ইসলামে নামায রোযার কাফফারা ও ফিদিয়ার বিধান

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

পবিত্র কুরআনের আলোকে কাফফারার বিধান:

রোযার কাফফারার বিধান যিহারের কাফফারার বিধানের মতই অভিন্ন। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনের ২৮ পারায় সূরা মুজাদালাহ ৪নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে, “কাফফারা হল একটি গোলাম আযাদ করা। সম্ভব না হলে একাধারে ষাট দিন রোযা রাখা, তাও সম্ভব না হলে ষাটজন মিসকীনকে দু’বেলা খাবার খাওয়াবে।” আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীর নুরুল ইরফান প্রণেতা হাকিমূল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী (র.) বলেন, ক্রীতদাস’র ক্ষেত্রে মু’মিন হওয়া শর্ত নয়। হানাফী মাযহাব অনুসারে কাফফারা আদায়ে মু’মিন বা কাফির ক্রীতদাস আযাদ করার অনুমতি রয়েছে।

কাফফারা ও ফিদিয়া অর্থ:

কাফফারা শব্দটি আরবি, আভিধানিক অর্থ: আবৃত করা, ঢেকে দেওয়া, আড়াল করা ইত্যাদি। শরয়ী পরিভাষায় নেক আমল দ্বারা পাপীর পাপ ঢেকে দেওয়াকে কাফফারা বলা হয়।

কাফফারা ও ফিদিয়া শব্দ দুটি পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে, ফিদিয়া অর্থ মুক্তিপণ, বিনিময় মূল্য, বিকল্প বা স্থলাভিষিক্ত। শরয়ী পরিভাষায় রোযা পালনে বা নামায আদায়ে অক্ষম ব্যক্তি নামায ও রোযার পরিবর্তে যে দান করেন তাকে ফিদিয়া বলে। পবিত্র কুরআনের ফিদিয়া সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আর যাদের মধ্যে এর (রোযা রাখার) শক্তি না থাকে তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে ফিদিয়া খাদ্য দান করবে। (সূরা: বাক্বারা, আয়াত: ১৮৪)

আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে নুরুল ইরফানে বলা হয়েছে, এতে বুঝানো হয়েছে যারা অতিশয় বৃদ্ধ অসুস্থ ভবিষ্যতেও রোযা রাখার সামর্থ আশা করা যায়না তাদের জন্য রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে। প্রত্যেক দিনের রোযার পরিবর্তে একজন মিসকীনকে ফিদিয়া হিসেবে দু’বেলা পেটভরে খাবার খাওয়াবে। বা ফিতরার সম পরিমাণ গম, যব, খেজুর বা নগদ অর্থ মিসকীনকে প্রদান করবে। ফিদিয়া আদায় করার পর রোযা আদায় করার মত সক্ষমতা এসে গেলে তখন রোযার কাযা আদায় করা ওয়াজিব। আদায়কৃত ফিদিয়া নফল সাদকা হিসেবে গণ্য হবে। (ফাতওয়ায়ে শামী, আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ১৬৫)

হাদীস শরীফের আলোকে কাফফারার বিধান:

হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রমজান মাসে রোযা ভঙ্গ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নির্দেশ দেন যে সে একটি ক্রীতদাস আযাদ করবে অথবা দু’মাস রোযা পালন করবে। ষাট জন মিসকীনকে খাবার খাওয়াবে। (মুসলিম শরীফ, ফিকহুস সুনানি ওয়াল আছার, পৃ: ৪৬৪)

মৃত ব্যক্তির নামায রোযার কাফফারা:

কোন পুরুষ বা মহিলার দায়িত্বে নামায রোযা অনাদায়ী থাকলে মৃত্যু আসন্ন অবস্থাতে অনাদায়ী নামায রোযার পরিবর্তে কাফফারা আদায় করার জন্য নিজ উত্তরাধিকার ওয়ারিশদেরকে অসিয়্যত করে যাওয়া ওয়াজিব। ওয়ারিশগণ মরহুম বা মরহুমার পরিত্যক্ত সম্পদের এক তৃতীয়াংশ হতে মৃত ব্যক্তির কাযা নামায ও কাযা রোযার কাফফারা প্রদান করবে। (আলমগীরি, ১ম খন্ড)

