ইমামে আহলে সুন্নত সৈয়দ আজিজুল হক শেরে বাংলা (রহ.)’র জীবনবৃত্তান্ত
আহমদ শাহ আদীল
মোজাদ্দীদে দ্বীন ও মিল্লাত, ইমামে আহলে সুন্নাত, আল্লামা গাজী সৈয়দ মুহাম্মদ আজিজুল হক শেরে বাংলা (রহ.)’র সংক্ষিপ্ত জীবনী
জম্ম ও বংশ পরিচয়
বার আউলিয়ার স্মৃতি বিজড়িত চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার অন্তর্গত মেখল নামক গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারে ১৩২৩ হিজরী, ১৩১৩ বঙ্গাব্দ এবং ১৯০৬ ইংরেজীতে কোন এক শুভ মুহূর্তে মোজাদ্দেদে দ্বীন ও মিল্লাত, ইমামে আহলে সুন্নাত, আল্লামা গাজী সৈয়দ মুহাম্মদ আজিজুল হক শেরে বাংলা (রহ.) জম্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতার নাম হযরত মাওলানা শাহসূফী সৈয়দ আব্দুল হামিদ আলকাদেরী (রহ.) এবং মাতার নাম সৈয়দা মায়মুনা খাতুন। তার দাদার নাম সৈয়দ মুহাম্মদ হাশমত উল্লাহ। তিনি পিতা-মাতা উভয় বংশধারায় সৈয়দ বংশীয় ছিলেন।
শিক্ষাজীবন
শেরে বাংলা (রহ.) বাল্যকাল থেকেই অতি মেধাবী ও সৎ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। শৈশবকালে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা আপন পিতার নিকট লাভ করেন অতঃপর তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসা-এ-মুঈনুল ইসলামে ভর্তি হন। ঐ মাদ্রাসা দেওবন্দী কওমি নিয়ন্ত্রিত হলেও তৎকালে কয়েকজন সুন্নী আক্বীদার আলেমও সেখানে শিক্ষকতা করতেন। উক্ত মাদ্রাসায় অধ্যয়ন কালে দেওয়ান নগর নিবাসী প্রখ্যাত আলেম হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল জলিল (রহ.) কে প্রিয় শিক্ষক হিসেবে লাভ করেছিলেন। অতঃপর তিনি উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য হিন্দুস্থানে গমন করেন। দিল্লীর বিখ্যাত ফতেহপুর আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে আরবি, উর্দু, ফার্সি ভাষার লিখিত বিভিন্ন শাস্ত্রে উপর অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও বুৎপত্তি অর্জন করেন। উক্ত মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল শেরে বাংলা (রহ.) এর মেধাশক্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁর খরচ বহন করার ঘোষণা দেন। অতঃপর হিন্দুস্থান থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে ইসলামের প্রকৃত আদর্শ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের খেদমতে নিয়োজিত হন। একই মাদ্রাসা থেকে তিনি দাওরায়ে হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীর সনদ লাভ করেন। এছাড়া তিনি ইলমে লাদুন্নী দ্বারাও সমৃদ্ধ ছিলেন।তিনি হাটহাজারী এমদাদুল উলুম আজিজিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা ও রাউজান, রাঙ্গুনিয়া সহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় অনেক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
সামাজিক ও রাজনৈতিক অবদান
সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও আল্লামা গাজী শেরে বাংলা (রহ.) এর অবদান ছিল অপরিসীম। তিনি তদানীন্তন বৃটিশ আমল হতে পাক-ভারত বিভক্তির পর প্রথম পাক ভারত মহাযুদ্ধের সময় পর্যন্ত একাধারে সুদীর্ঘ সতেরো বৎসর নিজ এলাকা মেখল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও তৎকালীন ফুড কমিটির প্রেসিডেন্ট পদ অলংকৃত করেন। এমনকি চেয়ারম্যান ইলেকশনের পূর্বে মুফতি ফয়জুল্লাহ তার অনুসারীদের উদ্দেশ্য বলে, “তোমরা শেরে বাংলাকে ভোট দেবে” তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে উত্তর দেয়, শেরে বাংলার সাথে আমার যে বিরোধ তা অন্য ব্যাপার কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁর মত সুবিচারক ও ন্যায় বন্টনকারী বিশ্বস্ত কোন লোক তোমরা পাবে না।
শেরে বাংলা উপাধি লাভ
চল্লিশ দশকের প্রারম্ভে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত আলেম আল্লামা আব্দুল হামিদ ফখরে বাংলা (রহ.) অনেক আলেমসহ কাদিয়ানীদের সাথে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে মোনাজেরায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেখানে দীর্ঘক্ষণ ধরে প্রশ্ন-উত্তর চলাকালে আল্লামা গাজী শেরে বাংলা (রহ.) তাদের উত্তাপিত প্রশ্নের উত্তর প্রদান পূর্বক সেই বিষয়ে প্রশ্ন করতেই আল্লাহর অসীম কুদরতে কাদিয়ানীরা শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। অতঃপর বাতিলপন্তিরা পরাজিত হয়ে মজলিস ত্যাগ করে। উপস্থিত সকলে তাঁর এরূপ বুদ্ধিদীপ্ত জ্ঞান ও দুর্দান্ত সাহস দেখে অবাক হয়ে যায়। তখন আল্লামা আব্দুল হামিদ ফখরে বাংলা (রহ.) সবার সমর্থন নিয়ে ঘোষণা করেন, আজ আমি এই সভায় আলেম সমাজের প্রক্ষ থেকে ঘোষণা দিচ্ছি মাওলানা সৈয়দ আজিজুল হক আলকাদেরীকে “শেরে বাংলা” উপাধিতে ভূষিত করা হল। তখন উপস্থিত জনতা শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ- বাতাস মুখরিত করে তুলে। এ ছাড়াও তিনি বাতিলপন্তিদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মোনাজেরায় অংশগ্রহণ করে বিজয় লাভ করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতকে সমুন্নত রেখেছেন। অনেক সময় তাঁর হাতে পরাজয় বরণকরে বদ-আক্বীদা পোষণকারীরা তাঁর উপর হামলা করে রক্তাত্ব করে দেয়। একবার ডাক্তার মৃত ঘোষনার আট ঘন্টা পর তিনি জীবিত হয়ে উঠে বসে পড়েন।
বায়াতগ্রহন ও খেলাফত লাভ
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের প্রাক্তন খতীব ও সংস্কারক আল্লামা গাজী সৈয়দ আব্দুল হামিদ বাগদাদী (রহঃ)’র কাছে সৈয়দ মুহাম্মদ আজিজুল হক বায়াত গ্রহণ করেন। তিনি শাহ্সূফী সৈয়দ আব্দুল হামিদ বাগদাদী (রহঃ)’র কাছ থেকে বেলায়তের সর্বোচ্চ খেলাফত লাভ করেন এবং খলিফায়ে আজম বা প্রধান খলিফা হিসেবে অভিষিক্ত হন।
গ্রন্থ রচনা
সৈয়দ মুহাম্মদ আজিজুল হক শেরে বাংলা (রহ.) লিখিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে-
১) দিওয়ান-ই আযীয।
২) ইযাহুদ দালালাত বা মুনাজাতের দলিল।
৩) মজমু’আহ্-ই ফাতাওয়া-ই আযীযিয়াহ্ শরীফ।
ইন্তেকাল
১৯৬৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর (১৩৮৯ হিজরীর ১২ই রজব) ৬৩ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।হাটহাজারী কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত জানাযায় সর্বসম্মতিক্রমে ইমামতি করেন আল্লামা কাজী মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম হাশেমী। জানাযা শেষে হাটহাজারীর প্রাণকেন্দ্রে তাকে সমাহিত করা হয়। প্রতি বছর ১২ই রজব হাটহাজারী দরবার শরীফে তার পবিত্র বার্ষিক ওরশ অনুষ্ঠিত হয়।