প্রবন্ধ

আজাদী আন্দোলনের কিংবদন্তি ফজলে হক খায়রাবাদী

রাশেদুল বারী

স্বর্গ থুইয়া নরক চায়বেন কখনো? সুস্থ মস্তিষ্কের কেউই চায়বে না স্বর্গসুখ ছেড়ে নরকের যন্ত্রণা বরণ করে নিতে। তবে ইতিহাসে এমনও ব্যক্তির খোঁজ মিলে যাঁরা অবধারিত বেহেশত ছেড়ে কণ্টক দোজখে নির্বাসন সানন্দে গ্রহণ করে ছিলেন। ভারত হতে ব্রিটিশদের হটাতে আন্দোলন হয়েছে বহু, প্রাণ হারিয়েছেন অনেকেই৷ যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর দাঁড়ালো তরবারিতে রক্ত প্রবাহের সাথে অন্তরে পুষে রাখা ঘৃণা ও ক্ষোভ বিসর্জন দেয়া অনেকাংশে সহজ৷ তবে পরাধীনতার শৃঙ্খল দীর্ঘদিন পায়ে বেঁধে ধুঁকে ধুঁকে মরা অনেক কঠিন!

আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী রহিমাহুল্লাহ। একজন আলিম,সুফি,ইমামে আহলে সুন্নাহ ও মুজাহিদ। আজাদী আন্দোলনের বুদ্ধিদীপ্ত সৈনিক। অন্য আলিমদের মতো তিনিও ব্রিটিশ শাসনের কর্মকর্তা হয়ে সারাটা জীবন সুখে-শান্তিতে পার করে দিতে পারতেন। তবে দেশপ্রেমিক হক্কানি আলিম ইসলাম ও দেশের প্রয়োজনে ইংরেজ হটাও আন্দোলনে যোগদান করেন৷ ফতোয়া জারি করেন- ইংরেজদের চলমান অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে জিহাদ করা মুসলিমদের উপর ফরজে আইন।

আল্লামার ফতোয়ায় মুসলমানগণ জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৮৫৭ সালে দিল্লিতে ইংরেজ বাহিনীর সাথে বাহাদুর শাহর ব্যাপক যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে প্রথমদিকে ভারতীয়রা বিজয় লাভ করে। বিজিত ভারতকে শাসন করার জন্য মুঘল সম্রাটকে আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী একটি সংবিধানও লিখে দিয়ে ছিলেন। এ সংবিধানের অক্ষত কোন কপি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে বেশ কিছু ইতিহাসবেত্তা এ সংবিধান রচনার কথা উল্লেখ করেছেন। যদি তাই হয় তবে ভারতের প্রথম সংবিধান রচয়িতা আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী।

 

অপ্রতুল রণকৌশল ও দিল্লির কোষাগার শূন্য হয়ে আসায় বেশিদিন এ স্বাধীনতা টিকেনি। ব্রিটিশরা আবার দিল্লি আক্রমণ করে নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে আসে। এবার শুরু হয় ব্রিটিশদের টর্চার পিরিয়ড। দিল্লি দখল করে তারা মারাত্মক অত্যাচার চালাতে থাকে। মানুষজন ও সিপাহিরা প্রাণ বাঁচাতে বনে জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করে। দিনের পর দিন অবরুদ্ধ থেকে অনাহারে বিপুল মানুষের মৃত্যু হয়। নির্মম, নিষ্ঠুর ও অনাকাঙ্ক্ষিত এ বিভীষিকাময় পরিস্থিতি বর্ণনা দিয়ে আল্লামা তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আস সউরাতুল হিন্দিয়াতে লিখেন “এ যেন রোজ মাহশরের কঠিন পরিস্থিতির চাক্ষুষ উপমা।”

ভারতের শাসন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হতে সরাসরি ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। একের পর এক বিদ্রোহী ও বিপ্লবীদের ধরে নিয়ে শাস্তি প্রদান করে। দিল্লির শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেয় আর আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীকে আন্দামানে নির্বাসিত করা হয়।

 

আন্দামান। একটি নির্জীব দ্বীপ। যেন দুঃখ দুর্দশায় ভরপুর নরক। এ দ্বীপের বর্ণনায় আল্লামা ফজলে হক লিখেন- “কঠোর হৃদয়ের শত্রুরা আমাকে একটি দ্বীপে (আন্দামান) নিয়ে আসে, যেখানে সূর্য ক্রমাগত আমার মাথায় তাপদাহ বিলাইতে থাকে,যেখানে কঠিন পাহাড়ি পথ এবং বিপজ্জনক রাস্তা পথচলা অসম্ভব করে তোলে। বাতাস ছিল অত্যন্ত উষ্ণ এবং পরিবেশ ছিল বিষের চেয়েও তিক্ত। খাবার ছিল তিতা করলার স্বাদের চেয়েও জঘন্য, পানি ছিল সাপের বিষের চেয়েও ক্ষারীয়। বিশাল নীলাদ্রি আকাশ যেন এক বড় মেঘের ভেলার মতো, যা দুঃখ ছাড়া আর কিছুই নাজিল করে না। পৃথিবীকে হাম ও পক্সের ছোট্ট ফুসকুড়ি দিয়ে বিন্দু বিন্দু দেখাচ্ছে এবং ঘরের ছাদ ছিদ্র হয়ে পানি ঝড়ে পড়ছে যেন আমার চোখ থেকে অশ্রু ফোঁটা ঝরছে। বায়ু এতখানি দূষিত ছিল তা অসুস্থতার একটি ধ্রুবক উৎসে পরিণত হয়। প্রায়ই মহামারি আমাদের আক্রমণ করে। অসুস্থদের সুস্থ হওয়ার কোন ফুরসতই ছিল না। যে রোগাক্রান্ত হতো সে অসুস্থ হয়ে পড়তো এবং যে অসুস্থ ছিল সে মৃত্যুর পথে নিশ্চিত যাত্রা শুরু করতো।”

আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী যখন নারকীয় যন্ত্রণায় জীবনের অন্তিম পর্যায়ের দিকে এগুচ্ছেন, তখন ভারতের অন্যান্য আলেম রূপী জালেমরা ব্রিটিশ সরকারের আমলা হয়ে রাজকীয় আয়েশে জীবন অতিবাহিত করেছেন; ইতিহাস এমনটাই সাক্ষ্য দেয়৷ ফজলে হক খায়রাবাদী, যিনি ইচ্ছে করলে স্বর্গীয় সুখের মোহনায় নিজেকে সঁপে দিতে পারতেন। কিন্তু না। তিনি যেমনতেমন কোন আলেম নয়৷ তাঁর শিরায় প্রবাহিত সাইয়িদুনা উমর ফারুকে আজমের পবিত্র ও তেজস্বী খুন৷ তাই যখনই দেশ ও ইসলামের উপর চূড়ান্ত আঘাত এসেছে তখন আর চুপ করে থাকেননি। জিহাদের ডাক দিয়েছেন। ঝাঁপিয়ে পড়েছেন জালিমের বিপক্ষে মজলুমের এই রণক্ষেত্রে। পরিশেষে সানন্দে গ্রহণ করে নিলেন রুদ্ধশ্বাস কারাগারের বন্দী জীবন। বন্দী ফজলে হকের কাছে ব্রিটিশ সরকারের শ্বেতাঙ্গ আমলারা এসেছিল যেন তিনি অন্ততঃ এ সময়ে ফতোয়া উইথড্র করে নেন। ফারুকে আজমের খুনধারী এই মর্দে মুজাহিদ এত অত্যাচারের মাঝেও ইংরেজ বিরোধী জিহাদের ফতোয়া উইথড্র করেননি। সর্বশেষে আল্লামার সন্তানাদি বাবার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বাবাকে ছাড়িয়ে নেয়ার একটা প্রচেষ্টা চালান৷ তারা ব্রিটিশ হতে বাবার কারামুক্তি আদেশ নিয়ে আসেন৷ তবে এ আদেশ নিয়ে আন্দামান পৌছুলো দেখা যায় দ্বীপবাসী সকলে মিলে একটি জানাজায় অংশগ্রহণ করছে৷ জানা গেলো জানাজার জন্য হাজির করা মাইয়াত অন্য কেউই নয় তাদেরই পিতা আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী!

২০শে আগস্ট ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ইতিহাসের এই মহান বিপ্লবী পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। আল্লামার দরগাহ সাউথ পয়েন্টে (নমক ভাট্টা) অবস্থিত, যা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার থেকে প্রায় ৫ কিমি দূরে। জায়গাটি এখন মাজার পাহাড় নামে পরিচিত। ১৯৮৪ সালে আন্দামান সফরে আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী সম্পর্কে ভারতের রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং-এর কথাগুলি Giani Zail Singh’s Speeches – II বইতে উল্লেখ করা হয়েছে-

“১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে এখানে বন্দী মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানাতে আমি আজ এখানে এসেছি। আমার তীর্থযাত্রা সমস্ত ভারতীয়দের জন্য সবচেয়ে পবিত্র এ উপাসনালয়ে।  ১৮৫৭ সালের পর যারা এখানে বন্দী হয়েছিলেন তাদের সকলের নাম জানা যায়নি। তবে ১৮৫৭ সালে খ্যাতি ছড়ানো আলামা হক খায়রাবাদী, মাওলানা লিয়াকত আলীর মতো কয়েকটি নাম আমাদের স্মৃতিতে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে যার এ  দ্বীপেই বন্দী অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছিলেন।”

 

নতুন প্রজন্মের কাছে এই নিবেদিত প্রাণ আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীর অবদান ও বিপ্লবী চেতনার ইতিহাস একেবারে অজানা৷ যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা ভুলে যাওয়া একটি জাতির জন্য মহাবিপদ। আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীসহ বহু উলামা-মাশায়েখ ও বিপ্লবীদের ত্যাগের বিনিময় আজকের এই স্বাধীনতা। তাদেরকে স্মরণ করা এবং ইতিহাস চর্চা করা আমাদের কর্তব্য।