জুমার-খুৎবা

তাসাউফ ও তরীক্বতের গুরুত্ব | জুমার খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভী

জুমার খুতবা

০৬ রবিউস সানী|১৪৪৩ হিজরি|২৮ কার্তিক’১৪২৮ বঙ্গাব্দ (হেমন্ত)|১২ নভেম্বর’২১

তাসাউফ

‘ইলমে তাসাউফ’ বা সুফীবাদ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘তাসাউফ ’ তথা তরীক্বত চর্চা ও অনুশীলন করে মানবজাতি বাস্তব জীবনে ইসলামের প্রকৃত শান্তি উপলব্ধি করতে পারে। তাসাউফ ও তরীক্বত ভিত্তিক জীবন গঠন মানব জাতির ইহকালীন শান্তি, পরকালীন কল্যাণ ও মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে। ‘তাসাউফ’ ও ‘তরীক্বত চর্চা’ ইসলামের নতুন কোন বিষয় নয় এবং তাসাউফ হচ্ছে ইসলামের প্রকৃত নির্যাস বা প্রাণ, ইসলামের মূলধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আদর্শবিরোধী বাতিল অপশক্তিগুলো ইসলামের এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে বিলুপ্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে আসছে। ইসলাম বিদ্বেষী ও ইসলাম বিকৃতিকারীদের তাসাউফ ও তরীক্বত বিরোধী অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির কারণে একশ্রেণীর আধুনিক শিক্ষিত মুসলমানরাও তাসাউফ ও তরীক্বত চর্চার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছে অথবা এ ব্যাপারে উদাসীন হয়ে আছে। তাসাউফ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও ধারণা না থাকার কারণেই তারা এ ঐশী জ্ঞানের সংযোগ ও অলৌকিক শক্তির সুপ্রভাব বঞ্চিত হয়ে আসছে। তাসাওফ চর্চা মানুষকে সত্যিকার অর্থে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের যোগ্য প্রতিনিধি হিসেবে গড়ে তোলে। তাসাউফ ও তরীক্বত বর্ণিত ইসলাম প্রাণহীন ও ফ্যাকাশে। নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের এ ক্রান্তিকালে তাসাওফ চর্চা ও তরীক্বতের শিক্ষা অনুসরণেই মুক্তির পথ সুগম হওয়া নিশ্চিত। উন্নত চরিত্র গঠনের লক্ষ্যে তাসাওফ শাস্ত্র এক নিয়ামক শক্তি।

‘তাসাউফ ’ (تصوف) শব্দের বিশ্লেষণ

‘তাসাউফ ’ (تصوف) শব্দটি আরবী। এর উৎস মূল নিয়ে বিভিন্ন অভিমত পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেছেন, এটা صوف (সূফ) শব্দ থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ পশম। এ অর্থে ‘সূফী’ বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝায়, যিনি পার্থিব জগতের লোভ-লালসা ও আরাম-আয়েশ ত্যাগের নিদর্শন স্বরূপ পশমী কাপড় বা পোষাক পরিধান করেন। অবশ্য, আল্লামা ক্বোশায়রী বলেন, প্রকৃত সূফী হওয়ার জন্য এমনটি করা আবশ্যকীয় নয়। কারো কারো মতে تصوف শব্দটি صفا শব্দ থেকে নেয়া হয়েছে। এর অর্থ পরিচ্ছন্নতা, পবিত্রতা। এ অর্থে সূফী সাধকরা হচ্ছেন পবিত্র-পরিচ্ছন্ন চরিত্রের অধিকারী। কারো কারো মতে, শব্দটি صف (সফ) থেকে উৎকলিত। এর অর্থ কাতার বা সারি। এ অর্থে সূফীরা হচ্ছেন মর্যাদাসম্পন্ন প্রথম কাতারের মানুষ । কেউ কেউ বলেছেন, ‘সূফী শব্দটি সুফ্ফাহ্ থেকে গৃহীত। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সময়ে মসজিদে নবভী শরীফের একপাশে কিছু সাহাবী-ই রসূল সার্বক্ষণিকভাবে অবস্থান করতেন, যাঁরা ‘আসহাবে সুফ্ফা’ নামে পরিচিত। ইসলামের ইতিহাসে এখান থেকেই সুফীবাদ শব্দটির উৎপত্তি বলে তাঁদের ধারণা। কেননা, সুফীগণও এ ধরনের সাধনার মাধ্যমে পবিত্র আত্মার অধিকারী।

উল্লেখ্য, ‘সূফী’ ‘সুফ্ফা’ থেকে নির্গত হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়- প্রায় সত্তরজন সাহাবী, যাঁরা মসজিদে নববীতে এক প্রকোষ্ঠে অবস্থান করতেন, রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁদের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতেন।

