দৃঢ় ঐক্যের মজবুত উপলক্ষ পবিত্র হজ্ব

সাইফুল ইসলাম চৌধুরী

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রিয় বান্দা হতে ব্যক্তিজীবনে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমাবেশ ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। আর সে বিষয়গুলো হচ্ছে কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ ও যাকাত। প্রথম তিনটি এবং সামর্থবানের জন্য শেষ দুইটিসহ মোট পাঁচটি ভিত্তির পরিপূর্ণ পালনে একজন মানুষ ইনসানে কামেলে পরিনত হয়। আল্লাহ-রাসূলের প্রিয় পাত্র হয়ে দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতে মুক্তি নসিব হয়। এই পাঁচ ভিত্তির একটি হলো হজ্ব।

মুসলিম বিশ্বের সর্ববৃহৎ মহা-সম্মেলনের নাম হজ্ব। পবিত্র কাবাগৃহকে কেন্দ্র করে মহান প্রভুর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে বিশ্বের সুদূর প্রান্তসমূহ হতে সামর্থ্যবান মুসলমানগণ অন্তরভরা ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আবেগজড়িত চিত্তে মক্কায় হাজির হন এবং সম্পাদন করেন হজ্বের যাবতীয় কার্যাবলী। মূলত হজ্ব মুসলিম জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক ঐক্য ও পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব এবং মমত্ববোধের এক প্রকৃষ্ট নিদর্শন। হজ্ব শব্দটি আরবি। অর্থ- ইচ্ছা ও সংকল্প করা, সাক্ষাৎ করা। হজ্বের ইংরেজী প্রতিশব্দ হলো- To meet, To make decisions। মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কার্যাবলীর মাধ্যমে সম্মানিত বায়তুল্লাহ যেয়ারতের সংকল্প করার নামই হজ্ব।

সকল আলেম ও ফকিহগণের ঐক্যমত্যে আদায়, পদ্ধতি ও ফজিলতের দিক থেকে হজ্জ তিন প্রকার। যথা- হজ্জে ইফরাদ, তামাত্তু ও কেরান। মীকাত সমূহ হতে শুধু হজ্জের ইহরাম বেঁধে হজ্ব সম্পাদন করাকে হজ্বে ইফরাদ বলে আর প্রথমে ওমরার নিয়ত করে ওমরার কাজ সম্পাদন করে হালাল হয়ে ৮ জিলহজ্জ তারিখে হজ্বের নিয়ত করে হজ্বের কাজ সম্পাদক করাকে হজ্বে তামাত্তু বলে এবং মীকাত হতে হজ্ব ও ওমরার নিয়তে উভয়ের জন্য একসাথে ইহরাম বেঁধে হজ্বের কার্যাবলী সম্পাদন করাকে বলে হজ্বে তামাত্তু। ইমাম আবু হানিফার মতে হজ্বে কেরান, ইমাম শাফেয়ীর মতে হজ্বে ইফরাদ ও ইমাম আহমদের মতে হজ্বে তামাত্তু হলো সর্বোত্তম হজ্ব।

সামর্থবানদের ওপর সন্দেহাতীতভাবে জীবনে একবার হজ্ব ফরজ। হজ্বে গমনের জন্য হজ্ব পালনকারীদের কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে হয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আর্থিক এবং শারীরিক সামর্থ্য। নারীদের জন্য মাহরাম। ইসলামী সূত্রানুযায়ী আর্থিক এবং শারীরিক সামর্থ্য ছাড়াও নারীদের জন্য তৃতীয় একটি শর্ত উল্লেখ করা হয়, সেটি হলো হজ্বে যাওয়ার জন্য নারীকে স্বীয় স্বামী বা যার সঙ্গে ঐ মহিলার বিয়ের অনুমতি নেই, অর্থাৎ কখনো ঐ ব্যক্তির সঙ্গে ঐ মহিলার বিয়ে বৈধ হবে না, যেমন পিতা, ভ্রাতা, পুত্র, প্রমুখ কয়েকজন নির্দিষ্ট আত্মীয় পুরুষকে সঙ্গে নিতে হয়। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় মাহারাম। যাদের এরকম কেউ নেই তাদের হজ্বে যাওয়ার ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নেই। মাহারাম ব্যতীত হজ্বের জন্য নারীদের সৌদী আরবের ভিসা প্রদান করা হয় না। এক্ষেত্রে উল্লেখ রয়েছে যে, যদি মাহরাম ব্যতীত হজ্ব করতে যায় তাহলে হজ্ব হয়ে যাবে, কিন্তু মাহারাম ব্যতীত সফরের জন্য গুনাহগার বা পাপী হবে।

