জুমার-খুৎবা

নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমা (রা.)’র জীবনাদর্শ | জুমার খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

জুমার খুতবা

১৭ মহররম|১৪৪৩ হিজরি|শুক্রবার|২৭ আগস্ট’২১

“নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমা (রা.)’র জীবনাদর্শ”

হযরত ফাতেমা (রা.)’র জন্ম:

নবী পরিবারের উজ্জ্বল নক্ষত্র হযরত সৈয়্যদা ফাতেমাতুজ যাহরা (রা.)’র জন্ম সন সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। এক বর্ণনা মতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একচল্লিশ বৎসর বয়সে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। আল্লামা ইবনে জওযী (র.)’র বর্ণনা মতে নবীজির নবুওয়ত প্রকাশের পাঁচ বৎসর পূর্বে ৬০৫ খ্রিস্টাব্দে বায়তুল্লাহ শরীফ সংস্কারের সময় তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। হযরত জয়নাব, হযরত রুকাইয়া এবং উম্মে কুলসুম এর পর রাসূলুল্লাহর সবচেয়ে কনিষ্ঠ কন্যা হযরত ফাতেমাতুজ যাহরা (রা.)। তাঁর মাতা হচ্ছে উম্মুল মুমেনীন হযরত খাদীজাতুল কোবরা রাদ্বিয়াল্লাহ তা’আলা আনহা।

ফাতেমা নামকরণ:

তাঁর নাম ফাতেমা, উপাধি সৈয়্যাদা, যাহরা, বতুল, তৈয়্যবা, তাহেরা, সিদ্দিকা, মুবারাকা। আরবি ফাতম শব্দ থেকে ফাতেমা এর অর্থ রক্ষা করা, মুক্ত রাখা। এরশাদ হয়েছে, তাঁর নামকরণ প্রসঙ্গে হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি আমার মেয়ের নাম এ জন্যই ফাতেমা রেখেছি যে, আল্লাহ তা’আলা তাঁকে (ফাতেমা) এবং তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনকারীদের কে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করেছেন। (মুসনাদুল ফিরদাউস, খন্ড ১ম, পৃ: ৩৪২, হাদীস ১৩৪০)

হাদীস শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই ফাতেমা পূতপবিত্র। আল্লাহ তা’আলা তাঁর বংশধরগণের উপর জাহান্নাম হারাম করে দিয়েছেন। (মুস্তাদরাক হাকেম, খন্ড: ৩, পৃ: ১৫২)

পবিত্র কুরআনের আলোকে হযরত ফাতেমা (রা.)’র মর্যাদা:

আহলে বায়তের মধ্যমনি, নবীজির কলিজার টুকরা হযরত ফাতেমাতুজ যাহরা (রা.) ছিলেন সৃষ্টিগত ভাবেই পূতপবিত্র রমণী। আহলে বায়তের মর্যাদা বর্ণনায় আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে চান। (সূরা: আল আহযাব, পারা: ২২, আয়াত: ৩৩)

এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই যে, পৃথিবীতে সব নারীই ঋতুস্রাব কালীন মাসিক কিছু সময় অপবিত্র থাকেন, ব্যতিক্রম শুধু খাতুনে জান্নাত, হযরত ফাতেমাতুজ যাহরা (রা.)। ঋতুস্রাব, মাসিক ছাড়াই তিনি তাঁর নূরানী সন্তান জান্নাতী যুবকদের সরদার হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)সহ সব সন্তান সন্তুতিদের জন্ম দিয়েছেন। তিনি ঋতুস্রাব মুক্ত ছিলেন, এ কারণে তাঁর নামায কাজা হতোনা। তাঁর পবিত্র সত্তা ছিল পূতপবিত্র, একারণেই তিনি তৈয়্যবা, তাহেরা, যকীয়া, উপাধি অভিধায় ভূষিত। এভাবে সাদিকা (সত্য পরায়ণা) জীবনে কখনো তিনি মিথ্যাচার করেননি।

হাদীসের আলোকে হযরত ফাতেমা (রা.)’র মর্যাদা:

উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ওফাতের শেষ দিনগুলোতে হযরত ফাতেমাতুজ যাহরার কানে কানে কিছু গোপন কথা ব্যক্ত করেছেন। যা শুনার পর হযরত ফাতেমা ক্রন্দন করছেন, কিছুক্ষণ পর তিনি (ফাতেমা) মুসকি হাসি দিলেন। ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিলেন নবীজি কিছু দিনের মধ্যে ওফাত বরণ করবেন। মুসকি হাসির কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, (হে ফাতেমা) তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তুমি হবে জান্নাতী নারীদের সরদার বা তুমি হবে সব মুমীন নারীদের সরদার। (বুখারী, খন্ড: ১ম, পৃ: ৫১২, মুসলিম, খন্ড:২, পৃ: ৫৯১)

বিশ্বের চারজন মহীয়সী রমনী সবার শ্রেষ্ঠ হযরত ফাতেমা:

প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, চারজন নারী সমগ্র নারী জাতির মধ্যে সর্বোত্তম। হযরত মরিইয়ম বিনতে ইমরান, হযরত আছিয়া বিনতে মুযাহিম (ফিরআউনের নেককার স্ত্রী), হযরত খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ, হযরত ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে হযরত ফাতেমাতুজ যাহরা (রা.)। (দুররুল মনসুর, খন্ড:২য়, পৃ: ২৩, কানযুল উম্মাল, খন্ড: ৬, পৃ: ২২৭)

হযরত ফাতেমা (রা.)’র সন্তুষ্টিতে রসূলুল্লাহর সন্তুষ্টি:

হযরত মিসওয়ার বিন মাখরামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ফাতেমা আমার কলিজার টুকরা, যে তাঁকে অসন্তুষ্ট করল সে আমাকে অসন্তুষ্ট করল। (বুখারী, খন্ড: ২য়, পৃ: ৫৩২, মুসলিম, খন্ড:২য়, পৃ: ২৯০)

রাসূলুল্লাহর কাছে হযরত ফাতেমা’র মর্যাদা:

হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত ফাতেমার চেয়ে অন্য কাউকে কথাবার্তা ও আলোচনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাদৃশ্য দেখিনি। যখন তিনি নবীজির কাছে আসতেন, নবীজি দাঁড়িয়ে তাঁকে স্বাগত জানাতেন, স্নেহ মমতায় তাঁর হাতে চুমু দিতেন এবং নিজের আসনে তাঁকে বসতে দিতেন। (তিরমিযী, আল মস্তাদরাক হাকেম, খন্ড: ৩য়, পৃ: ১৫৪)

আরো এরশাদ হয়েছে, যখনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ফাতেমার কাছে যেতেন হযরত ফাতেমা নবীজির প্রতি পরম শ্রদ্ধা ও সম্মানে দাঁড়িয়ে যেতেন নবীজিকে চুম্বন করতেন এবং নিজের জায়গায় বসাতেন। (তিরমিযী, মুস্তাদরাক হাকেম, খন্ড: ৩য়, পৃ: ১৫৪)

উপরোক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, বড়রা ছোটদের প্রতি স্নেহ মমতায় দাঁড়িয়ে যাওয়া তাঁদের হাতে চুমু দেওয়া জায়েজ ও সুন্নাত।

হযরত মা ফাতেমা (রা.)’র ইবাদত বন্দেগী:

হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনার জীবনাদর্শ ছিলো নবীজির বাস্তব প্রতিচ্ছবি, নামায, রোজা, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ, তাহলীল, ইবাদত বন্দেগীতে তিনি ছিলেন অনন্য অসাধারণ গুণাবলী ও আদর্শের বাস্তব নমুনা। শেরে খোদা মওলা আলী (রা.) বর্ণনা করেছেন, হযরত ফাতেমা (রা.) খাবার রান্না করা অবস্থায়ও কুরআনুল করীম তিলাওয়াত করতেন। হযরত সালমান ফারসী (রা.) বর্ণনা করেন, একদা প্রিয় নবীজির নির্দেশে হযরত ফাতেমা (রা.)’র ঘরে গিয়ে দেখলাম, হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) দুজনই নিদ্রারত, খাতুনে জান্নাত তাঁদেরকে পাখা করছেন, আর জবান মুবারক দিয়ে পবিত্র কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করছেন। [কিমিয়ায়ে সা’দাত, ইমাম গাজ্জালী (র.)]

