সুড়ঙ্গের শেষ ক্ষণে
শায়খ সৈয়দ আহমদ শাহ (হাফিযাহুল্লাহ)

কোনো এক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে একদিন এক কাফেলা সফরে বের হলো। তারা যেতে যেতে হঠাৎ চলে আসলো একটি গুহার সামনে। সফর থেমে গেল। সামনে তাদের বাধা হলো অন্ধকার এই সুড়ঙ্গ পথ। তারা ভাবতে লাগলেন এখন কী করা যায়? গন্তব্যে তো তাদের পৌঁছাতেই হবে। গুহার ভেতরে দিয়ে সুড়ঙ্গ ধরে যাওয়া ছাড়া অন্যকোনো রাস্তাও তাদের ছিল না। তাই, তারা সবাই ঐ অন্ধকার গুহার ভেতরে প্রবেশ করলেন। এই অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভতরে দিয়ে কিছুদূর যেতেই তাদের পায়ে কিছু একটা অনুভব হতে লাগল। শক্ত কোনো এক বস্তুর খোঁচার মতো এই অনুভূতি। তারা পরে বুঝতে পারলেন যে, এগুলো হয়তো পাথরের টুকরো। এমন সময়, কাফেলার কিছু লোক ভাবলেন—
পাথরের টুকরাগুলোর ফলে আমাদের পায়ে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে। আমাদের উচিত হবে এই কাঁকরগুলো আমরা তুলে ফেলি। যাতে আমাদের পরবর্তী কোনো কাফেলা এই পথ দিয়ে আসলে কোনো রকম ব্যাথা অনুভব না করে। তারা যেন, শান্তিতে গুহার এই অন্ধকার সুড়ঙ্গটি অতিক্রম করে ফেলতে পারে।
এই ভাবনায় তারা কাঁকরগুলোর মধ্য থেকে আল্প কিছু তাদের থলেতে তুলে নিয়ে রাস্তা কিছুটা পরিষ্কার করে ফেললেন। এই সময় কাফেলারই আর কিছু লোক ভাবতে লাগলেন—
আরে, আমরা যেভাবে পার হয়ে যাচ্ছি, পরবর্তীরাও কাঁকরের খোঁচা সহ্য করে সেভাবে পার হয়ে যাবে। এই গুলো তুলে নিয়ে থলেগুলো ভারি করে কি লাভ!
অতএব, তারা কাঁকরগুলো আর তুলেন নি।
সুড়ঙ্গটি ছিল অনেক লম্বা। এই বিশাল অন্ধকার সুড়ঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে অনেক্ষণ পর অবশেষে গুহার পথ শেষ হলো। যারা কাঁকরগুলো তুলে নিয়েছিলেন তারা তা ফেলে দিয়ে থলে হালকা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। থলেতে হাত দিয়ে কাঁকরগুলো বের করতেই সকলের চোখ স্থির হয়ে গেল। সবাই অবাক হয়ে রইলেন। অন্ধকারে যেগুলোকে তারা পাথরে টুকরা মনে করেছিলেন, সেগুলো আসলে এক একটি মূল্যবান হীরা।
এই সময়, যারা সামান্য কাঁকর মনে করে সেগুলোকে তুলেননি, তারা মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। সূর্যের আলোতে জ্বল জ্বল করতে থাকা সেই হীরার টুকরাগুলো দেখে তারা আফসোস করতে লাগলেন। আবার যারা সেগুলো তুলে নিয়েছিলেন, তারাও আফসোস করতে লাগলেন।
যারা তুলেননি তারা আফসোস করে বলছিলেন— হায় আমাদের দূর্ভাগ্য, আমরাও যদি ভালো নিয়্যতে সেই পাথরের টুকরাগুলো তুলে নিতাম, তাহলে এই সফরে অর্থের যোগানে এগুলো ব্যবহার করতে পারতাম! আমাদের জন্য সফরটা কতই না সহজ হয়ে যেত।
আর যারা পাথরের টুকরাগুলো তুলে নিয়েছিলেন। তারা বলতে লাগলেন— হায় আমাদের দূর্ভাগ্য, যদি আমরা জানতে পারতাম যে, এগুলো কোনো কাঁকর নয় বরং হীরার এক একটি টুকরা, তাহলে আমরা আরো বেশি বেশি করে তুলে নিতাম! যার ফলে, কেবল এই সফরেই না, জীবনের পরবর্তী সময়গুলোতেও এগুলো ব্যবহার করতে পারতাম।
ভাইয়েরা আমার,
রমজানুল মুবারকের এই বরকতমণ্ডিত সময়ের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারবো যে, আমরাও এমনই একটা সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যেই সুড়ঙ্গের সবদিকে থাকা প্রত্যেকটি মূহুর্ত এক একটা অতি মূল্যবান হীরা-মুক্তা। এগুলোর মূল্য সমন্ধে আমাদের কোনো ধারনাই নেই। এগুলো এতটাই মূল্যবান যে, এর আন্দাজ করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব না। কখনো এগুলো নামাযের সুরতে, কখনো কুরআন পাক তিলাওয়াতের মাধ্যমে অথবা কখনো রোজার মাধ্যমে আমাদের সামনে আসে।
