগ্রাম সম্পর্কে সমসাময়িক প্রত্যেক ব্যক্তি কম-বেশী ওয়াকেফহাল রয়েছেন। জামেয়ার অধ্যাপনার পূর্বে চাঁদপুর শাহতলী আলিয়া, তারপূর্বে রেয়াছতে রামপুর, ইউ,পি, ভারতে শিক্ষা দীক্ষার প্রকৃত সময় অতিবাহিত হওয়ায় এ তিনটি স্থানে তিনি সবিশেষ পরিচিত। এ ছাড়াও ইলমে দ্বীনের সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভের পর পরই তরীক্বতের দীক্ষা গ্রহণপূর্বক স্বীয় মুর্শিদে কামেলের অনুমতিক্রমে যিয়ারতে হারামাইনে যান। তথায় ৪ বছর এবং সর্বশেষ আবাসস্থল পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড়স্থ গর্জনতলীতে স্বীয় প্রতিষ্ঠিত হামিদিয়া হাফেজীয়া মাদরাসা ও এতিমখানার প্রাঙ্গনে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন বিধায় এ দুটি স্থানও হুযূরের জীবনালেখ্যের সাথে জড়িত। বাস্তবিক পক্ষে তাঁর ব্যক্তিত্ব সর্বজন স্বীকৃত। কারণ তাঁর মধ্যে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন এমন সব গুণের সমাবেশ করেছেন, যা আমাদের সোনালী অতীতের মহান আলেমদের মাঝেই বিদ্যমান ছিল।

জন্ম ও বংশ পরিচয়-

কুমিল্লা জেলার বুড়িশ্চং থানার অন্তর্গত গাজীপুর গ্রামে ১৯১৮ ইংরেজি সনে হুযূর আবদুল হামিদ ছাহেব কেবলা জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মুহাম্মদ ইউসুফ আলী এবং মাতার নাম হাজেরা খাতুন। তাঁর পাঁচ ভাই এর মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।

বাল্যকাল-

তিনি গ্রামের সহজ সরল সাধারণ গরীব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বিধায় মক্তবে কুরআনে মজীদ পড়া শেষ হতে না হতেই বড় ভাইদের চাপে পারিবারিক খরচ নির্বাহের জন্যে কায়িক পরিশ্রমে বাধ্য হন।

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গমন ও প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ-

তিনি বাল্যকালে দুর্বল শরীরের অধিকারী হওয়ার কারণে সংসারের প্রতি অনাসক্ত ছিলেন। হতদারিদ্র পরিবারে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব ভেবে স্থানীয় এক মৌলভী সহযোগিতায় গোপনে ভারতের ত্রিপুরায় উদয়পুর গ্রামে চলে যান। তথায় এক মাদ্রাসায় জামাতে দাহুম পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ইতোমধ্যে পরিবারের লোকদের সাথে যোগাযোগ হলে তারা সকলে ভাগ্যন্বেষনে উদয়পুরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। এ সময় তাঁর বয়স ২০ এর উর্ধ্বে হওয়ায় পরিবারের লোকদের অনুরোধে স্থানীয় এক ধনাঢ্য ব্যক্তি হাজ্বী আবদুল গফুর সর্দারের অপ্রাপ্ত বয়স্কা মেয়ের সাথে তাঁকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়।

উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে মাতৃভূমি ত্যাগ-

বাল্য বিবাহসহ কর্মমুখী জীবনকে উপেক্ষা করে, দ্বীনি ইলম অর্জনের আকুল আগ্রহে জনৈক সাথীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি রিয়াছতে রামপুরে অবস্থিত মালাউল উলূম মাদরাসায় ভর্তি হন। এ মাদ্রাসায় তিনি একাধারে আলেম জমাত পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।

