যার জন্য বেহেশত অপেক্ষমাণ
লেখকঃ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম

বছর ঘুরে বেহেশতী সওগাত নিয়ে দ্বারে হাজির হল আত্মসংযম ও সিয়াম সাধনার মাস রমজানুল মুবারক। কোন মুসলমানকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কেন পড়েন? কেন এত কষ্ট স্বীকার করেন? তখন হয়তো উত্তর দিবেন, আল্লাহর আদেশ পালনার্থে অথবা কেউ বলবেন, বেহেশত পাওয়ার আশায়। কিন্তু একমাত্র বুদ্ধিমান ব্যক্তিই বলবে, আমার যাবতীয় ইবাদত – বন্দেগী এবং কষ্ট স্বীকারের পিছনে একটি মাত্র উদ্দেশ্য, আর তা হল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। কেননা, হাদীস শরীফে এসেছে- “যে ব্যক্তি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছে, তার জন্য সবই”। আর বেহেশত নিজেই ঐ সৌভাগ্যবান ব্যক্তিকে পাওয়ার আশায় মহান প্রভূর নিকট প্রার্থনা করতে থাকে। সেই বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের অন্যতম ঐ রোযাদার, যে রোযা রেখে স্বীয় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ হতে বিরত রাখে। যেহেতু শরীরের প্রত্যেক অঙ্গের সাথে রোযার সর্ম্পক রয়েছে।
মুখের রোয়া : রোযা অবস্থায় কোরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী সব প্রকার কথাবার্তা থেকে রসনাকে সংযত রেখে আল্লাহর যিকির-আযকার, দুরুদ-সালাম, কুরআন তেলাওয়াতে লিপ্ত থাকা। কারণ, মিথ্যা কথা, পরনিন্দা, মিথ্যা শপথ প্রভৃতি রোযাকে নষ্ট করে। হাদীস শরীফে এসেছে- একদা দু’জন রোযাদার রমণী ভীষণ পিপাসায় কাতর হয়ে মৃত্যুর শংকায় দরবারে রিসালতে রোযার ভঙ্গের অনুমতি প্রার্থনা করেছিল। নবীজি তাদের কাছে পানপাত্র প্রেরণ পূর্বক তথায় বমি করার নির্দেশ দিলেন। উভয়ের গলা থেকে জমাট রক্তপিন্ড বের হয়ে এল। এতে দর্শকগণ ভীত হয়ে কারণ জানতে চাইলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, মহান আল্লাহ যা হালাল করেছেন, তা দ্বারা তারা রোযা রেখেছিল কিন্তু যা হারাম করেছেন, তা দ্বারা রোযা ভঙ্গ করেছে। অর্থাৎ পরনিন্দায় লিপ্ত ছিল। তোমরা যে রক্তপিন্ড দেখছ তা মানুষের মাংস। অপরের নিন্দা করার ফলে ঐ নিন্দা তাদের জন্য মানুষের গোশত ভক্ষণ সদৃশ্য হয়েছে।
চোখের রোযা: রোযাদারের দৃষ্টি অসামাজিক ও অশ্লীল দৃশ্য দেখা থেকে বিরত থেকে সবর্দা ভাল ও বৈধ কাজ বা বস্তুর প্রতি দৃষ্টি রাখা। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- শয়তানের তীরগুলোর মধ্যে চোখের দৃষ্টি একটি মারাত্মক বিষাক্ত তীর। যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি দৃষ্টি দেয়া থেকে চোখের দৃষ্টি সংযত রাখে, তাকে ঈমানের এমন মাধুর্যপূর্ণ পোশাক পরিধান করানো হবে, যার মাধুর্য সে নিজ হৃদয়ে অনুভব করবে।
কানের রোযা : রোযাদার অবৈধ ও অশ্লীল কথাবার্তা শ্রবণ থেকে নিজেকে বিরত রাখা । কারণ, তা বলা যেমন অপরাধ, শ্রবণ করাও অপরাধ।
হাতের রোযা : রোযাদার স্বীয় হাত সর্বদা শরীয়ত সম্মত কর্মকান্ডে ব্যবহার করা এবং অবৈধ কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখা।
পায়ের রোযা : শরীয়ত বিরোধী কাজ তথা অশ্লীল ও পাপাচারে গমন থেকে বিরত থেকে পূণ্যময় কাজের প্রতি এগিয়ে আসা।
