যেমন ছিল নবীজি মুহাম্মদ(সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’র রামাদ্বান দিনলিপি
লেখকঃ আহমদ শাহ আদীল

রামাদ্বান! অন্তর পরিশুদ্ধির মাস। রবের সাথে ভালোবাসা সৃষ্টির মাস। বর্তমানে এমন পবিত্র রামাদ্বান মাস আমাদের মাঝে চলমান। এটি ইসলামিক চন্দ্র মাসগুলোর মাঝে সবচেয়ে পবিত্র মাসগুলির একটি এবং এই মাসে মাসব্যাপী মুসলমানগণ একমাত্র স্বীয় রবের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাসব্রত পালন করে থাকেন। সারা বিশ্বের মুসলমানরা এই মাসটি উদযাপন করে অত্যন্ত ধর্মীয় উৎসাহের মাধ্যমে। এটি উদযাপন করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা এবং প্রস্তুতিও গ্রহণ করে বটে। এই মাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো দিনে রোজা, রাতে তারাবীর নামায এবং অতিরিক্ত কুরআন তেলাওয়াত এবং অতিরিক্ত (নফল) নামায আদায় করা।
>রামাদ্বানঃ
রোজা ও তারাবীহ নামায ছাড়াও রমজানের অসংখ্য কাজ রয়েছে যা একজন মুসলমান নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর সুন্নাহ থেকে গ্রহণ করতে পারে। যেভাবে তিনি রামাদ্বান উদযাপন করেছিলেন, যেভাবে তিনি রোজা রেখে ছিলেন, যেভাবে তিনি সালাতে দাঁড়িয়েছিলেন এবং যেভাবে তিনি রামাদ্বানের দিন ও রাত অতিবাহিত করেছিলেন, তা একজন মুসলমানের রামাদ্বানের দিনলিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত জরুরী। নিচের লাইনগুলোতে প্রথমে নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর হাদিসে মুবারকা থেকে রামাদ্বানের গুরুত্ব নিয়ে অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হবে এবং তারপর যেভাবে তিনি রামাদ্বান কাটিয়েছেন তা নিয়ে আলোচনায় হবে।
>রামাদ্বান এর গুরুত্বঃ
নবীজি মুহাম্মদ মোস্তাফা (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় রোজা রাখবে তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। (বুখারি শরিফ)
নবীজি মুহাম্মদ মোস্তাফা সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন, জান্নাতের মধ্যে একটি দরজা, যাকে রাইয়্যান বলা হয়, সেই দরজা দিয়ে কেবল মাত্র রোজাদারগণ প্রবেশ করবেন। (বুখারি ও মুসলিম শরিফ)
নবীজি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর হাদিস থেকে এটা স্পষ্ট যে, রামাদ্বান ক্ষমা ও রহমত এবং দয়ার মাস। যদি কেউ এই মাসটি আন্তরিকতার সাথে পালন করে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং তাঁর উপর রহমত নাযিল করবেন । সুতরাং আমাদের জন্য এটা অপরিহার্য, আমরা এই মাসটিকে প্রকৃত চেতনায় পালন করি এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছ থেকে করুণা ও ক্ষমার আশায় আমাদের বিশ্বাসকে বৃদ্ধি করবো।
>যেমন ছিল নবীজি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর রামাদ্বান দিনলিপিঃ
নবীজি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর বিভিন্ন কাজ ছিল যা রামাদ্বান মাসের জন্য নিদিষ্ট ছিল। এই কাজগুলির বেশিরভাগই বর্তমানে মুসলমানরা অনুশীলন করে, তবে অন্যান্য যেমন মিসওয়াক করা ইত্যাদি রয়েছে যা মুসলমানরা এখনো অনুশীলন করে কিন্তু একই ফ্রিকোয়েন্সিতে নয়। রামাদ্বান মাস সম্পর্কিত নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)এর কিছু অধিক আমলকৃত আমল নিয়ে নীচে আলোচনা করা হলো।
>কুরআন পাঠঃ
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) নিজেও রামাদ্বান মাসে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করতেন, কুরআন শরিফ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করতেন। এমনকি প্রতিবছর মাহে রামাদ্বানে ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) বারবার রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে আল-কুরআন পুনরাবৃত্তি করতেন।
এ সম্পর্কে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে, তিনি বলেছেন, ‘রামাদ্বান মাসের প্রতি রাতে ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর খেদমতে হাজির হতেন এবং তাঁরা উভয়ই কুরআন তিলাওয়াত করে একে অপরকে শোনাতেন।’ (বুখারি শরিফ)