রামপুর আলিয়ায় অধ্যয়ন-

এ সময় ভারত উপমহাদেশে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে উলুম ও ফুনূনের অন্যতম বিদ্যাপীঠ রামপুর আলীয়া আল্লামা ফজলে ইমাম খায়রাবাদী, ফজলে হক খায়রাবাদী ও আবদুল হক খায়রাবাদীর মত বহু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। হাদীস, ফিকাহ, মানতিক, বালাগাত, তাছাউফ ও ইসলামী দর্শন প্রভৃতি শাস্ত্র চর্চায় রামপুর আলীয়ার যশ-খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সুতরাং এমন মাদ্রাসা হতে দ্বীনি ইলমের উচ্চ ডিগ্রী লাভের মানসে তিনি ফাজেল জমাতে ভর্তি হন। সৌভাগ্যক্রমে খতিবে আযম, বাহরুল উলূম শাহ অজিহুদ্দিন ছাহেব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর সান্নিধ্যে তিনি রামপুর আলীয়া হতে ফাজেল ও কামেল ক্লাশ সমাপ্ত করে সর্বশেষ সনদ লাভ করেন।

বাই’আত গ্ৰহণ-

খতিবে আযম একজন স্বনামধন্য মুহাদ্দিস হওয়ার সাথে সাথে তরিক্বায়ে কাদেরীয়া আলীয়া মুজাদ্দেদীয়ার একজন উচ্চাঙ্গের সূফী সাধক শায়খ ছিলেন। হুযূর মুহাদ্দিস ছাহেব কামেল ক্লাশে সিহাহ সিত্তাহ অধ্যয়ন কালে খতিবে আযম (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) হতে তরিক্বতের অজিফা আদায় করতে থাকেন। অল্পকালের মধ্যেই তিনি খতিবে আযম (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর অত্যন্ত স্নেহভাজন ছাত্র হিসেবে উক্ত তরিকায় বাইআত গ্রহণ করেন।

যেয়ারতে হারামাইন-

ইলমে শরীয়ত ও ইলমে মারেফাত হাসেল হওয়ার পর এবার স্বীয় মুর্শিদে কামেলের অনুমতিক্রমে ১৯৫৪ সালে বোম্বাই হয়ে পানির জাহাজে করে তিনি পবিত্র ভূমি মক্কায় গমন করেন। তথায় ৪ বছর কাল অবস্থান করেন। এ সময় তিনি জীবিকা নির্বাহের লক্ষ্যে একটি হাসপাতালে চাকুরী গ্রহণ করেন। সকালে ও বিকালে হেরেম শরীফে আগ্রহী ছাত্রদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। এ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলহাজ্ব আবদুর রউফ আমজাদ অন্যতম। বর্তমানে তিনি মক্কার অধিবাসী হিসেবে নিজ ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত করে একজন অভিজাত ব্যক্তির মর্যাদায় সমাসীন। তাঁরই বদান্যতায় হুযূর মুহাদ্দিস ছাহেব বাড়ীতে একটি মাদ্রাসা ও মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন।

দেশে প্রত্যাবর্তন ও ধর্মীয় শিক্ষাদানে আত্মনিয়োগ-

ইলম তলবের উদ্দেশ্যে বিদেশ গমন ও হজ্বব্রত পালনের দীর্ঘ ১৪/১৫ বছরের বৈরাগ্য জীবনে বাড়ীর সহিত হুযূরের কোন সম্পর্কই ছিলনা। বাড়ী আসার পূর্বক্ষণে তাঁর স্ত্রীকে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার সকল প্রস্তুতি শেষ হলে বর ও মেহমান যখন বাড়ীতে আসে ঠিক সে মুহূর্তে সংবাদ আসল যে আবদুল হামিদ ছাহেব মক্কা শরীফ হতে বাড়ীর উদ্দেশ্যে বোম্বাই এসে পৌঁছেছেন। খবর পেয়ে উপস্থিত বরযাত্রী মিলাদ মাহফিলের পর খাওয়া সেরে বিদায় নিয়ে গেলেন। পবিত্র মক্কা শরীফে হাসপাতালের চাকুরীতে যখন টাকা পয়সার প্রতি মোহ সৃষ্টি হতে থাকে তখনই একরাত্রে স্বীয় মুর্শিদে কামেল স্বপ্নে তাঁকে আদেশ দেন “আবদুল হামিদ, তুমি যে উদ্দেশ্যে দ্বীনি ইলম হাছেল করেছ, চাকুরীরত থাকলে তা ব্যাহত হবে।” কাজেই আর কালক্ষেপন না করে বোম্বাই ও রেয়াছতে রামপুর হয়ে তিনি আগরতলায় উদয়পুরের গঙ্গাচরে উপস্থিত হন। বিলম্ব না করে স্থানীয় এক মাদ্রাসায় সিনিয়র মুদাররিস হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তথায় শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন।