একজন প্রকৃত রোযাদার রোযা রাখার দরুণ তার থেকে পশুসুলভ স্বভাব লোপ পায় এবং ফেরেস্তা সুলভ স্বভাব প্রধান্য বিস্তার করে। এজন্য মহান রাব্বুল ইজ্জত হাদীসে কুদসীতে ইরশাদ করেন : “ রোযা আমার জন্য , আমি নিজেই তার প্রতিদান।” রোযা একটি ঢাল স্বরূপ। (সৈনিকের ডান হাতে থাকে তরবারী বা অস্ত্র আর বাম হাতে থাকে লোহার তৈরী ঢাল। ডান হাতের অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করে আর বাম হাতের ঢাল দিয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকায়। সৈনিক যেভাবে বাম হাতের ঢাল দিয়ে শত্রু পক্ষের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করে, ঠিক তেমনি রোযা দুনিয়াতে জ্বিন ও ইনসান শয়তানের প্ররোচনায় শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়া থেকে রোযাদারকে রক্ষা করে এবং পরকালে জাহান্নামের ভয়ানক আযাব থেকে রক্ষা করবে।)
আরো ইরশাদ হচ্ছে- যখন তোমাদের কারও জন্য রোযার দিন আসে, সে যেন কোন মন্দ বাক্য উচ্চারণ না করে এবং চিৎকার না করে। আর যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে ঝগড়া করে, তখন সে যেন বলে, “আমি রোযাদার”। আর নিশ্চয় রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মৃগনাভির সুগন্ধি অপেক্ষা উত্তম। রোযাদারের জন্য দু’টি আনন্দ রয়েছে, যা সে উপভোগ করে যখন সে ইফতার করে এবং যখন প্রভুর দীদার লাভ করবে। (সহিহ বুখারী; সহিহ মুসলিম, হাদীসে কুদসী, সংকলক:আল্লামা মুহাম্মদ মাদানী, ইফা, পৃ:১৩৫ ) আর যে ব্যক্তি শুধুমাত্র পানাহার, স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থেকে রোযা পালন করে, তার রোযা শুধু নিষ্প্রাণ দেহসদৃশ্য মৃত । হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- বহু রোযাদার আছে, শুধু ক্ষুধা-তৃষ্ণার ক্লেশ ভোগ বৈ কিছুই নয়। তাদের রোযা দ্বারা কোন উপকার আসে না। (সুনানে দারমী; মিমকাত,পৃ;১৭৭; ইমাম গাজ্জালী, কিমিয়ায়ে সাআদাত, খন্ড-১)
প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক ইবাদতই আল্লাহর জন্য। কিন্তু মহান আল্লাহর একমাত্র রোযারই প্রতিদান স্বীয় কুদরতি হস্ত মুবারকে দান করবেন। এর কারণ কী? এর কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বিজ্ঞ মুফাস্সিরগণ বলেন- প্রত্যেক ইবাতের মধ্যে লৌকিকতা রয়েছে, কিন্তু রোযার মধ্যে তা নেই। অন্যান্য সকল ইবাদত সর্ম্পকে মানুষ জানতে পারে, কিন্তু মানুষ যাকে রোযাদার বলে, সে প্রকৃতপক্ষে রোযা রেখেছে কিনা তা একমাত্র আল্লাহ ব্যতিত কেউ জানে না।
আল্লাহ যেমন পানাহার থেকে মুক্ত, ঠিক তেমনি রোযাদারও দিনের বেলায় পানাহার থেকে মুক্ত থাকে বিধায় , বান্দা কিছুক্ষণের জন্য আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হয়। এজন্য মহান আল্লাহ বলেন, রোযার প্রতিদান অন্য কিছু দিলে যথাযথ হবে না , এর একমাত্র প্রতিদান হচ্ছে আমি প্রভুর দীদার তথা দীদারে ইলাহী।