হজ্বকালীন সার্বিক অবস্থাকে বলা হয় ইহরাম যার প্রধান চিহ্ন হলো দুই খণ্ড সেলাইবিহীন সাদা কাপড় পরিধান। ইহরাম-এর নির্দ্দিষ্ট স্থানকে বলা হয় মিকাত । হজ্বের সময় তালবিয়াহ নামক দোয়া পাঠ করা হয়। লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা, লাব্বাইকা লা- শারীকা লাকা লাব্বাইকা। ইন্নাল হামদা ওয়ান নেয়ামাতা লাকা ওয়াল মুলকা লা-শারীকা লাকা । যার অর্থ হলো- হে আল্লাহ, আমি হাজির আছি, আমি হাজির আছি। আপনার কোনো শরীক নেই, আমি হাজির আছি। নিশ্চয় সকল প্রশংসা ও নেয়ামত আপনারই এবং সমগ্র বিশ্বজাহান আপনার। আপনার কোনো শরীক নেই।

হজ্বের মধ্যে মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিম জাতির জন্য ইহকালীন এবং পরকালীন জীবনে বিবিধ কল্যাণ রেখেছেন। ঘটিয়েছেন বিভিন্ন ধরনের ইবাদাত সমাবেশ। পবিত্র বাইতুল্লাহ’র দর্শন, তাওয়াফ, মাকামে ইব্রাহিমে নামাজ আদায়, দাঁড়িয়ে জমজমের পানি পান, সাফা-মারওয়া পাহাড়ে প্রদক্ষিণ, মিনায় অবস্থান ও নামাজ আদায়, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, হজ্বের খুতবা শ্রবণ, প্রাণ খুলে দোয়া, রাতে মুযদালিফায় অবস্থান, মিনায় কংকর নিক্ষেপ ও রাত্রিযাপন, তথায় পশু কুরবানী ও মাথা মুণ্ডনসহ আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে জন্য বেশি বেশি জিকির ও তাঁর দিকে ধাবিত হওয়াকে হজ্বের অনুষঙ্গ করলেও হজ্বের মাধ্যমে আরেকটি বে-মেসাল কল্যাণ ভোগ করেন মুসলিম বিশ্ব। আর তা হলো ইস্পাত-দৃঢ় ঐক্য। হজ্বে উঁচু-নিচু, কালো-সাদা ভেদাভেদহীন মিলনমেলায় যে অসাধারণ ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি হয় তা আর কোন উপলক্ষে হয় বলে আমার জ্ঞানে নেই।

