নেয়ামতের খুশবু

লেখিকা: রাহনুমা নাসরিন

দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর রোজাদারের জন্য ঈদ আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে। খুশির জোয়ার নিয়ে। পরম সুখ, অনাবিল শান্তি ও সম্প্রীতির পয়গাম নিয়ে। সেদিন, মদিনার ভূমিতে ছিলো ঈদের দিন। চারিদিকে আলোর ছড়াছড়ি। আয়োজনে আয়োজনে যেনো মুখরিত সবকিছু। মদিনার অলিতে গলিতে যেনো একফালি আনন্দের জোয়ার বইতে লাগল। সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আমোদে- আহ্লাদে ঈদ উদযাপন করছিলো। এমনসময়, হযরত আবু হোরায়রা (রা.) ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুক (রা.) এর ঘরে প্রবেশ করে দেখলেন, মুসলিম বিশ্বের রাজাধিরাজ সৈয়্যদুনা উমর ফারুক (রা.) কান্নাকাটি করছেন। ভাবুন তো এমন একটি খুশির দিনে উমর ফারুক (রা.) কান্নাকাটি করছেন। অবাক হওয়ার বিষয় না? স্বাভাবিকভাবেই, আবু হোরায়রা অবাক হলেন। তারপর, হযরত আবু হোরায়রা (রা.) ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আমিরুল মু’মিনিন! আজ তো ঈদের দিন। লোকেরা আনন্দোৎসবে মেতে আছে, অথচ আপনি ঘরে দরজা বন্ধ করে কান্নাকাটি করছেন। এর হেকমত কী?’ উমর ফারুক (রা.) জবাব দিলেন, ‘আনন্দিত লোকেরা যদি জানতো, তবে এমনটা করতো না’। এটা বলতে বলতে তিনি আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন এবং বলতে লাগলেন, “যদি তারা মকবুল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয় তবে খুশি হওয়া উচিত।আর যদি প্রত্যাখ্যাতদের অন্তর্ভুক্ত হয়,তবে ক্রন্দন করা উচিত। আবু হোরায়রা, আমি তো জানিনা আমি কি মকবুলদের অন্তর্ভুক্ত না প্রত্যাখ্যাতদের অন্তর্ভুক্ত?(তাই কাঁদছি)[আল্লাহু আকবার]

কে ছিলেন হযরত ওমর? মুসলিম সমাজে তাঁর পরিচিতি অনন্য। তিনি হলেন ফারুকে আজম। যার ইসলাম গ্রহণ মুসলিমদের মনে নব উদ্দীপনা সঞ্চার করেছিল। উচ্চস্বরে আযান হয়েছিল বায়তুল্লাহ শরীফে। কাফেরদের অন্তর কেঁপে উঠেছিল ভয়ে।ইসলামের জন্য যিনি তাঁর জীবন উজাড় করে দিয়েছেন। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী নবি করিম (দ) এরপর যদি কোন নবি আসতো তবে সে নবি হতেন উমর(রা)।যিনি তাঁর রাতকে অতিবাহিত করেছেন আল্লাহর ইবাদতে আর দিনকে মানবসেবায়। যিনি দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়ে আশারায়ে মুবাশশারার(জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন) অন্তর্ভুক্ত হন। যার জন্য জান্নাত ছিল অবধারিত। অথচ তারপরও সে জান্নাতের সুসংবাদকে পরোয়া না করে জান্নাতের মালিকের অসন্তুষ্টির ভয়ে ঈদের দিনে খুশি হতে পারেননি। বরং ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন বিগত এক মাসের ইবাদত আল্লাহর দরবারে ক্ববুল হয়েছে কী-না। আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট আছেন কী-না সে চিন্তায়!