লাকসাম মামিশ্বর গ্রামে আগমন-

১৯৬৪ সালে দেশের রাজনৈতিক কারণে পার্বত্য ত্রিপুরা আগরতলা হতে হিজরত করে বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে স্ব-পরিবারে লাকসামের অদূরে মামিশ্বর গ্রামে একটি বিশাল জমিদার বাড়ীতে বসতি স্থাপন করেন। এ সময়ে লাকসামের নিকটবর্তী হাসানপুর মৌকরা আলীয়া মাদ্রাসায় টাইটেল ক্লাশের শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হন। অতঃপর হুযূর কেবলা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ১৯৬৮ সালে চাঁদপুর শাহতলী আলিয়া মাদরাসায় প্রধান মুহাদ্দিস পদে চাকুরী গ্রহণ করেন। শাহতলী আলীয়ার অধ্যক্ষ আল্লামা এ, কে, এম, রুহুল আমিন ছাহেবের সাথে আন্তরিকতা, আক্বীদা ও আদর্শিক মিল থাকায় দেওবন্দী আকায়েদ সম্পন্ন অধিকাংশ শিক্ষকদের প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে দীর্ঘ ১২ বছর তিনি শাহতলী আলীয়ায় স্ব-পদে বহাল ছিলেন। তবে মানসিকভাবে অত্যন্ত পীড়াগ্রস্থ হয়ে একঘরে জীবন যাপন করেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম, রামগড়ে স্থায়ীভাবে পুনঃবসতি স্থাপন-

হুযূরের পারিবারিক জীবন বৈচিত্রময়। অনেকটা আরবের বেদুঈন জীবনের সাথে সামঞ্জস্যপূণ্য। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস প্রথমে কুমিল্লা, পরে আগরতলা, তারপর লাকসাম, সর্বশেষ ১৯৬৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ির রামগড়ে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। এ রামগড়ের বাড়ীতেই স্বীয় প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা ও মসজিদের আঙ্গিনায় তিনি এখন চির নিদ্রায় শায়িত আছেন।

জামেয়ায় প্রধান মুহাদ্দিস হিসেবে আগমন-

মহান আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলামের সঠিক চেতনা এবং আউলিয়ায়ে কেরামের হাজারো স্মৃতিধন্য পূণ্যভূমি চট্টগ্রামের বুকে দ্বীন ও শরীয়তের জাহেরী জ্ঞান ও তরীক্বতের সুশোভিত আলোক রশ্মি ধারণ করে উপমহাদেশের স্বনামধন্য মহান দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া স্বীয় ঐতিহ্যে ভাস্বর। এর প্রতিষ্ঠাতা কুতুবুল আউলিয়া হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ ছিরিকোটি (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)। এ দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক তাঁরই যোগ্য উত্তরসুরী আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) এবং বর্তমান সাজ্জাদানশীন হুজুর কেবলা তাহের শাহ ছাহেব (মুদ্দাযিল্লুহুল আলী)। প্রতিষ্ঠানটির পরিচয় আজ কারো কাছে অজানা নয়। এ জামেয়ার তৎকালীন অধ্যক্ষ চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় আলেম, মুফতি আল্লামা মোজাফ্ফর আহমদ ছাহেব’র নির্দেশে আরবী সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব (মৌকরা) শাহতলী আলিয়ায় গিয়ে হুযূর মুহাদ্দেস আবদুল হামিদ ছাহেব কে ১৯৭৯ সালে অত্র জামেয়ার প্রধান মুহাদ্দিস পদে যোগদানের জন্য সাদর আমন্ত্রণ জানান। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মে তিনি জামেয়ার প্রধান মুহাদ্দিস পদে যোগদান করেন। উল্লেখ্য, এর পূর্বে এ পদে ফখরুল মুহাদ্দেসীন আল্লামা ফজলুল করীম নকশবন্দী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) কর্মরত ছিলেন। অতঃপর ১৯৯২ সালে সরকারি ভাবে অবসর গ্রহণ করার পরও জামেয়া কর্তৃপক্ষ তার যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং পাঠদানে বিশেষত্ব বিবেচনা করে শায়খুল হাদীস হিসেবে আমরণ খেদমত করার অনুরোধ করেন।