নামায রোযার ফিদিয়ার হিসাব:

মৃত ব্যক্তি কতদিন নামায পড়তে পারেননি তার হিসাব বের করুন। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ ও ওয়াজিব বিতরসহ দিনে ছয় ওয়াক্ত নামায হিসেব করুন। প্রতি ওয়াক্ত নামাযের জন্য অর্ধ সা গম (২কেজি ৫০ গ্রাম এক ফিতরা পরিমাণ সর্বসাকূল্যে ৭০ টাকা, একদিনে ৭০দ্ধ৬=৪২০/- একমাসে ৪২০দ্ধ৩০=১২৬০০/- একবৎসরে ১২৬০০দ্ধ১২=১,৫১,২০০/-) মৃত ব্যক্তির বয়স নির্ণয় করে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার বার বছর বাদ দিন। মহিলার ক্ষেত্রে নয় বছর বাদ দিন। অবশিষ্ট বছর গুলোর মধ্যে কত বছর নামায আদায় করেনি এর একটি হিসাব বের করুন। মৃত ব্যক্তি সম্পদ রেখে গেলে এক তৃতীয়াংশ সম্পদ থেকে ফিদিয়া আদায় করুন। এভাবে প্রত্যেক রোযার ফিদিয়াও অনুরূপ। (দুররুল মুখতার)

প্রত্যেক দিনের রোযার পরিবর্তে একজন মিসকীনকে দুবেলা পেটভরে আহার করাবে। বা সমপরিমাণ অর্থ মিসকীনকে প্রদান করবে। (বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ১৬৫)

মাসআলা:

মৃত ব্যক্তি যদি কাফফারা আদায়ের অসিয়ত না করেই মারা যায় বা অসিয়ত করে গেলেও যদি পরিত্যক্ত সম্পদ রেখে না যায় তখন ওয়ারিশদের উপর কাফফারা আদায় করা ওয়াজিব নয়। আর যদি অসিয়ত নাও করে যান কিন্তু সম্পদ রেখে যান তখন ওয়ারিশগন মৃত ব্যক্তির কাযা নামায ও কাযা রোযার ফিদিয়া আদায় করা উত্তম ও মৃত ব্যক্তির জন্য খুবই ফলপ্রসু উপকারী। (বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড)

কাফফারা ও ফিদিয়া আদায়ে ইসক্বাত পদ্ধতি:

ইসক্বাত অর্থ বাদ দেয়া বা ফেলে দেয়া, শরয়ী পরিভাষায় মৃত ব্যক্তির জিম্মায় ফরজ ওয়াজিব নামায রোযা অনাদায়ী থাকায় তাকে দায়মুক্ত করা বা তার পাপের বোঝা হালকা করার এক প্রকার সহযোগিতামূলক পন্থা বা ব্যবস্থার নাম হলো ইসক্বাত। নামায রোযার কাফফারা ও ফিদিয়া আদায়ের ক্ষেত্রে ইসক্বাত পদ্ধতি অবলম্বন শরীয়ত সম্মত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় মৃতব্যক্তি সম্পদ রেখে যাওয়ার পরও বা ওয়ারিশগণ আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকার পরও মৃত ব্যক্তির অনাদায়ী নামায রোযার কাফফারা ও ফিদিয়া হিসাব মোতাবেক সঠিকভাবে প্রদান করেন না। আবার অনেকে আছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ কাফফারা বা ফিদিয়া স্বরূপ প্রদান করার সামর্থ রাখেনা। তাই বিজ্ঞ ওলামায়ে কিরামগন ফিদিয়া আদায়ের ক্ষেত্রে একটি শরীয়ত সম্মত হিলা বা পন্থা উদ্ভাবন করেছেন তার নাম হলো ইসক্বাত। যেমন ৩০ দিনের নামাযের কাফফারা ফিদয়ার নিয়্যতে দৈনিক বিতরসহ ছয় ওয়াক্ত হিসেবে ৩০দিনে ১৮০ ওয়াক্ত, প্রতি ওয়াক্তের ফিদিয়া এক ফিতরা বা ৭০/- হিসেবে ১৮০৭০=১২৬০০/- কোন একজন ফকীর মিসকীনের মালিকায় দিয়ে দিবে।