ড. আর.এ. নিকলসন সূফী দর্শনের সমালোচক পন্ডিত, তিনি ‘সূফী’ শব্দটিকে সো ফিস্ট (আরবী سوف) থেকে নির্গত বলে মনে করেন। سوف (সূফ) অর্থ জ্ঞান আর سوفى মানে জ্ঞানী। سوف থেকে পরিবর্তিত হয়ে সূফী (صوفى) হচ্ছে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ জ্ঞানের আধার।
কিন্তু তরীক্বতপন্থী ও আরিফ বান্দাদের মতে, গ্রীক দার্শনিকদের সাথে ইসলামের সূফীদের কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং এ সম্পর্কে ওলামা-মাশাইখ, সূফীগণের অভিমত নিন্মরূপঃ

ওলামা মাশায়েখ ও সূফীগণের দৃষ্টিতে তাসাউফ

যেহেতু তাসাউফ ও সূফীদের প্রকৃত পরিচিতি নির্ণয়ে ওলামা- মাশায়েখ ও সূফীগণের বিভিন্ন মতামত পরিলক্ষিত হলেও নিম্নে লিখিত কতিপয় মতামত থেকে উল্লেখযোগ্য তাসাওফ ও সূফীর সংজ্ঞা নির্ণয় করা যায়-

১. আধ্যাত্মিক জগতের মহান দিকপাল অলীকুল সম্রাট হযরত শায়খ আবদুল কাদের জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাসাউফ সম্পর্কে বলেছেন-

اَلتَّصَوُّفُ اَرْبَعَةُ اَحْرُفٍ تَاءٌ وَصَادٌ وَوَاءٌ وَفَآءٌ ـ فَالتَّآءُ مِنَ التَّوْبَةِ وَهُوَ عَلى وَجْهَيْنِ تَوْبَةُ الظَّاهِرِ وَتَوْبَةُ الْبَاطِنِ ـ وَالصَّادُ مِنَ الصَّفَا وَهُوَ اَيْضًا عَلٰى وَجْهَيْنِ صَفَآءُ الْقَلْبِ وَصَفَاءُ السِّرِّ فَصَفَاءُ الْقَلْبِ اَنْ يَصْفِىَ قَلْبُه مِنَ الْكُدُوْرَاتِ الْبَشَرِيَّةِ مِثْلُ الْعَلاَئِقِ الَّتِىْ تُحْصَلُ فِى الْقَلْبِ مِنْ كَثْرَةِ الْاَكْلِ وَالشَّرَبِ وَالْمَنَامِ وَالْكَلاَمِ وَالْمُلاَخَطَاتِ الدُّنْيَوِيَّةِ الخـ وَاَمَّا صَفَاءُ السِّرِّ فَهُوَ بِاَلْاِجْتِنَابِ عَمَّا سِوَى اللهِ تَعَالٰى ـ وَاَمَّا الْوَاوُ فَهُوَ مِنَ الْوَلاَيَةِ … الخـ وَنَتِيْجَةُ الْوِلاَيَةِ اَنْ يَّتَحَقَّقَ بِاَخْلاَقِ اللهِ تَبَارَكَ وَتَعَالٰى كَمَا قَالَ عَلَيْهِ الصَّلوةُ وَالسَّلاَمُ تَخَلَّقُوْا بِاَخْلاَقِ اللهِ تَعَالى ـ وَاَمَّا الْفَآءُ فَهُوَ الْفَنَآءُ فى اللهِ جَلَّ جَلاَلُهٗ فَاِذَا فَنَتْ صِفَاتُ الْشَرِيَّةِ تَبْقى صِفَاتُ الْاَحَدِيََّةِ وَهُوَ سُبْحَانَهٗ لاَ يَفْنٰى وَلاَ يَزُوْلُ فَبَقِىَ الْعَبْدُ الْفَانِىَ مَعَ الرَّبِّ الْبَاقِىْ وَمَرْضِيَاتِهٖ الخـ
অর্থাৎ تَصَوُّفٌ (তাসাউফ) শব্দটি হচ্ছে আরবী চারটি বর্ণের সমষ্টিঃ প্রথম বর্ণ ت (তা), দ্বিতীয় বর্ণ ص (সোয়াদ), তৃতীয় বর্ণ و (ওয়াও) এবং চতুর্থ বর্ণ ف (ফা)। প্রতিটি বর্ণ মাহাত্ম্য জ্ঞাপক। যেমন ‘তা’ বর্ণ تَوْبَة (তাওবাহ্) এর দিকে ইঙ্গিতবহ। ‘তাওবাহ্’ দু’ প্রকার- বাহ্যিক তাওবাহ্ ও অভ্যন্তরীণ তাওবাহ্; ص সোয়াদ বর্ণ দ্বারা صَفَا -এর দিকে ইঙ্গিত করা হয়। এর অর্থ পরিচ্ছন্নতা। এটিও দু’প্রকারঃ ক্বলবের পরিচ্ছন্নতা ও অভ্যন্তরীণ পরিচ্ছন্নতা। ক্বলব বা অন্তরের পরিচ্ছন্নতা হলো মানবীয় পঙ্কিলতা থেকে অন্তর পবিত্র হওয়া, যা সাধারণত মানুষের অন্তরে পাওয়া যায়, যেমন অধিক পানাহার, অধিক নিদ্রা, অধিক কথা বলা ও দুনিয়ার সাথে অধিক সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি। আর অভ্যন্তরীণ পরিচ্ছন্নতা হলো, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য সব কিছু থেকে অন্তরাত্মাকে মুক্ত রাখা। আর واو (ওয়াও) বর্ণ দ্বারা (বেলায়ত) ولاية বুঝায়। বেলায়তের সারকথা হলো, বান্দা নিজেকে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করা। যেমন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘‘তোমরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও।’’ ‘তাসাউফ’ শব্দের সর্বশেষ বর্ণ فاء; এটা দ্বারা فَنَافِى اللهِ -এর দিকে ইঙ্গিত করা যায়। অর্থাৎ বান্দা নিজেকে আল্লাহ্তে বিলীন করে দেওয়া। যখন মানবীয় গুণ বিলীন হয়ে যায়, তখন খোদায়ী গুণ বিকশিত হয়। আল্লাহ্র সত্তায় বিলীনতা নেই। সুতরাং ধ্বংসশীল বান্দা চিরন্তন সত্তার সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি বিধানে স্থায়িত্ব অর্জন করতে পারে।