ফলশ্রুতিতে আরো ১০ বছর অর্থাৎ ২০০২ সাল পর্যন্ত শায়খুল হাদীসের পদে বহাল থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে স্বীয় দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষে বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০০২ সালে জামেয়া হতে বিদায় সংবর্ধনা গ্রহণ করেন।

ওফাত, দাফন ও জানাজা-

এ ধর্মপ্রাণ মনীষী প্রায় দু’বছর নিজ বাড়ী রামগড়ে অসুস্থ জীবন যাপন করেন। শেষ সময়ে সুচিকিৎসার আশায় কতিপয় ভক্ত-অনুরক্ত ছাত্র প্রথমে কুমিল্লা হাসপাতাল পরে ঢাকা হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। সর্বশেষ বারডেম হাসপাতালে স্থানান্তরিত হন। ডাক্তারদের পরামর্শে পরে বাড়ীতে নিয়ে আসা হয়। বাড়ীতে আনার এক সপ্তাহ পর ১৯শে শাওয়াল মোতাবেক ২১শে নভেম্বর ২০০৫ সাল রোজ সোমবার তিনি হাজার হাজার ছাত্র ভক্ত অনুরক্ত আত্মীয় স্বজনকে শোক সাগরে ভাসিয়ে পরলোকে প্রস্থান করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)

মৃত্যুকালে হুজুরের বয়স ছিল প্রায় ৮৭ বছর। ঐদিন দিবাগত রাত ৯টায় নিজ প্রতিষ্ঠান হাফেজীয়া হামেদীয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা এবং মসজিদ চত্বরে তাঁকে দাফন করা হয়। মৃত্যু সংবাদের সাথে সাথে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, লাকসাম প্রভৃতি এলাকা থেকে হুযূরের শত শত ভক্ত-অনুরক্ত মুরিদ, ছাত্র জানাযায় শরীক হন।

জানাযার নামাজ পড়ান হুযূরের অন্যতম পীরভাই কুমিল্লার মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ছাহেব। কাফন, দাফন ও জানাযায় প্রয়োজনীয় কাজে নেতৃত্বদেন হুযূরের অন্যতম ছাত্র জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার সাবেক প্রধান মুফতী ও অধ্যক্ষ আলহাজ্ব সৈয়্যদ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান ছাহেব।