আমরা এই মুহূর্তে ‘রমজান’ নামক সেই সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছি। আমাদের আশে-পাশেও অসংখ্য মনি-মুক্তা ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে। এটাই সুযোগ এই মূল্যবান মনি-মুক্তগুলো তুলে নেওয়ার।
রমজানুল মুবারক সমন্ধে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, “রোজা আমারই জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দিব।” অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, “এই রোজা আমার জন্য, আর আমিই তার প্রতিদান।”
কাল পরশুতো এই রমজানুল মুবারক শেষ হয়ে যাবে। এই জীবনও একদিন শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু কেয়ামতের দিন যখন আমরা বাস্তবিকভাবে জানতে পারবো যে, রমজানের মূল্যতো এমনই। প্রতিদানতো এটাই। তখন, আমাদের মধ্যে যারা এই রমজানকে মূল্যায়ন করি নি, এই রমজান থেকে ফায়দা হাসিল করিনি, তারা আফসোস করে বলবো— হায়, কতই না উত্তম হত যদি আমরা রমজানে ইবাদত করতাম, আল্লাহ তায়ালা’র নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করতাম, তাহলে আজ আমরাও ততটুকু সম্মান পেতাম, যতটুকু রোজাদারগণ পাচ্ছেন।
আর আমাদের মধ্যে যারা এই রমজানুল মুবারককে মূল্যায়ন করেছে তারাও আফসোস করে বলবে— হায়, জীবিত থাকতে রমজানুল মুবারকের যে সময়গুলো আমরা কোনো ইবাদত করা ছাড়া পার করেছি, সময় থাকা স্বত্বেও আল্লাহ তায়ালা’র জিকির ব্যতিত অতিবাহিত করেছি, কোথাও খোশ-গল্পে সময় কাটিয়েছি, সেই সময়গুলোকেও যদি আমরা গুরুত্ব দিতাম, কিছুটা নেকির কাজ করতাম, কুরআনে পাকের তেলাওয়াত করে নিতাম, আল্লাহ পাকের জিকির করতাম, আমার রব্বুল ইজ্জতকে রাজি করার জন্য কোনো অসহায় ব্যক্তির সাহায্যে নিয়জিত হতে পারতাম, তাহলে আমরাও সেই সম্মান পেতাম, যা সঠিকভাবে রমজানুল কারিমকে মূল্যায়নকারীরা পাচ্ছে।
আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতায়ালা আমাদেরকে সুযোগ দিয়েছেন, আমাদেরকে প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, রমজানুল মুবারকের গুরুত্ব কতটুকু, এর মূল্য কেমন। জানিয়ে দিয়েছেন এর প্রতিদান সম্পর্কেও। তো রমজানুল মুবারকের যেই অল্প কিছু সময় আমাদের হাতে আছে, সেগুলোকে যদি সঠিকভাবে আল্লাহ তায়ালার রেজামন্দির জন্য ব্যবহার করতে পারি তাহলে, আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই আমাদেরকে এই কাজের প্রতিদান দিবেন। অবশ্যই রমজানুল মুবারকের যে প্রতিদানের কথা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তিনি তা থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করবেন না।
শেষ হতে যাওয়া এই রমজানুল মুবারককে আল্লাহ তায়ালা আমাদের দুনিয়া এবং আখিরাতের জন্য সাফল্যের মাধ্যম বানিয় দিন। তাঁর রেজামন্দি আমাদের দান করুন এবং তাঁর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সঙ্গ আমাদের দান করুন। কেয়ামতের দিন তাঁর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র শাফায়াত আমাদের নসিব করুন। আ-মি-ন।
শায়খ সৈয়দ আহমদ শাহ হাফিযাহুল্লাহ। শাহাজাদা, দরবারে আলিয়া কাদেরিয়া, শেতালু শরীফ।
শ্রুতিলিখনঃ আসিফ উল আলম