২. হযরত মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন ইবনে আবূ তালিব রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হতে বর্ণিত,
اَلتَّصَوُّفُ خُلُقٌ فَمَنْ زَادَ عَلَيْكَ فِى الْخُلُقِ زَادَ ০عَلَيْكَ فِى التَصَوُّفِ
অর্থাৎ ‘তাসাউফ’ অনুপম সুন্দর চরিত্রের নাম। যাঁর চরিত্র যত বেশী সৌন্দর্যমন্ডিত, তিনি তাসাওফের ততবেশি উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন হবেন।

৩. হযরত আবুল হুসাইন আননূরী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, اَلتَّصَوُّفُ تَرْكُ النَّفْسِ جُمْلَةً
অর্থাৎ সমষ্টিগতভাবে আত্মার কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ পরিত্যাগ করার নামই তাসাউফ।

৪. শায়খ আবুল হাসান রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন,
لَيْسَ التَّصَوُّفُ رُسُوْمًا وَلاَ عُلُوْمًا وَلٰكِنَّهٗ اَخْلاَقٌ
অর্থাৎ তাসাউফ নিছক প্রথাগত বিদ্যা ও কেবল একটি শাস্ত্রের নাম নয়; বরং চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের নাম তাসাউফ।

৫. হযরত দাতাগঞ্জ বখশ মাখদুম আলী হাজভিরী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির প্রণীত বিখ্যাত গ্রন্থ كشف المحجوب -এ হযরত শায়খ খিযরীর বর্ণনা ব্যক্ত করেন,
اَلتَّصَوُّفُ صَفَاءُ السِّرِ مِنْ كُدُوْرَةِ الْمُخَالَفَةِ
অর্থাৎ তাসাউফ হচ্ছে সির্র বা অভ্যন্তরকে সত্যের বিরোধিতার পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র ও মুক্ত রাখার নাম।

৬. শায়খুল ইসলাম যাকারিয়া আনসারী তাসাউফ প্রসঙ্গে বলেন,
اَلتَّصَوُّفُ هُوَ عِلْمٌ تُعْرَفُ بِهٖ اَحْوَالُ تَزْكِىَةِ النُّفُوْسِ وَتَصْفِيَةُ الْاَخْلاَقِ وَتَعْمِيْرُ الظَّاهِرِ وَالْبَاطِنِ لِنَيْلِ السَّعَادَةِ الْاَبَدِيَّةِ
অর্থাৎ ‘তাসাউফ’ এমন এক শাস্ত্রের নাম, যে শাস্ত্রের চর্চায় আত্মার পবিত্রতা, চারিত্রিক পরিশুদ্ধি, চিরস্থায়ী কল্যাণ ও সৌভাগ্য অর্জনের নিমিত্তে আন্তরিক ও বাহ্যিক উৎকর্ষ ও সংস্কার সাধনের জ্ঞান অর্জিত হয়।