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) তাঁর উম্মতদের রামাদ্বান মাসে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াতের দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। উল্লেখিত হাদিস শরিফ থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কুরআন সাধারণ ভাবে পাঠ করার পাশাপাশি এর প্রতি আয়াতের অর্থ বুঝে তা জীবনে বাস্তবায়ন করা নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর সুন্নাহ, যা তিনি রামাদ্বান মাসে অনুশীলন করতেন। অতএব, মুসলিম হিসেবে আমাদেরও কুরআন কে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন চেষ্টা করতে হবে এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের জন্য এতে যে বার্তা রেখেছেন তা নিয়ে চিন্তা ফিকির করতে হবে।
তারাবীহঃ
‘তারাবিহ’ শব্দটির মূল ধাতু ‘রাহাতুন’ অর্থ আরাম বা বিশ্রাম করা। বিশেষ করে প্রতি চার রাকাত পর একটু বসে বিশ্রাম করতে হয় এবং দোয়া ও তসবিহ পাঠ করতে হয়। এ জন্য এই নামাজকে ‘সালাতুত তারাবিহ’ বা তারাবি নামাজ বলা হয়। তারাবি বিশ রাকাত সুন্নাত। এটা রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম), সাহাবী, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন এবং মুজতাহিদ ইমামগণের আমল দ্বারা প্রমাণিত।
প্রিয় নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করেছেন, আর আমি তোমাদের জন্য তারাবির নামাজকে সুন্নত করেছি; যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রামাদ্বানে দিনে রোজা পালন করবে ও রাতে তারাবির নামাজ আদায় করবে, সে গুনাহ থেকে এরূপ পবিত্র হবে যে রূপ নবজাতক শিশু মাতৃগর্ভ থেকে নিষ্পাপ অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়।’ (নাসায়ী শরিফ)
রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) তারাবিকে কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তারাবি যেন ফরজ না হয়ে যায়, যেটা আদায়ে উম্মতের কষ্ট হতে পারে, সেটা রাসুল (সা:) এর একটি হাদিসে থেকেই বোঝা যায়।
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) একবার রামাদ্বান মাসে রাত্রিবেলায় মসজিদে নববীতে নামাজ (তারাবি) আদায় করলেন। উপস্থিত লোকজনও তার সঙ্গে নামাজ আদায় করলেন। একইভাবে তারা দ্বিতীয় দিনেও নামাজ আদায় করলেন এবং লোকসংখ্যা অনেক বেশি হলো। অতঃপর তৃতীয় এবং চতুর্থ দিনেও মানুষ একত্রিত হলো। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) হুজরা থেকে বেরিয়ে তাদের কাছে এলেন না। অতঃপর সকাল হলে তিনি এলেন এবং বললেন, তোমাদের অপেক্ষা করার বিষয়টি আমি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু শুধু এ ভয়ে আমি তোমাদের নিকট আসা থেকে বিরত থেকেছি যে, আমার আশঙ্কা হচ্ছিল, না জানি তোমাদের ওপর উহা (তারাবি) ফরজ করে দেওয়া হয়। (বুখারি শরিফ)
অতএব, আমাদের মুসলমানদের জন্য নবীজি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর এই কাজের অনুসরণ-অনুকরণ করার চেষ্টা করা এবং রামাদ্বানের মাস জুড়ে রাতে তারাবির নামায আদায় করা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি।
>রামাদ্বানের মহিমান্বিত রাতঃ
রামাদ্বানের শেষ দশ দিনের রাতের মধ্যে এমন একটি বিশেষ রাত যেখানে পুণ্যকর্ম ও রহমতের পুরস্কার আগের চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায় এবং আল্লাহ এই রাতে যারা নামায বা ইবাদতে মগ্ন থাকে তাদের উপর তাঁর বিশেষ রহমত প্রেরণ করেন।
عَنْ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ “ تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ ”
মা আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা রামাদ্বানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদরের সন্ধান কর।(বুখারি শরিফ)
নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদ্বানে শেষ দশ দিনে একটি বিশেষ রুটিন অনুসরণ করতেন, যা হযরত মা আয়শা (রাঃ) নিম্নলিখিত ভাবে বর্ণনা করেছেন:
عَنْ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ قَالَتْ كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ، وَأَحْيَا لَيْلَهُ، وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ.
