জুমার খুতবা

১৩ মহররম|১৪৪৩ হিজরি|শুক্রবার|১৩ আগস্ট২১ইং

হিজরতের গুরুত্ব  হিজরি সনের ইতিহাস”

হিজরত অর্থ:

প্রস্থান করা, একস্থান হতে অন্যস্থানে গমন করা, স্বদেশ ত্যাগ করে ভিন্ন দেশে গমন করা। মুহাজির অর্থ: হিজরতকারী, হাদীস শরীফে “মুহাজির” শব্দটি কোন উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য কোথাও গমন এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সাধারণত নূর নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা মুকাররমা থেকে মদীনা মুনাওয়ারা গমনের ঘটনাকেই ইসলামের ইতিহাসে হিজরত বলা হয়। ইতিহাসের এক নাজুক সন্ধিক্ষণে রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নির্দেশে ৬২২ খৃষ্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ২৭ সফর পবিত্র মক্কা থেকে মদীনার উদ্দেশে হিজরত করেন।

পবিত্র কুরআনে মুহাজির ও আনসার সাহাবাদের মর্যাদা:

ইসলামের ক্রান্তিকালে একাধারে মাতৃভূমি, পরিবার-পরিজন, ধন-সম্পদের মোহ ত্যাগ করে যারা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন এবং মদীনাবাসী আনসারগণ যারা সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে মুহাজির সাহাবাদের সাদরে বরণ করে নেন নবীজির সান্নিধ্যপ্রাপ্ত উভয় শ্রেণির সৌভাগ্যবান সাহাবাদের মর্যাদা, ইসলামের জন্য তাদের আত্মত্যাগ ও অতুলনীয় অবদান উল্লেখ করে মহান আল্লাহ তা’আলা তাঁদের প্রশংসায় অসংখ্য আয়াত নাযিল করেন। তাঁদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সন্তুষ্টির স্বীকৃতি বিঘোষিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।” (সূরা: আত্‌-তাওবা, আয়াত: ১০০)

পবিত্র কুরআনের আলোকে ইসলামী বর্ষের বার মাস:

সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে গনণার কাল ও সময় ছিল বারটি এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহর নিকট মাসের সংখ্যা হচ্ছে বার এ নিয়ম তিনি বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন নভোমন্ডল এবং ভূমন্ডল সৃষ্টির দিন থেকে তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। (সূরা: তাওবা, আয়াত: ৩৬)

আয়াতে বর্ণিত “আল হুরুম” এর এক অর্থ নিষিদ্ধ অর্থাৎ যার অবমাননা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদীস শরীফের আলোকে নিষিদ্ধ চার মাসের নাম প্রমাণিত, যথা: জিলক্বদ, জিলহজ্ব, মহররম ও রজব। মুসলিম ধর্মীয় জীবনে চন্দ্র মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। মুসলমানদের দিন, তারিখ, সন গণনার সম্পর্ক ওহীর সাথে, নবীজির উপর অবতীর্ণ ওহীর মাধ্যমে। এর তাৎপর্য প্রসঙ্গে আল্লাহতা’আলা এরশাদ করেছেন, হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকেরা আপনাকে আল হেলাল (নব চন্দ্র) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। আপনি বলুন, ওটা তো মানুষের সময় নির্দেশের জন্য। (সূরা: আল-বাক্বারা, আয়াত: ১৮৯)

হিজরি সন প্রবর্তনের ইতিহাস:

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র খিলাফত কালে হিজরতের ১৭ বছর পর হতে হিজরি সন গণনা শুরু হয়। ঐতিহাসিক মুহাম্মদ বিন ইসহাক বর্ণনা করেন, নবীজি ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে ২৭ সফর পবিত্র মক্কা থেকে হিজরতের উদ্দেশে বের হলেন, পথিমধ্যে তিনরাত সওর পর্বতের গুহায় অবস্থান করেন, ১লা রবিউল আউয়াল সোমবার মদীনার পথে রওয়ানা হন, ৮ রবিউল আউয়াল সোমবার দুপুরের সময় মদীনার পার্শ্ববর্তী কুবা অঞ্চলে এসে পৌঁছেন। (জুরকানী, খন্ড ১ম, পৃ: ৩৫১)

হযরত ফারুকে আজম (রা.) হিজরি সনের প্রবর্তক:

প্রসিদ্ধ বর্ণনামতে হযরত ওমর (রা.) হিজরি সনের প্রবর্তন করেন। হযরত শা’বী ও হযরত মুহাম্মদ ইবনে সিরীন থেকে বর্ণিত, একবার কুফার গভর্নর হযরত আবু মুসা আল আশআরী (রা.) আমিরুল মুমেনীন খলিফা হযরত ওমর (রা.)’র নিকট একখানা পত্র লিখেন। লিখিত পত্রে উল্লেখ করেন যে, আপনার নির্দেশনা সম্বলিত চিঠিপত্র আমাদের হস্তগত হয় কিন্তু এতে তারিখ সন উল্লেখ না থাকার কারণে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, নির্দেশনা বাস্তবায়নে জটিলতা সৃষ্টি হয়। পত্র প্রাপ্তির পর ১৭ হিজরিতে হযরত ওমর (রা.) জরুরি ভিত্তিতে ইসলামী সন প্রবর্তনের লক্ষ্যে বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরামদের নিয়ে মজলিসে শুরার সভা আহবান করলেন। কখন থেকে সন গণনা শুরু হবে এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হলো, কোন কোন সাহাবী নবীজির জন্ম তারিখ হতে গণনা শুরু করার প্রস্তাব করলেন। কোন কোন সাহাবী নবীজির ইন্তেকালের তারিখ হতে গণনা করার অভিমত ব্যক্ত করলেন। এ সনের নাম কি হবে, কখন থেকে নতুন সন প্রবর্তিত হবে, বিভিন্নজন বিভিন্ন মত দিলেন কেউ মত দিলেন রমজানুল মুবারক হতে শুরু করা হোক। হযরত ওসমান (রা.) ও হযরত আলী (রা.) উভয়ই হযরত ওমর (রা.) কে পরামর্শ দিলেন হিজরতের সন থেকে গণনা করা হোক এবং মহুররম মাস হতেই মাসের গণনা শুরু হোক। হযরত ওমর (রা.)সহ উপস্থিত সকল সাহাবাগণ সর্বসম্মতভাবে একবাক্যে এ প্রস্তাবে সমর্থন জানালেন। হযরত ওমর (রা.) বললেন, তারিখ গণনার সূচনা হিজরি সন থেকে হওয়াই বাঞ্চনীয় যেহেতু হিজরতের মাধ্যমে হক বাতিলের পার্থক্য সূচিত হয়েছে। হিজরতের মাধ্যমে ইসলামের বিজয়ের সূচনা হয়েছে। রবিউল আউয়াল মাসে যেহেতু নূর নবীজি হিজরত করেছিলেন এ জন্য রবিউল আউয়াল মাস হতে হিজরি বর্ষ আরম্ভ করা উচিত ছিল কিন্তু রবিউল আউয়ালের পরিবর্তে মহররম থেকে এ জন্যেই আরম্ভ করা হলো যেহেতু নবীজি মহররম মাসেই হিজরতের নিয়ত করেছিলেন।

হিজরি সন ইসলামী ঐতিহ্যের স্মারক:

মুসলমানদের ইবাদত বন্দেগী, আচার, অনুষ্ঠান, উৎসব, প্রভৃতি কর্মের সাথে হিজরি বর্ষের সন ও তারিখ সম্পৃক্ত। বিগত চৌদ্দশত বৎসরের অধিককাল থেকে হিজরি সন ও তারিখ অনুসরণে মুসলিম সমাজে ধর্ম কর্ম ঐতিহাসিক স্মরনীয় দিবস গুলো পালিত হয়ে আসছে। যেমন: মহররমের দশম তারিখে আশুরা দিবস, সফর মাসের শেষ বুধবার আখেরী চাহার শোম্বা, ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ১১ রবিউস সানী হযরত বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী (র.)’র ওফাত দিবস স্মরণে ফাতেহায়ে ইয়াজ দাহম, ২২ জমাদিউস সানী ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র ওফাত দিবস, ২৭ রজব পবিত্র মিরাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ২শাবান ইমাম আযম আবু হানিফা (র.)’র ওফাত দিবস, ১৪ শাবান দিবাগত রজনী পবিত্র শবে বরাত, ১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর দিবস, ২১ রমজান আমিরুল মুমেনীন হযরত মওলা আলী (রা.)’র শাহাদাত দিসব, ২৭ রমজান পবিত্র শবে কদর, ০১ শাওয়াল পবিত্র ঈদুল ফিতর, ১০ জিলহজ্ব পবিত্র ঈদুল আযহা, ১৮ জিলহজ্ব আমিরুল মুমেনীন হযরত ওসমান জিন্নুরাইন (রা.)’র শাহাদাত দিবস, ২৬ জিলহজ্ব হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র শাহাদাত দিবস।