আর যখন রমজান মাসের প্রথম দিন আসে তখন আরশের নিচে জান্নাতের বৃক্ষের পাতায় পাতায় বেহেস্তের হুরদের উপর দিয়ে এক অপূর্ব রহমতের বাতাশ প্রবাহিত হয়। এ বাতাশ অনুভব করে তারা প্রার্থনা করে বলে হে প্রভু! আপনি আপনার রোযাদার বান্দদেরকে আমাদের স্বামী বানিয়ে দিন, যেন তাদের দ্বারা আমাদের চক্ষু শীতল হয় এবং তাদের চক্ষু আমাদের দ্বারা শীতল হয়। মহান আল্লাহর আহবায়ক জান্নাতের অধ্যক্ষ রিদুয়ানকে ডেকে বলেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের অন্তর্ভূক্ত রোযাদার ও ইবাদতকারীদের জন্য জান্নাতকে সজ্জিত করো। আর তাদের মাস অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত উহার দরজা বন্ধ করো না। অত:পর দ্বিতীয় দিন জাহান্নামের অধ্যক্ষ মালেককে ওহীর মাধ্যমে বলেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের অন্তর্ভূক্ত রোযাদার ও ইবাদতকারীদের জন্য দোযখগুলির দরজা বন্ধ করে দাও এবং তাদের এই মাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত উহা খুলিও না। তৃতীয় দিন জিবরাঈলকে বলা হয়, বিদ্রোহী শয়তান ও উদ্ধত জিনগুলিকে শিকলে বেঁধে রাখতে, যেন তারা আল্লাহর রোযাদার বান্দাদের রোযা নষ্ট করতে না পারে। আর যখন লাইলাতুল কদর আসে। পরদিন মহান আল্লাহ জিবরাঈল ও ফেরেস্তাদের বলেন, আমি তোমাদের সাক্ষী রাখছি, আমি নিশ্চয় রমজান মাসের রোযাদারদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি, শুধু সেই ব্যক্তি ব্যতীত যে মদ্যপানে আসক্ত, অন্যায়ভাবে কর আদায়কারী, জাদুকর, দাবা খেলোয়াড়, বংশীবাদক, পিতা-মাতার অবাধ্য।
মাহে রমজান ধৈয্য, সহনশীলতা ও রিয্ক বৃদ্ধির মাস। এ মাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন প্রত্যেক মুসলমানের উপর কর্তব্য। নবীজি ইরশাদ করেন- “যেই পর্যন্ত আমার উম্মত মাহে রমযানের ইজ্জত অক্ষুন্ন রাখবে, সেই পর্যন্ত তারা অপদস্থ হবে না।” যারা পার্থিব জগতে যথাযথ সম্মান করবে, কিয়ামত দিবসে এই রমযান তাদের হাত ধরে মহান আল্লাহর সামনে নিয়ে সম্মানের অপূর্ব মুকুট পরিধান করাবেন। এ মাসকে সম্মান প্রদর্শনের কারণে এক অগ্নিপুজারীর জান্নাত নসীব হয়েছে। বুখারা শহরে এক অগ্নিপুজারী বাস করত। একদিন অগ্নিপুজারী তার ছেলেকে নিয়ে রমযান মাসে মুসলমানদের বাজার দিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় তার ছেলে কোন খাবার বস্তু থাচ্ছিল। অগ্নিপুজারী এটি দেখে তার ছেলের গালে এক চড় দিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, মাহে রমজানে মুসলমাসদের বাজারে খেতে লজ্জাবোধ করা উচিত। ছেলে উত্তর দিল, আব্বাজান! আপনিও তো রমযান মাসে খাবার গ্রহন করেন। পিতা জবাবে বলল, আমি খাই ঠিক কিন্তু ঘরে, মানুষের সামনে খাইনা এবং এ মাসের সম্মান ও পবিত্রতা নষ্ট করি না। পরবর্তীতে ঐ ব্যক্তিটি যখন মারা গেল, জনৈক বুযর্গ ব্যক্তি স্বপ্নে ঐ লোকটিকে জান্নাতে দেখতে পেলেন। তিনি আশ্চর্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো অগ্নিপূজারী ছিলে জান্নাতে কিভাবে এসেছো? প্রতিত্তোরে সে বলল, বাস্তবিকই আমি অগ্নিপূজারী ছিলাম। কিন্তু যখন আমার মৃত্যু সন্নিকট হল তখন মাহে রমযানকে সম্মান করার কারণে মহান আল্লাহ আমাকে ঈমানী দৌলত দান করেছেন এবং রমযান শরীফের সম্মানের ফলশ্রুতিতে এই জান্নাত আমার আবাসস্থল হয়েছে । সত্যিই রমযানকে যে ইজ্জত করবে, সে অবশ্যই সৌভাগ্যবান, অসংখ্য নিয়ামতের অধিকারী হবে।
অতএব আসুন ! আমরা সকলে মাহে রমযানের সম্মানার্থে শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকি এবং দীদারে ইলাহীর উদ্দেশ্যে রোযা পালন করি। আল্লাহ সবাইকে তওফিক দান করুন, আমীন!
লেখক: আরবী প্রভাষক, রাণীরহাট আল আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদ্রাসা।