অথচ আমরা প্রতিটা মুহূর্ত পাপের সাগরে ডুবে থেকে ভাবি যে আল্লাহ আমাদের অনায়াসে ক্ষমা করে দিয়েছেন। এমন ভাবে জীবনযাপন করি যেন মৃত্যু আমাদের কখনো পাকড়াও করতে পারবে না। রব্বে করিম চাইলেই সব কিছু করতে পারেন। শাস্তি দিতে পারেন। কিন্তু রব্বে করিম আমাদের প্রতি অতি দয়ালু। তাঁর হাবিবের কাছে তিনি ওয়াদাবদ্ধ। পূর্ববর্তী উম্মতদের মতো আমাদের ধ্বংস করে দিবেন না। তাই প্রতি বছর আমাদের গুনাহ মাফের জন্য নেয়ামত স্বরূপ দান করেন পবিত্র মাহে রমজান । যে মাসে বন্দি করে রাখেন অবাধ্য শয়তানকে। খুলে দেন জান্নাতের সকল দরজা। ঘোষণা করেন তাঁর ক্ষমা। একটি ছোট্ট আমলের নেকিকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। নিয়মমাফিক দিনের শুরু(সাহরি) ও শেষকে(ইফতার) করেন দোয়া ক্ববুলের মুহুর্ত দিয়ে। সারাদিন রোযা রাখার কারণে মুখের দূর্গন্ধকে ঘোষণা করে দেন ‘ওই দূর্গন্ধ মেশক্বের চেয়েও উত্তম’। রমজানের শেষ দশদিনে দিয়েছেন আত্মশুদ্ধি অর্জনের জন্য ইতেকাফের সুযোগ। ইতিকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো শবে কদর প্রাপ্তি; রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করলে শবে কদর প্রাপ্তি প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। ইতিকাফের মূল কথা হলো- সবকিছু ছেড়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাওয়া। সর্বোপরি তিনি এই রোযার পুরস্কার হিসেবে ঘোষণা করেছেন স্বয়ং নিজেকেই। আল্লাহ বলেন,রোযা আমার জন্য, আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব(হাদিসে কুদসী)। এটি এমন মাস যার সম্মানে আল্লাহ তা’আলা দীর্ঘ এক বছর যাবত জান্নাতকে সুসজ্জিত করে তোলেন।এ সম্মান দেখে জান্নাতের হুর পর্যন্ত রোযাদারদের স্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে বলে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে।(মিশকাত শরী৪,পৃষ্ঠা-১৭৪)

উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য সবচেয়ে খুশির সংবাদ, এ রমজানের অনন্য নেয়ামত হিসেবে নির্ধারণ করেছেন ক্বদরের মতো সর্বশ্রেষ্ঠ রজনীকে। লাইলাতুল কদর তথা সম্মানিত রাত। যার এক রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত হতে উত্তম।
তাইতো কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘কেন জাগাইলি তোরা’ কবিতায় লিখেন- ‘মাহে রমজান’ এসেছে যখন, আসিবে ‘শবে কদর’, নামিবে তাঁহার রহমত এই ধূলির ধরার পর। এই উপবাসী আত্মা – এই যে উপবাসী জনগণ, চিরকাল রোজা রাখিবে না – আসে শুভ ‘এফতার’ ক্ষণ!

আমি দেখিয়াছি – আসিছে তোদের উৎসব-ঈদ-চাঁদ, –
ওরে উপবাসী ডাক তাঁরে ডাক, তাঁর নাম লয়ে কাঁদ।

রমজান, ইতিকাফ, লাইলাতুল কদর, ঈদ-উল ফিতরে এত এত নেয়ামত দিয়েছেন আমাদের জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমরা সেসব নেয়ামত গ্রহণ না করে,পরবর্তী এগারো মাসে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার প্রস্তুতি না নিয়ে,পূর্বের গুনাহের জন্য ক্ষমা না চেয়ে ব্যস্ত থাকি ঈদের কেনাকাটা নিয়ে। একজন অভাগার তালিকায় নিজের নাম লিখি। আল্লাহর নেয়ামত থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে রাখি। প্রতি রাতে আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন আমাদের নেয়ামত প্রদানের জন্য। আর আমরা সময় কাটাই শপিং মলে। আল্লাহ ঘোষণা করেন তাঁর ক্ষমা। আর আমরা দিনের ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়ি বিছানায়। সারাদিন রোযা রাখার অজুহাতে ঘুমিয়ে কাটাই দিনের অধিকাংশ সময়। অথচ,এ মাস ঘুমিয়ে কাটানোর জন্য নয়। বরং সারা দিনরাত আল্লাহর রহমতের যে বারিধারা বর্ষিত হয় তা লুফে নেয়ার মাস। গরিবদের দুঃখ উপলব্ধি করার মাস। নিজের শরীরকে ক্ষুধার্ত রেখে নফসকে শক্তিশালী করার মাস। আর এত কষ্ট স্বীকার করে দীর্ঘ একমাস আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর বান্দারা রোযা পালন করে বিধায় শাওয়ালের ১ম রাতকে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন দোয়া ক্ববুলের পাঁচ রাতের এক রাত তথা ঈদের দিন হিসেবে। আর আমরা সেদিন অন্তরকে আল্লাহর নুরে না রাঙিয়ে ব্যস্ত থাকি মেহেদি দিয়ে হাত রাঙানোতে। অপেক্ষা করি টিভি প্রোগ্রাম দেখার।(নাউযুবিল্লাহ)