৭. প্রখ্যাত সূফীসাধক হযরত ইমাম মা’রূফ কারখী (ওফাত ৮১৫খ্রি.)
اَلتَّصَوُّفُ هُوَ الْاَخْذُ بِالْحَقَآَئِقِ وَالْيَأْسُ مِمَّا فِىْ اَيْدِى الْخَلآَئِقِ
অর্থাৎ তাসাউফ হচ্ছে হাক্বীক্বত তথা সত্যকে গ্রহণ করা এবং মানুষের হাতে যা আছে, তা অর্জন থেকে বিমুখ হয়ে যাওয়া।

মানুষের পার্থিব অর্জন, যশ-খ্যাতি, লোভ লালসা, কামনা-বাসনা ধন সম্পদের প্রাচুর্য এবং বিলাস বহুল জীবন যাপনের মহড়া থেকে নিজকে পবিত্র ও মুক্ত রেখে সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে, কল্যাণের পথে, হেদায়তের পথে এবং আল্লাহ্ ও স্বীয় রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সন্তুষ্টি বিধানের পথে নিজকে নিয়োজিত রাখাই তাসাওফের মূল শিক্ষা।

৮. সিলসিলা-ই আলিয়া ক্বাদেরিয়ার শায়খুল মাশায়েখ সৈয়্যদুল আউলিয়া হযরত শায়খ আবদুল ক্বাদের জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাসাউফের পরিচয় ব্যক্ত করেন এভাবে-
اَلتَصَوُّفُ اَلصِّدْقُ مَعَ الْحَقِّ وَحُسْنُ الْخُلُقِ مَعَ الْخَلْقِ
অর্থাৎ তাসাউফ হচ্ছে আল্লাহর সাথে সত্যপরায়ণতা ও সৃষ্টির সাথে সুন্দর ও উত্তম আচরণ তথা আদর্শিক ব্যবহার করা।

মহান স্রষ্টার প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি মার্জিত, কাক্সিক্ষত, সুন্দর ব্যবহার ও উত্তম আচরণ প্রদর্শন তাসাওফের অন্যতম শিক্ষা ও আদর্শ।

সূফীদের পরিচয়

ইসলামী পরিভাষায় ওই ব্যক্তিকে ‘সূফী’ বলা হয়, যিনি আল্লাহর নির্দেশিত ও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রদর্শিত পথে নিজকে উৎসর্গ করেছেন, আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় হাবীবের প্রেম ও ভালবাসায় সর্বপ্রকার ইবাদতে নিজকে মগ্ন রাখেন, আল্লাহ্ ও রসূলের সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়া পাার্থিব জীবনের ঐশ্বর্য ও প্রতিপত্তির প্রতি তাঁর কোন কামনা-বাসনা থাকেনা এবং সৃষ্টি জগতের সবকিছুই যিনি আল্লাহ্তে বিলীন করে দেন তিনিই প্রকৃত সূফী।

সূফীদের পরিচয় প্রদানে ওলামা- মাশায়েখের কতিপয় সংজ্ঞা নিম্ন বর্ণিত হলো-

১. হযরত বিশর হাফী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির মতে,
اَلصُّوْفِىُّ مَنْ صَفَا قَلْبُهٗ بِذِكْرِاللهِ
অর্থাৎ আল্লাহর যিকরের মাধ্যমে যিনি স্বীয় আত্মা পরিশুদ্ধ করে নেন, তিনিই সূফী।

২. হযরত যুন্নূন মিসরী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন,
اَلصُّوْفِىُّ هُمْ قَوْمٌ اٰثَرُوا اللهَ عَزَّوَجَلَّ عَلٰى كُلِّ شَئٍ
অর্থাৎ সূফী এমন এক শ্রেণীর বিশেষ বান্দা, যাঁরা জীবনের প্রত্যেক বস্তুর উপরে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালবাসাকে প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার দেন।

৩. হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি (ওফাত ২৯৭) বলেন,
اَلصُّوْفِىُّ اَنْ يَتَخَصَّصَ اللهَ بِالصَّفَاءَ فَمَنْ اصْطَفٰى
مِنْ كُلِّ مَاسِوَىَ اللهِ فَهُوَ الصُّوْفِىُّ
অর্থাৎ পবিত্রতার সাথে নিজকে আল্লাহর জন্য নির্র্দিষ্ট করা এবং আল্লাহ্ ছাড়া সকল কিছুর প্রভাব থেকে নিজকে মুক্ত রেখে আল্লাহর জন্য যিনি মনোনীত হয়েছেন, তিনি সূফী।