‘হযরত আয়শা (রাদ্বিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রামাদ্বান শেষ দশক আসত তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশী বেশী ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত্রে জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। (বুখারি শরিফ)
অতএব, রামাদ্বানের প্রতি রাতে প্রার্থনা করার পাশাপাশি, আমাদের মুসলমানদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে রামাদ্বানের শেষ দশ দিনে আমরা প্রার্থনার ফ্রিকোয়েন্সি বা পরিমাণ বৃদ্ধি করা।
>ইতেকাফঃ
রামাদ্বান মাসের জন্য নির্দিষ্ট নবী মুহাম্মদ (সা.) এর আরেকটি মহান সুন্নাহ হল ইতেকাফ এর সুন্নাহ।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَعْتَكِفُ فِي كُلِّ رَمَضَانَ عَشْرَةَ أَيَّامٍ، فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الَّذِي قُبِضَ فِيهِ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ يَوْمًا
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রামাদ্বানে দশ দিনের ইতিকাফ করতেন। যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন সে বছর তিনি বিশ দিনের ইতিকাফ করেছিলেন। (বুখারি শরিফ)
সুতরাং, মুসলমানদেরও অবশ্যই নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর এই সুন্নাহ পালনের চেষ্টা করতে হবে এবং এই জগতের ব্যস্ত জীবন থেকে সময় বের করে সর্বশক্তিমান আল্লাহ’র জন্য কিছু সময় উৎসর্গ করতে হবে।
>সাদকাহঃ
নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) অধিকহারে দরিদ্র ও অভাবী কে সাদকাহ ও যাকাত প্রদান করতেন।
রাসুলে করিম (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন, তোমরা খেজুরের সামান্য অংশ সদকা করে হলেও নিজেদের জাহান্নাম থেকে রক্ষা করো। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
ইবনে আব্বাস (রাঃ) এক হাদিসে বলেনঃ রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মাঝে সর্বাধিক দানশীল। রামাদ্বানে তিনি সর্বাধিক দানশীল হতেন, যখন জিবরাইল এর সাথে সাক্ষাত হত। রামাদ্বানে জিবরাইল তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন এবং তাঁর সাথে কুরআন পাঠ করতেন। জিবরাইল (আঃ) এর সাক্ষাতকালীন রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতেন মুক্ত বায়ুর তুলনায় অধিক কল্যাণময় দানশীল। (বুখারি শরিফ)
অতএব বুঝা যায়, রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদ্বানে অধিক সৎকাজ করতেন এবং বিপুল পরিমাণে সাদকাহ করতেন। তাই তাঁর উম্মাহ হিসেবে আমাদের প্রত্যেককে অবশ্যই উক্ত আমলের অনুসরণ করতে হবে।
ছাত্র- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়