হিজরত বিজয়ের স্মারক:

মক্কার প্রতিকূল পরিস্থিতি, লাঞ্ছনা-বাঞ্ছনা, নিরাশ ও হতাশার জীবন পেরিয়ে মদীনার জীবনে ফিরে এলো শান্তি, বিজয়, সাফল্য ও অগ্রগতি। সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বশেষ নবী রাহমাতুল্লীল আলামীন নবী মদীনার জীবনে যথার্থ মর্যাদা শ্রদ্ধা ও সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হলেন। তাঁর পবিত্র জীবনাদর্শ অনুসরণে মুসলিম উম্মাহ ধন্য হলো। ইয়াসরব বাসীরা তাঁদের শহরের নাম পরিবর্তন করে “মদীনাতুন নবী”, “মদীনাতুল মনোওয়ারা” নবীর শহর আলোকিত শহর, নাম দিয়ে ঈমানী চেতনা ও নবী প্রেমে জেগে উঠলো। ইসলামকে বিজয়ী ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছড়িয়ে দিতে সকলে নিজেদের উৎসর্গ করলেন।

হিজরত পরবর্তী মদীনার জীবন:

আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দে ৫৩ বছর বয়সে নবুওয়তের ১৩ বছরে ২৭ সফর মদীনায় হিজরত করেন। ৮ রবিউল আউয়াল মদীনার পার্শ্ববর্তী কুবা নামক স্থানে পৌছেন সেখানে কয়েক দিন অবস্থানের পর ১২ রবিউল আউয়াল মদীনায় পৌঁছেন। মদীনায় এসে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহল ও সুহাইল মদীনার দুই এতিম বালকের জমিটুকু মসজিদ নির্মাণের জন্য উপযুক্ত মূল্য দিয়ে ক্রয় করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে তারা দুজনই বললেন ইয়ারাসূলাল্লাহ আমরা এ জমি বিনামূল্য আপনাকে দিতে আগ্রহী। তবুও নবীজি তাদেরকে মূল্য পরিশোধ করলেন। অতঃপর মসজিদ নির্মাণ করলেন, নবীজির জমানায় কাঁচা ইট দ্বারা মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। ছাদ ছিল খেজুর পাতার, খুটিগুলো ছিলো খেজুর বৃক্ষের কাণ্ড দ্বারা নির্মিত। (বুখারী শরীফ, ৪৪৬)

২য় হিজরিতে আযানের বিধান প্রবর্তন, রোজা ফরজ হওয়ার বিধান অবতীর্ণ, সাদকাতুল ফিতর ও কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ অবতীর্ণ, ঈদুল আযহার সালাত আদায় ও কুরবানীর নির্দেশ অবতীর্ণ হয় হিজরীর জিলহজ্ব মাসে, হযরত ফাতেমাতুজ্জাহরা (রা.)’র শাদী মুবারক অনুষ্ঠিত হয়, ৩য় হিজরিতে ওহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়, একই সনে যাকাত ফরজ এবং মদ্য পান হারাম করা হয়। ৫ম হিজরিতে পর্দার বিধান নাযিল হয়। ৬ষ্ঠ হিজরিতে কুরাইশদের সাথে সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৭ম হিজরিতে পৃথিবীর বড় বড় রাজা বাদশাহদের নিকট নবীজি পত্র মারফত ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত জানিয়ে দূত প্রেরণ করেন। ৮ম হিজরিতে মক্কা বিজয়। ৯ম হিজরির রজব মাসে তাবুকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়, ১০ম হিজরিতে ১ লক্ষ ১৪ হাজার মতান্তরে ১লক্ষ ২৪ হাজার সাহাবাদের বিশাল কাফেলা নিয়ে বিদায় হজ্ব সম্পন্ন করেন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম।
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।