সন্তান-সন্ততি

মৃত্যুকালে হুযূর ৪ কন্যা, দ্বিতীয় স্ত্রীসহ এক পুত্র রেখে যান।

মুহাদ্দিস ছাহেব এর তাকওয়া-পরহেজগারী

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত তাকওয়াবান, পরহেযগার ও খোদাভীরু। হালাল হারামে সতর্ক সর্বদা থাকতেন। সর্বোপরি ছাত্রদের পাঠদান, হাদীস কুরআন শিক্ষাদান, যিকির-ফিকরে মশগুল থাকতেন। মসজিদে গিয়ে জামাত সহকারে নামাজ আদায়ে অভ্যস্থ ছিলেন। অসুস্থকালীন সময়ে ও ছাত্রদেরকে নিজ কক্ষে ডেকে জামাতে নামাজ আদায় করতেন। এছাড়াও নিয়মিত অজিফা আওরাদ, বৃহস্পতিবারে বাদ আছর ছিলছিলার খতমে খাজেগান শরীফ ও নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। আমল-আখলাক স্বভাব চরিত্রের ক্ষেত্রে তিনি একজন আদর্শবান শিক্ষাগুরু ছিলেন। প্রাত্যহিক জীবনে প্রিয় নবীর প্রত্যেকটি সুন্নত অনুস্মরণে ছিলেন বিশেষ যত্নবান। হাদীস-কুরআন, ফিকাহ, উসুল, ফতোয়া ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শর্তারোপ করে কোন টাকা পয়সা কারো নিকট হতে গ্রহণ করেননি। তিনি ছিলেন অতি মিষ্টভাষী, সদালাপী ও বিনম্র চরিত্রের অধিকারী। নিজ রুমে জীবনে কাউকে কোন কটু কথা বলেননি। শেষ জীবনে প্রতিদিন বাদে আসর ছাত্রদেরকে ডেকে কুরআনের তাফছীর করতেন। রাত্রে নিয়মিত মজমুয়ায়ে ছালাওয়াতে রাসূল (সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শরীফ তেলাওয়াত করতেন। মকতুবাতে ইমাম রাব্বানী এবং মসনবী শরীফের বরাত দিয়ে অবসর সময়ে ছাত্রদেরকে নছিহত করতেন। ক্লাসের বাইরে এই গুলো তাঁর নিত্য দিনের আমল ছিল।

মাদ্রাসা-মসজিদ প্রতিষ্ঠা-

জামেয়ায় অধ্যাপনাকালীন সময়ে তিনি রামগড় গর্জনতলী গ্রামে স্বীয় বাড়ীর আঙ্গিনায় নিজস্ব জায়গায় হামিদীয়া হাফেজীয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা এবং একটি সুন্দর মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। যা বর্তমানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আদর্শালোকে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে।

সিলসিলায়ে হাদীসের সনদ-

তিনি কামেল পাশ ছাত্রদেরকে নিম্ন শাজরা মোতাবেক সনদ প্রদান করতেন। 

১। হযরত মাওলানা আবদুল হামিদ ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি।

২। মাওলানা হাফেজ শাহ ওয়াজিহদ্দিন আহমদ খান ছাহেব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)

৩| মাওলানা শাহ ওয়াজির মুহাম্মদ খান ছাহের মুহাদ্দিস রামপুরী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)

৪| হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ শাহ ছাহেব মুহাদ্দিস রামপুরী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)

৫। হযরত মাওলানা সৈয়দ হাসান শাহ ছাহেব মুহাদ্দিস রামপুরী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)

৬। হযরত মাওলানা শাহ সৈয়দ আলম আলী ছাহেব নাজীনবী মুহাদ্দিস মোরাদাবাদী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)

৭। হযরত মাওলানা শাহ মুহাম্মদ ইসহাক ছাহেব মুহাদ্দিস দেহলবী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)

৮। হযরত মাওলানা শাহ আবদুল আজিজ ছাহেব মুহাদ্দিস দেহলভী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)

৯। ছেরাজুল মুহাদ্দিসীন হযরত মাওলানা শাহ ওয়ালী উল্লাহ ছাহেব মুহাদ্দিস দেহলভী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)

এ ধারাবাহিকতা হাদীসের সিলসিলায়ে সনদ’র ছরওয়ারে কায়েনাত হুযূর রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত উপনীত।