৪. সূফীগণ আসহাবে সূফ্ফার অনুসারী। হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবা-ই কেরাম সাদাসিধে জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিলেন। সূফীরাও হচ্ছেন ওই পুণ্যাত্মা বান্দাদের পদাঙ্ক অনুসারী। শায়খ আবূ বকর ইবনে ইসহাক্ব বুখারী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন,
قَالَ قَوْمٌ اِنَّمَا سُمُّوْا صُوْفِىَّةً لِقُرْبِ اَوْ صَافِهِمْ مِنْ اَوْصَافِ اَهْلِ الصُّفَّةِ الَّذِيْنَ كَانُوْا عَلَى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
অর্থাৎ একদল আলেম বলেন, সূফীদের ‘সূফী’ নামে নামকরণ এ অর্থে করা হয় যে, তাঁরা নিজ গুণাবলীতে আসহাবে সুফ্ফার নিকটবর্তী; যাঁরা রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে ছিলেন।

৫. গাউসুল আ’যম দস্তগীর শায়খ আবদুল ক্বাদির জীলানী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি সূফীর পরিচয় দিয়ে বলেন,
اَلصُّوْفِىُّ مَنْ كَانَ صَافِيًا مِّنْ اٰفَةٍ النَّفْسِ خَالِيًا مِنْ مَذْمُوْمَاتِهَا سَالِمًا لِحَمِيْدِ مَذَهِبٍ مُلاَزِمًا لِلْحَقَائِقِ غَيْرَ سَاكِنٍ قَلْبُهٗ اِلٰى اَحَدٍ مِّنَ الْخَلاَئِقِ
অর্থাৎ ‘সূফী’ ওই ব্যক্তি, যিনি কুপ্রবৃত্তির বিপদ থেকে পবিত্র থেকেছেন, নিন্দিত অপকর্ম থেকে মুক্ত, নিরাপদ প্রশংসিত পথে পরিচালিত সত্যকে অনিবার্যরূপে গ্রহণ করেছেন, সৃষ্টিরাজির কারো সাথে অন্তরের সংযোগ রাখেন না।

৬. সূফীগণ পশমের পোশাক পরিধান করেন। অর্থাৎ সূফীগণ অনাড়ম্বর সাদাসিধে জীবন যাপন করে থাকেন, বৈচিত্রময় পোষাকের চাকচিক্য তাঁরা এড়িয়ে চলেন। আবূ নসর আস্ র্সারাজ এ প্রসঙ্গে বলেন-
اَلصُّوْفِيَةُ نُسِبُوْا اِلى ظَاهِرِ اللُّبْسَةِ لِاَنَّ لُبْسَةَ الصُّوْفِ ودَأْبُ الْاَنْبِيَآءِ وَشِعَارُ الْاَوْلِيَاءِ وَالْاَصْفِيَاءِ
অর্থাৎ বাহ্যিক পোষাকের দিক দিয়েও সূফীগণকে সূফী বলা হয়। কারণ, পশমের কম্বল পরিধান করা নবীগণ, ওলীগণ ও সূফীগণের নিদর্শন বা প্রতীক।

৭. পূর্ববর্তী সূফীগণ ইলমে শরীয়তের ইমাম ছিলেন। আল্লামা ইবনুল জওযী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ৫০৮ হিজরিতে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন, ৫৯৭ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। তিনি একাধারে মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, ঐতিহাসিক সমালোচক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় সহস্রাধিক গ্রন্থের প্রণেতা ছিলেন। তিনি সূফীবাদের একজন সূক্ষ্ম বিশ্লেষক হিসেবে একথা স্বীকার করেন যে,
وَمَا كَانَ الْمُتَقَدِّمُوْنَ فِى التَّصَوُّفِ اِلاَّ رُؤَسَآءُ
فِى الْقُرْانِ وَالْفِقْهِ وَالْحَدِىْثِ وَالتَّفْسِىْرِ
অর্থাৎ পূর্ববর্তী সূফীগণ ক্বোরআন, ফিক্বহ্ ও হাদীস এবং তাফসীরের ইমাম ছিলেন।

আজকের যুগে সূফী নামধারীদের অনেকে শর‘ঈ জ্ঞানশূন্য। যথারীতি শর‘ঈ জ্ঞানে পারদর্শী না হয়েও ‘আল্লামা’ ও ‘শাহ্সূফী’ উপাধি ধারণকারী অনেক ভন্ড প্রতারকও প্রতিনিয়ত সরলপ্রাণ মুসলিম সমাজকে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে। ইসলামবিরোধী শরীয়তবিরোধী, আউলিয়া-ই কেরামের আদর্শ ও চেতনাবিরোধী বিভিন্ন কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার পরও ‘শাহ্’ ‘সূফী’ লক্বব ধারণ করা প্রকৃত সূফীবাদ তথা সূফীয়া-ই কেরামের শিক্ষা ও আদর্শের প্রতি প্রতারণা ও প্রহসনের শামিল। এসব ভন্ড সূফীদের বেশভূষা দেখে সাধারণ মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। এদের স্বরূপ উম্মোচন এবং এদের অশুভ তৎপরতা ও প্রতারণা থেকে দেশ জাতি ও মুসলিম মিল্লাতকে রক্ষা করা সকলের ঈমানী দায়িত্ব।