হযরত ইমাম হাসান (রা.) বর্ণনা করেন, আম্মাজানকে দেখেছি তিনি ঘরের মসজিদের মিহরাবে সারারাত নামাযে লিপ্ত থাকতেন, তিনি সকল মুসলিম নরনারীর জন্য অধিক পরিমান দুআ করতেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম মমতাময়ী আম্মাজান! আপনি নিজের জন্য কোন দুআ করছেন না? জবাব দিলেন প্রিয় বৎস! প্রথমে প্রতিবেশী তারপর পরিবার। (অর্থাৎ যেন আমার আব্বাজানের উম্মতের জন্য ক্ষমা নসীব হয়।) এটাই ছিল হযরত ফাতেমার দুআ। (মদারেজুন নবুওয়াত, খন্ড:২য়, পৃ: ৭৯০)

হযরত আলী (রা.)’র সাথে ফাতেমা (রা.)’র শাদী মুবারক:

মওলা আলী (রা.) সাথে খাতুনে জান্নাতের দাম্পত্য জীবনে আবদ্ধ হওয়া আল্লাহর নির্দেশেই হয়েছিল। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা আমাকে আদেশ করেছেন, আমি ফাতেমার বিবাহ যেন আলীর সাথে দিই। (তাবরানী, হাদীস :১০৩০৫)

হযরত ইমাম ইউসূফ বিন ঈসমাঈল নিবহানী (রা.)’র বর্ণনামতে ২য় হিজরিতে মহররম মাসে অন্য বর্ণনায় জিলহজ্ব মাসে এ বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় হযরত ফাতেমার বয়স হয়েছিল ১৫ বৎসর ছয় মাস, হযরত আলী (রা.)’র বয়স ২১ বৎসর ৫মাস। নবীজি হযরত ফাতেমা (রা.)কে বললেন ওহে আমার প্রিয় কন্যা, আমি আমার বংশের সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তির সাথে তোমার বিবাহ দিয়েছি। (জুরকানী)

মওলা আলী (রা.) হযরত ফাতেমার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর তাঁর জীবদ্ধশায় অন্য কাউকে শাদী করেনি। নবীজি এ বিয়েতে ১টি খাট, দুটি তোষক, ১টি চাদর, বালিশ, পানির মশক, লোটা উপহার স্বরূপ দিয়েছিলেন। বিয়ের মোহরানা ছিল পাঁচশত দিরহাম। (মুসলিম শরীফ, আনোয়ারুল হাদীস, পৃ: ৩৩২ কৃত: মুফতি জালাল উদ্দিন আহমদ আমজাদী)

ওফাত:

হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ হযরত ফাতেমাকে বলেছিলেন, আমার পরিবারের মধ্যে তুমিই সর্বপ্রথম আমার সাথে মিলিত হবে। (ফাদ্বারিলুস সাহাবা, হাদীস: ১৩৪০)

নবীজির ওফাতের পর হযরত ফাতেমা সবচেয়ে বেশী শোকাহত ও ব্যথিত হয়েছিলেন, হযরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন, তিনি অধিকাংশ সময় ক্রন্দনে অতিবাহিত করতেন। কখনো তাঁর মুখে আর হাসি দেখা যায়নি। নবীজির ওফাতের ৬ মাস পর ৩ রমজানুল মুবারক ১১ হিজরিতে মঙ্গলবার রাতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

হযরত আলী (রা.) অথবা হযরত আব্বাস (রা.) জানাযা পড়িয়েছেন। তাঁর অসীয়ত অনুযায়ী রাতেই তাঁকে জান্নাতুল বাক্বীতে দাফন করা হয়। (মদারেজুন নবুওয়ত, খন্ড:২, পৃ: ৭৯০)।

আল্লাহ সমগ্র নারী জাতিকে খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা (রা.)’র আদর্শ নসীব করুন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী); খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।