তাই সাহাবায়ে কেরাম এই দিনকে ঈদ তথা খুশির দিন বলেছেন তাদের জন্য যাদের ইবাদত আল্লাহর দরবারে ক্ববুল হয়েছে। অথচ আমরা সেদিন এমন ভাবে খুশি উদযাপন করি যেন আমাদের মুখ্য বিষয় হয়ে উঠে সুস্বাদু খাবার খাওয়া,অনৈসলামিক কার্যকলাপ ও আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠা, নতুন জামা কাপড় পরিধান করে পরপুরুষের সামনে নিজের সৌন্দর্য্য প্রদর্শন করা!(নাউযুবিল্লাহ)
মুহূর্তের মধ্যেই ভুলে যাই গত এক মাসের শিক্ষা। ব্যস্ত হয়ে পড়ি টিভি সিরিয়াল দেখতে!মগ্ন হয়ে যাই গল্প গুজব আর আড্ডায়!(নাউযুবিল্লাহ)

এমন বৈশিষ্ট্য কি শোভা পায় উম্মতে মুহাম্মদীর?যে নবি নিজে রমজান মাসের প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন রজব মাস থেকে। সে নবির উম্মত হয়ে আমরা রমজানের আগ থেকেই গ্রহণ করছি নতুন জামা,জুতা কেনার প্রস্তুতি! রজব মাস আসলেই নবিজি দোয়া করতেন,”আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজবাঁও ওয়া শা’বানা ওয়া বাল্লিগনা ইলা রমাদ্বান।”আর শাবান মাসে তিনি এত বেশি রোযা রাখতেন যে,মা আয়েশা (রা) বলেন,”আমি নবি করিম(দ) কে শাবান মাসের চেয়ে কোন মাসে বেশি রোযা রাখতে দেখিনি”(বুখারি শরিফ-১৮৪৪)। এ রোযা ছিল রমজানের প্রস্তুতি স্বরূপ। অতঃপর তিনি এভাবেই রমজান মাসে পৌঁছে যেতেন। আমরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ব্যস্ত হয়ে পড়ি দুনিয়ার প্রয়োজন মেটাতে। অথচ,রমজান মাস এত বেশি বরকতময় যে,এ মাসে নফল ইবাদত করলে অন্য মাসের ফরয ইবাদতের সমান এবং একটি ফরয ইবাদতে অন্য মাসের সত্তরটি ফরয আদায়ের সওয়াব পাওয়া যায়।(সুুবহানাল্লাহ) [বার মাসের আমল ও ফযিলত,পৃষ্ঠাঃ৪২৩]

তাই আমাদের উচিত এ মাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে যাবতীয় পাপাচার থেকে বিরত থেকে রজব মাস হতেই এর প্রস্তুতি গ্রহণ করা,নিয়মিত ফরয নামাজ আদায় করা,সাধ্যমত নফল ইবাদত করা (বিশেষত চাশত,ইশরাক,আওয়াবিন, হিফজুল ঈমান,কাশফুল আসরার ইত্যাদি),বেশি বেশি দান সদক্বা করা,প্রতিরাতে তারাবিহের নামাজ আদায করা,অধিক হারে যিকির ও দরূদ শরীফ পাঠ,কুরআন তিলাওয়াত করা, খতম আদায় এবং তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া,বিশেষত,ঈদের কেনাকাটায় অতিরিক্ত সময় ও শক্তি ব্যয় না করে স্বল্প সময়ে তা সম্পন্ন করা।পাশাপাশি গীবত,মিথ্যা,গালি দেয়া,অহেতুক কথা বলা,মোবাইলে বিনা প্রয়োজনে অযথা সময় নষ্ট করা,টিভিতে অপ্রয়োজনীয প্রোগ্রাম দেখা,অধিক হাসি তামাশা করা,অতিরিক্ত ঘুমানো প্রভৃতি কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা প্রতিটা মুহুর্তের হিসাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে এবং প্রতিটা কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।