এ প্রসঙ্গে হযরত ইয়াহ্ইয়া মু‘আয রাযী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন,
اِجْتَنِبْ صُحْبَةَ ثَلاَثَةِ اَصْنَافٍ مِنَ النَّاسِ ـ
اَلْعُلَمَآءِ الْغَافِليْنَ وَالْفُقَرَاءِ الْمُدَاهِنِيْنَ وَالْمُتَصَوِّفَةِ الْجَاهِلِيْنَ
অর্থাৎ তিনি প্রকার লোকের সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকা অপহিরার্যঃ এক. অলস ও অমনোযোগী আলিম থেকে, দুই. প্রতারক পদলেহী তোষামোদকারী ফক্বীর থেকে এবং তিন. অজ্ঞ সূফী থেকে।

সূফীবাদের ক্রমবিকাশ

মহাগ্রন্থ ক্বোরআনুল করীম ও প্রিয়নবীর সুন্নাহ তথা হাদসি শরীফই সূফীবাদের উৎস। পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে-
قَدْ اَفْلَحَ مَنْ زَكّٰهَا وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسّٰهَا
অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজ আত্মাকে বিশুদ্ধ করেছে, সে সফলকাম হয়েছে আর যে একে কলুষিত করেছে, সে অকৃতকার্য হয়েছে।

এতে প্রমাণিত হয় যে, আত্মশুদ্ধি তথা তাসাউফ অর্জন ও চর্চা ব্যতীত কল্যাণ ও সফলতা আশা করা যায়না।অসংখ্য হাদীস শরীফেও ইলমে তাসাউফ তথা বাতেনী বা আধ্যাত্মিক ইলমের কথা বর্ণিত হয়েছে।হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন,
قَالَ اَلْعِلْمُ عِلْمَانِ فَعِلْمٌ فِى الْقَلْبِ فَذَالِكَ الْعِلْمُ النَّافِعُ
وَعِلْمٌ عَلَى اللِّسَانِ فَذَالِكَ حُجَّةُ اللهِ عَلٰى اِبْن اٰدمَ

অর্থাৎ ইলম দু’ প্রকার: অন্তরের ইল্ম, এটি উপকারী ইলম। মুখের ইলম এটি আদম সন্তানের উপর দলীল।
বর্ণিত হাদীসে অন্তর সম্পর্কিত ইলমই হলো তাসাওফ বা সূফীবাদ। এ প্রকার ইলমের অপর নাম ইলমে বাত্বিন। যেমন, হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত,

عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ حَفِظْتُ مِنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وِعَئَُيْنِ فَاَمَّا اَحَدُهُمَا قَدْ بَيَّنْتُ فِيْكُمْ وَاَمَّا الْاٰخَرُ فَلَوْ بَيَّنْتُ فَقُطِعْ الْبَلْعُوْمُ

অর্থাৎ হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূল করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট থেকে দু’টি জ্ঞানের পাত্র সংরক্ষণ করেছি; এক প্রকার যাহেরী জ্ঞান, যা আমি তোমাদের মধ্যে বর্ণনা করেছি। অপরটি যদি আমি বর্ণনা করতাম, তাহলে আমার কণ্ঠনালী কেটে ফেলা হতো। এর অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক তত্ত্বই ইসলামে তাসাউফ নামে খ্যাত। যেমন সূরা কাহ্ফের বর্ণনায় হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম ও হযরত খাদ্বির আলায়হিস্ সালামের মধ্যে সংগঠিত ঘটনায় আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রমাণ পাওয়া যায়।
ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই আল্লাহর সূফীবাদী পূণ্যাত্মা প্রিয় বান্দারা এ প্রকার ইলমের অধিকারী। এ প্রকারের ইল্মে তাসাউফের সূচনা হয় হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম থেকেই। তাসাউফের প্রথম শিক্ষক হলেন হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম। নবী প্রেরণের ধারাবাহিকতায় সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন তাসাউফের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাদাতা।

সাহাবা-ই কেরাম থেকে যাহেরী ও বাতেনী ইলম অর্জন করে নিজেদেরকে ধন্য করেন। সাহাবা-ই কেরাম ও তাবে‘ঈদের যুগে তাসাউফ চর্চা অব্যাহত থাকলেও তাদেরকে সূফী নামে অভিহিত করা হতো না, দার্শনিক আল বেরুনীর মতে, ‘সূফী’ শব্দটি প্রথম কুফাবাসী আবূ হাশিম উসমান ইবনে শরীফ (ওফাত-১৬২ হিজরী, ৭৭৭ খ্রি.) থেকে শুরু হয়।