মুসলিম ঐক্যের সূতিকাগার কাবাঘরে সর্বপ্রথম হজ্ব আদায়কারী হযরত আদম (আঃ)। তারপর নূহ (আঃ)-সহ অন্য অন্যান্য নবী-রাসূল যথাক্রমে এই দায়িত্ব পালন করেন। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ)’র সময় থেকেই হজ্ব ফরয বা আবশ্যকীয় ইবাদত হিসেবে বান্দার জন্য নির্ধারিত হয়। হিজরি সনের ১২তম মাস হলো জিলহজ্জ মাস। পাক কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী এই সময়ই আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-কে হজ্বের ঘোষণা দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন। স্রষ্টা থেকে আদিষ্টিত হয়ে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) আবু কোবাইস পাহাড়ে আরোহণ করে দুই কানে অঙ্গুল রেখে ডানে-বামে এবং পূর্ব-পশ্চিমে মুখ ফিরিয়ে ঘোষণা করেছিলেন: হে মানব সকল! তোমাদের পালনকর্তা নিজের গৃহ নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের ওপর এই গৃহের হজ্ব ফরজ করেছেন। তোমরা সবাই পালনকর্তার আদেশ পালন করো। এই বর্ণনায় আরো উল্লেখ আছে যে ইব্রাহিম (আঃ)’র ঘোষণা প্রভুর পক্ষ থেকে বিশ্বের সবখানে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। সুবহানাল্লাহ। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মানুষ (সকল)! নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করতে পারো। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাবান যে অধিক মুত্তাকি। আল্লাহ সবকিছু জানেন এবং সকল বিষয়ের খবরাখবর রাখেন। (সুরা আল-হিজরাত) এ আয়াতের মর্মার্থ থেকেই হজ্ব প্রবর্তনের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়।

সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও সমাদৃত হাদিস গ্রন্থ পবিত্র বুখারী শরীফে এসেছে- হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি এ ঘরের হজ্ব করল আর সে নির্লজ্জ কোনো কথা-বার্তা ও ফাসেকি কোনো কর্মে লিপ্ত হলো না, সে তার পাপ হতে ফিরে আসলো সেই দিনের ন্যায়; যে দিন তার মা তাকে জন্ম দিল। তিরমিজি শরিফের বর্ণনা- হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা হজ্ব এবং ওমরা পর্যায়ক্রমে করতে থাক। কারণ এদুথটি দারিদ্র্যতা দূর করে, পাপ মোচন করে। যেমনিভাবে কর্মকারের অগ্নিকুণ্ডু লোহা, সোনা ও রূপার মরিচা দূর করে দেয়। আর গৃহীত হজ্বের একমাত্র প্রতিদান হলো জান্নাত।

বিশ্বের দূর-দূরান্ত থেকে মুসলমানগণ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একই বাবা-মায়ের সন্তানের মতো সর্বাধিক প্রিয়স্থানে (পবিত্র নগরী মক্কায়) একত্রিত হতে আগমন করবে। যেখানে সবার মাঝে পারস্পরিক মিলন ঘটবে, একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হবে। তারা পরস্পর কল্যাণকর ও তাকওয়ার কাজে সহযোগিতার সুযোগ লাভ করবে। তাদের সবার কথা, কাজ ও জিকির আজকার হবে এক ও অভিন্ন। যা নিঃসন্দেহে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন জ্ঞানীরা।

ঐক্যের শক্তিশালী মাধ্যম হজ্বের ব্যাপারে মুহাম্মদ আলী বলেন- No other instruction in the world has the wonderful influence of the hajj in levelling all distinction of race, colour and rank.

বর্ণ বৈষম্য দূরীকরণ, সাম্যের বিকাশ সাধন, পারস্পরিক সম্প্রতি সৃষ্টি, পারস্পরিক কল্যাণ কামনা, শৃংখলবোধ জাগ্রতকরণ, বিশ্বভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি, বিশ্ব সম্মেলন, আন্তর্জাতিক ঐক্য সৃষ্টি, ভাবের আদান প্রদান, মৌলিক অধিকারের প্রতীক, দ্বীন কায়েমের দৃপ্ত শপথ গ্রহণে শক্তিশালী মাধ্যম, আল্লাহর খিলাফত প্রতিষ্ঠা, মতপার্থক্যের অবসান, ভৌগোলিক জ্ঞান অর্জন, সমকালীন বিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করাসহ মুসলিম বিশ্বের উন্নতি সাধনের এক মহাসুযোগ হলো পবিত্র হজ্ব। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক লেনারের চোখে হজ্ব-
The whole of humanity assumes one aspect and thus the noblest sign of equality and brotherhood is witnessed in Hajj.There is in his city a force which transcludes, the littleness and divisions of mankind.

প্রাবন্ধিক ও সংগঠক
খতিব ওসমান চৌধুরী জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম।

Related Articles

Back to top button
close