যে ইবাদতই করিনা কেন, অবশ্যই প্রত্যেক ইবাদতের আগে নিয়্যত থাকতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং ইবাদতের শেষে থাকতে হবে আল্লাহর কাছে তা ক্ববুলের জন্য বিশেষ দোয়া।

পূর্ণ এক মাস এভাবে ইবাদত বন্দেগী আমাদের জন্য ট্রেনিং স্বরূপ। যার বাস্তবায়ন আমরা পরবর্তী ১১ মাসেও করতে পারবো। অবহেলায় রমজান মাস কাটানো, অনাহারে দিন কাটানোর সামিল।যার কোন প্রতিদান আল্লাহর কাছে পাওয়ার আশা করা যায় না এবং এ মাসকে অবহেলায় কাটিয়ে গুনাহের কাজে লিপ্ত থেকে এ বরকতময় মাস অতিবাহিত কারীর উপর ফেরেশতাদের অভিশাপ পতিত হয় বিধায় যাবতীয় খারাপ ও গর্হিত আচরণ থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। রমজান শেষে শাওয়াল মাস এবং পরবর্তী মাসগুলোও রমজানের মাসের ন্যায় কাটানো উচিত।রমজান শেষ হলেই যেন আমরা এর শিক্ষা ভুলে পাপে লিপ্ত না হয়ে পড়ি এবং রমজানে অর্জিত নেকি যেন হারিয়ে না ফেলি। বরং এর প্রভাব পরবর্তী রমজান পর্যন্ত জারি রাখার চেষ্টা করতে হবে। আল্লামা ইবনে নাবাতা(র) বলেন,হে মুসলিম ভাইগণ!তোমরা শাওয়াল মাসে রমজান মাসের ন্যায় আমল কর এবং রমজানে কৃত আমল সমূহ আল্লাহর দরবারে প্রত্যাখ্যাত হয় কিনা ভয় কর।(প্রাগুক্ত;পৃষ্ঠা-৪৮১)

তাই আসুন আজ হতেই আমরা প্রস্তুত হই। রমজান এবং রমজানের পরবর্তী সময়ের জন্য নিজেকে উত্তমরূপে পরিচালনা করি। কারণ, প্রস্তুতি যত কার্যকর ও উপযোগী হয়, কাজটি তত গোছালো ও সুন্দর হয়। ইবাদতের পূর্বে প্রস্তুতি গ্রহণ করা নবীজির সুন্নত। তাই নিজের গুনাহ মাফ করিয়ে নেয়ার জন্য প্রতিটা দিন প্রার্থনায় পার করার নিয়্যত করি।

মহামারি করোনার এ সময়ে আল্লাহ তাআলা বান্দার প্রতি তাঁর রহমত আরও বাড়িয়ে দেবেন, যদি বান্দা শুধু তাঁরই ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেকে একনিষ্ঠভাবে নিয়োজিত করে সুন্নাতের যথাযথ অনুসরণ করে। তখনই বান্দার রোজা ও রমজান হবে রহমতের বারিধারায় পরিপূর্ণ। এই মহামারীতে হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সকলকে ক্ষমা করে দেই। রবের কালাম কুরআন তিলাওয়াত ও দান সদক্বার সূচনা করি। যাকাতের মাল গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেই,যেন ঈদের আগেই তারা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতে পারে। এভাবেই প্র্যাকটিসের মাধ্যমে আমরা দ্বীনের খেদমতে নিজেকে শামিল রাখবো। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের নিয়্যতের সদক্বায় এবং রমজান মাসের ইবাদতের সদক্বায় ক্ষমা করুন, আপনার দরবারে ক্ববুল করুন এবং দান করুন আপনার প্রতিশ্রুত জান্নাত। আমীন।

Related Articles

Back to top button
close