অন্যদের মতে, ‘সূফী’ নামটি প্রথম যুক্ত হয় হযরত জাবির ইবনে হাইয়্যান (ওফাত ১৬৪হি.) এর উপর। দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষভাগে ‘সূফী’ নামটি জন সাধারণে বিস্তার লাভ করে। এ সময়ের কতিপয় উল্লেখযোগ্য সূফীসাধক বিশেষভাবে স্মরণীয়- ১. হযরত হাসান আল বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। তিনি হিজরি ২১ সালে ৬৪২ খৃস্টাব্দে মদীনা শরীফে জন্মগ্রহণ করেন। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খিলাফতকালে তিনি বসরায় গমন করেন। হিজরি ১১০ সালে এখানেই তিনি ইন্তিকাল করেন। এখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। ১২০ জন সাহাবীকে দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছে, যাঁদের মধ্যে ৭০ জনই ছিলেন বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী মহান সাহাবী।
ইবরাহীম ইবনে ঈসা বলেন, আমি আখিরাতের চিন্তায় হাসান বসরীর চেয়ে অধিক চিন্তিত ও ক্রন্দনকারী আর কাউকে দেখিনি।

হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলতেন,
اِبْنَ اٰدَمَ بِعْ دُنْيَاكَ بِاٰخِرَتِكَ تَرَبَحْهُمَا جَمِيْعًا
وَلاَ تَبِعْ اخِرَتَكَ بِدُنْيَاكَ فَتَخْسِرَهُمَا جَميْعًا
অর্থাৎ হে মানব সন্তান! তুমি আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়া বিক্রি করে দাও। এতে তোমরা দু’টিই লাভ করতে পারবে। সাবধান, দুনিয়ার বিনিময়ে আখিরাতকে বিক্রি করো না। এতে দু’টিই হারাবে।

২. হযরত রাবেয়া বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা (ওফাত ১৫৮হি.)। হযরত রাবেয়া বসরী ছিলেন এক মহিয়সী রমণী। বর্ণিত আছে যে, এক সময় তিনি এক হাতে পানি এবং আরেক হাতে আগুন নিয়ে দৌঁড়ে যাচ্ছিলেন। জিজ্ঞেস করা হলো কেন দৌঁড়াচ্ছেন? তিনি বললেন ‘‘মানুষ দোযখের ভয়ে ইবাদত করে। আমি পানি দিয়ে দোযখকে নিভিয়ে দেবো। আর কিছু লোক জান্নাতের লোভে ইবাদত করে। এ জন্য আগুন দিয়ে জান্নাতকে জ্বালিয়ে দেবো।’’ বান্দা তার সব আমল যেন আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের সন্তুষ্টির জন্যই করে। এটাই একমাত্র সূফীতত্বের মূলকথা।

৩. হযরত ইমাম জা’ফর সাদিক্ব (ওফাত ৭৬৫খ্রি.)
৪. হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম। (ওফাত ৭৭৭ খ্রি.)
৫. হযরত মা’রূফ কারখী (ওফাত ৮১৫ খ্রি.)
৬. হযরত ফুদ্বাইল ইবনে আয়ায (ওফাত ৭৯৪খ্রি.)
৭. হযরত দাঊদ আত্ তাঈ। (ওফাত ৭৮২খ্রি.)
৮. হযরত শফীক্ব আল বলখী। (ওফাত ৮১০খ্রি.)
৯. হযরত হারিস আল মুহাসিবি। (ওফাত ৮৫৭খ্রি.)
১০. সমকালীন সময়ে মিশরের অন্যতম সূফী সাধক ছিলেন হযরত আবুল ফয়য সওবান ইবনে ইব্রাহীম (প্রসিদ্ধ যুননূন আল মিসরী) হিসেবে। তিনি সূফীবাদে ‘মাক্বাম’ ও ‘হাল’ স্তর সম্পর্কিত ধারনার প্রবর্তন করেন।

১১. পারস্য দেশীয় সূফী মনসূর হাল্লাজ। (ওফাত ৯২২)। তিনি সূফী তত্বের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর মতে, মানব সত্তা ঐশী সত্বার সাথে একাকার হয়ে গেলে সাধক ব্যক্তিগত দ্রষ্টায় পরিণত হয়। তখনি বলে উঠেন ‘আনাল হক’ হযরত মনসূর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি নিজেই এ উক্তি করেছিলেন। তৎকালীন যাহেরী ইলমের অধিকারী এক শ্রেণীর আলেম তাঁকে অভিযুক্ত করেন।