এতে ৩০ দিনের ফিদিয়া আদায় হয়ে গেলো। ওই মিসকীন আবার তা মালিককে দান করবে। সে পুনরায় মিসকীনকে সাদকা করবে। প্রত্যেক বার আদান প্রদানে এক মাসের ফিদিয়া আদায় হয়ে যাবে। এভাবে ১২ বার আদান প্রদান করলে এক বছরের ফিদিয়া আদায় হয়ে যাবে। নামাযের ফিদিয়া আদায় করার পর একই পদ্ধতিতে রোযার ফিদিয়া আদায় করা যাবে। ধনী দরিদ্র সকলেই ফিদিয়া আদায়ে এ পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। এতে মৃত ব্যক্তি ফরযের বোঝা থেকে মুক্তি লাভ করবে ওয়ারিশগণও অধিক সওয়াবের ভাগী হবেন। [বিস্তারিত: আল ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবাআ, আল বাহছু ফী ইসক্বাতিস সালাতি অধ্যায়, খন্ড: ২য়, পৃ: ৫৪১, দুররুল মোখতার, বিস্তারিত ফাতওয়া রজভীয়্যাহ, ৮ম খন্ড, পৃ: ১৬৭, আহকামে শরীয়ত কৃত: ইমাম আহমদ রেযা (র.)]

এক ব্যক্তির নামায রোযা অন্যজন আদায় করার অনুমতি নেই:

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, একজনের পক্ষে অন্যজন রোযা রাখবেনা একজন অন্য জনের নামায আদায় করবে না। কিন্তু অন্যজনের পক্ষে (মিসকীনকে) খাবার খাওয়াবে। (নাসাঈ শরীফ)

ইবাদতের প্রকার:

ইবাদত তিন প্রকার:-
১. বদনী তথা শারীরিক ইবাদত, যেমন নামায, রোযা, যা একজনেরটি অন্যজন পালন করলে আদায় হবেনা।

২. মালি বা আর্থিক ইবাদত। যেমন: যাকাত সাদকা ইত্যাদি যা দাতার আদেশ বা অনুমতিক্রমে অন্যজন আদায় করতে পারে।

৩. শারীরিক ও আর্থিক উভয়টির সমষ্টি। যেমন হজ্ব পালনে কোন ব্যক্তি অক্ষম হলে তার পক্ষ থেকে অন্যজন পালন করা শরীয়ত সম্মত যেমন বদলী হজ্ব। (জাওয়াহেরুল ফিক্‌হ)

কাফফারা আদায়ে উদাসীনতা:

পবিত্র কুরআন আল্লাহর কালাম অমূল্য বানী। বর্তমান মুসলিম সমাজে প্রায়শ দেখা যায় মৃত ব্যক্তির জানাযার পর মসজিদের মুয়াজ্জিন বা কোন ফকীর মিসকীনকে একটি কুরআন শরীফের কপি কাফফারা বা ফিদিয়া স্বরূপ প্রদান করে থাকে। এ ভাবে ফিদিয়া আদায় হবে না বরং কুরআন মজীদের হাদীয়া যতটুকু ততটুকু ফিদিয়া আদায় হবে। অনেকে এ ভাবে নিজেদের সান্তনা দিয়ে থাকে আমরা মৃত ব্যক্তির সকল নামায রোযার ফিদিয়া আদায় করে দিয়েছি এটা তাদের ভুল ধারণা মাত্র। তবে লক্ষ্যণীয় হলো যারা ফিদিয়া বা কাফফারা সঠিক ভাবে আদায় করে না তারাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে কুলখানি উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে মেঝবানের আয়োজন করে থাকে। এতে সওয়াব হলেও এর দ্বারা ফিদিয়া বা কাফফারা আদায় না করার গুনাহ ক্ষমা হবে না।

আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে নামায রোযার কাফফারা ও ফিদিয়ার বিধান সঠিক ভাবে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম;
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

Related Articles

Back to top button
close