তরীক্বতের সিলসিলার শাজরা-

তিনি কাদেরীয়া আলীয়া মুজাদ্দেদীয়া রামপুরের একজন বিশিষ্ট খলিফা ছিলেন। তবে কর্ম জীবনে তিনি দরসে হাদীস এবং ছাত্রদেরকে পড়ানোর উপরই গুরুত্ব দিতেন। মুরিদ হওয়ার ব্যাপারে কোনদিন কাউকে অনুপ্রাণিত করতেন না। বরং জামেয়া যেহেতু এক মহান অলির পৃষ্ঠপোষকতায় আছে তিনি সর্বদা তরিকায়ে কাদেরীয়া আলীয়া ছিরিকোটিকে একটি ক্ষমতাসম্পন্ন হক সিলসিলা হিসেবে এখানে দীক্ষিত হতে ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করতেন। গেয়ারভী শরীফ, খতমে গাউছিয়া শরীফ, কছিদা শরীফ, মজমুয়ায়ে ছলাওয়াতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মর্যাদার উপর আলোকপাত করতেন। মুহাদ্দিস ছাহেবের নিজস্ব ছিলছিলা ভুক্ত উর্ধ্বতন কয়েকজন শায়খ এর নাম নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হল।

১। হযরত মাওলানা আবদুল হামিদ ছাহেব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) (ওফাত ১৯শে শাওয়াল ১৪২৬ হিজরী)

২। বাহরুশ শরীয়ত ওয়াত তরিকত মোরশেদুল আফাক ছাহেবে এরশাদ হযরত মাওলানা হাফেজ শাহ ওয়াজিহুদ্দিন আহমদ খান ছাহেব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি), (ওফাত ২৮শে শাওয়াল ১৪০৭ হিজরী)

৩। কেবলায়ে আলম হযরত মাওলানা শাহ ওয়াজির মুহাম্মদ খান ছাহেব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি), (ওফাত ২রা শাওয়াল ১৩৪৩ হিজরী)

৪। ইমাম রাব্বানী মোজাদ্দেদে আলফেছানী হযরত শাইখ আহমদ ছারহিন্দী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি), (ওফাত ২৮শে সফর ১০৩৪ হিজরী)

৫। ইমামুত তরীকত ছায়্যিদিল আওলিয়া মাহবুবে ছোবহানী হযরত গাউছুল আজম শেখ মহিউদ্দিন সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) (ওফাত ১৭ই রবিউদ্ছানী ৫৬১ হিজরী)

ওফাতের তারিখের হিসাব আবজাদী সংখ্যায় عاشق كامل মানে ৫৬১ হিজরী।

 

তিন বছর পর কবরে অক্ষত লাশ মোবারক-

২০০৮ সালের ৪ জুলাই শুক্রবার রাতে মুষলধারে বৃষ্টিপাতেরর দরুন আল্লামা আব্দুল হামিদ (র.)’র কবরের মাটি পায়ের দিকে তলিয়ে যায়। তাঁর মাদরাসার ছাত্ররা প্রতিদিনের মতো মসজিদে ফজরের নামায শেষে যিয়ারত করতে হাজির হলে পায়ের দিকে মাটি সরে পড়া ও তলিয়ে যাওয়ার দিকটা কৌতুহলী হয়ে গভীরভাবে লক্ষ করলে ছাটায়ের ফাঁকে হুজুরের লাশ মোবারক সকলের দৃষ্টিগোচর হয়। তখন উপস্থিত উৎসুক জনতারা প্রত্যক্ষ করেন, হুজুরের লাশ মোবারক আপাদমস্তক অক্ষত, কাপনের কাপড়ও অবিকৃত, চেহেরা আলোকময় ও দাড়িগুলো কালো মনে হলো যেন সবেমাত্র দাফন করা হয়েছে। ঘটনাটি তাৎক্ষণিক টেলিফোনে জামেয়ার সম্মানিত শিক্ষকদের জানানো হয় এবং তাদের পরামর্শক্রমে ছাঁটাই পরিবর্তন করে পুনঃরায় কবর পূর্বাবস্থায় ঢেকে দেওয়া হয়। (বিষয় ভিত্তিক কারামতে আউলিয়া/পৃঃ৬৬)

লেখক- আরবী প্রভাষক, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া, চট্টগ্রাম।