১২. সূফী মতবাদের বিকাশে আধ্যাত্মিক সাধক হযরত মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি (ওফাত ১২৪১)। তিনি ছিলেন ‘ওয়াহ্দাতুল ওজূদ’-এর প্রবক্তা, যার সারকথা, আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টির প্রতিটি অণুর মধ্যে প্রকাশিত হন। কবির ভাষায়-
وَفِىْ كُلِّ شَئٍ لَهٗ اٰيَةٌ تَدُلُّ عَلٰى اَنَّهٗ الْوَاحِدُ
অর্থাৎ বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টির মাঝে তাঁর সত্তার নিদর্শন রয়েছে। ওই নিদর্শনই প্রমাণ করে যে, তিনি এক ও অদ্বিতীয়।

১৩. সূফীবাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণ ও দার্শনিক মাত্রায় সূফী তত্বের বাস্তবতা প্রতিষ্ঠায় হযরত ইমাম গায্যালী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি (১০৫৮-১১১১) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি হযরত জুনায়েদ বাগদাদী, হযরত বায়েজিদ বোস্তামী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিম (ওফাত ৮৭৪) ও হযরত শিবলী প্রমুখ সূফীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তিনি সূফীবাদের সমর্থন ও প্রশংসা জ্ঞাপন এবং বিভ্রান্তির স্বরূপ উন্মোচন করেন। তিনি ‘আল মুনক্বিয মিানদ্ব্দ্বালাল’ ‘ভ্রান্তি থেকে মুক্তিদাতা’ পবিত্রতা নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থও রচনা করেন।

সূফীবাদের গ্রহণযোগ্যতা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে এবং এ ভাবধারাকে সর্বাধিক জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে সাহিত্য রচনা ও কাব্য রচনার মাধ্যমে যাঁরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে হযরত আবদুল করীম জীলী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি, হযরত মোল্লা জামী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি, হযরত শেখ সা’দী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি, হযরত ফরিদ উদ্দিন আত্তার রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি, আল্লামা জালাল উদ্দীন রুমী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি প্রমুখে ভূমিকা চির অম্লান হয়ে থাকবে।

টিকা:

. ড. মুহাম্মদ ফজলুল রহমান, আরবী-বাংলা ব্যবহারিক অভিধান। রিয়াদ প্রকাশনী, ঢাকা, জুন ১৯৯৮, পৃ.৪৫৮।
. আল কাত্তানী, আত্ তারতীব আল ইসরী, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮২.
. সাম হুদী, ওয়াফাউল ওয়াফা, ১ম খন্ড, পৃ. ৩২২।
. ড. রশিদুল আলম, মুসলিম দর্শনের ভূমিকা, পৃ. ৩৪৭।
. সিয়ারুল আসরার, পৃ. ৮৮-৮৯
. খলিক আহমদ নিযামী, তারিখে মাশায়েখ-ই চিশ্ত। (দিল্লী ১৯৬৩) পৃ. ১৮
. আবুল ‘উলা- আফিফী ফী তাসাউফিল ইসলামী। (কায়রো ১৯৬৯) পৃ. ৩১
. শায়খ মুহাম্মদ ক্বায়সার রিসালা-ই ক্বুশায়রিয়াহ্, পৃ. ১৯
. দাতাগঞ্জে বশখ আলী হাজভীরী, কাশ্ফুল মাহজূব।
. শরহুর রিসালাহ্ আল কুশাইরিয়্যাহ্, পৃ. ৭০,
. হযরত ইমাম মা’রূফ কারখী আলায়হির রাহ্মাহ্।
. শায়খ আবদুল ক্বাদির জীলানী, গুনিয়াতুত্ ত্বালিবীন।
. আবুল ‘উলা আফিফী ফী তাসাউফিল ইসলাম। (কায়রো ১৯৬৯), পৃ. ২৯
. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯
. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩, আধ্যাত্মিকতা ও ইসলাম, ই.ফা.বা.পৃ. ৮৩
. شرح الحكم ও ايقاظ الهمم; খ. ১, পৃ. ৬
. হযরত শায়খ আবদুল ক্বাদির, গুনিয়াতুত্ তালেবীন
. আল্লামা ইমাম ক্বুশাইরী, রিসালা-ই ক্বুশাইরিয়া, মিশর, পৃ. ১৯
. খলীক আহমদ নিযামী, তারিখে মাশায়েখে চিশত, পৃ.৩৬
. ক্বোরআনুল করীম, সূরা শামস, ৯১: ৯,১০
. মিশকাত শরীফ, পৃ. ৩৭০
. মিশকাত শরীফ, ইলম পর্ব, পৃ. ৩৭
. ইসলামী বিশ্বকোষ, দ্বাদশ খন্ড, ১৯৯২ পৃ. ৩৯৪
. সাইয়্যেদ কাসেম মাহমুদ, ইসলামী ইনসাইক্লোপিডিয়া, করাচি, পৃ. ৭৮৪
. ইসলামিক ইউনিভার্সিটি স্টাডিজ, ৮ম খন্ড, ২য় সংখ্যা, পৃ. ২৮৪