প্রবন্ধ

ইস্তেগফার ও তাওবা

ইস্তেগফার অর্থ ক্ষমা প্রার্থনা করা। তাওবা অর্থ ফিরে আসা। তাওবা ক্রিয়ার কর্তা যদি বান্দা হয়, তখন অর্থ হবে গুনাহের কাজ থেকে প্রত্যাবর্তন করা, গুনাহ পরিত্যাগ করা। তাওবা ক্রিয়ার কর্তা যদি আল্লাহ হয়, তখন অর্থ হবে তাওবা কবুল করা ও অনুগ্রহ করা।পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন আয়াতে তাওবার পূর্বে ইস্তেগফারের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন –

 

وأن استغفروا ربكم ثم توبوا إليه يمتعكم متاعا حسنا إلى أجل مسمی ويؤت كل ذي فضل فضله

 

“আর তােমরা নিজেদের পালনকর্তা সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তার নিকট তাওবা কর। তাহলে তিনি তােমাদেরকে নির্দ্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উৎকৃষ্ট জীবনােপকরণ দান করবেন এবং প্রত্যেক অধিক আমলকারীকে বেশী করে দেবেন। (সূরা হুদ,আয়াত;৩)

 

হযরত হুদ (আ.) তার জাতিকে উদ্দেশ্যে করে বলেন-

ويا قوم استغفروا ربكم ثم توبوا إليه يرسل السماء عليكم مدرارا
“হে আমার সম্প্রদায়! তােমরা তােমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তারই নিকট তাওবা কর। তিনি আসমান থেকে তােমাদের উপর বৃষ্টিধারা প্রেরণ করবেন।(সূরা হুদ,আয়াত;৫২)

 

আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন-
ولو أنهم إذ ظلموا أنفسهم جاءوك فاستغفروا الله واستغفر لهم الرسول لوجدوا الله توابا رحيما
আর সেসব লােক নিজেদের উপর অনিষ্ট করে যদি আপনার কাছে আসত, অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রাসূলও তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন, তাহলে অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী, মেহেরবানরূপে পেত। (সূরা নিসা, আয়াত;৬৪)

 

উপরােক্ত আয়াতসমূহে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা প্রার্থনা করাকে তাওবার পূর্বে উল্লেখ করেছেন। কারণ ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমেই তাওবা করতে হয়। বান্দা যখন কৃত গুনাহের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তখন আল্লাহ তায়ালা ঐ বান্দার প্রতি দয়াবান হন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে –

واستغفروا الله إن الله غفور رحيم
“তােমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাক, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল, দয়ালু।” (সূরা মুযযাম্মিল, আয়াত; ২০)

 

হযরত আবু হােরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত,

سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول:والله إني أستغفر الله وأتوب إليه في اليوم أكثر من سبعين مرة

 

আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি- আল্লাহর কসম! আমি দৈনিক সত্তর বারের বেশী আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও তাওবা করি।” (সহীহ বুখারী শরীফ)

 

ইস্তেগফারের ফযিলত সম্পর্কে বুখারী শরীফে হযরত শাদ্দাদ বিন উস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- সর্বোত্তম ইস্তেগফার হলাে বান্দার এই দোয়া পড়া:

اللهم انت ربي لا إله إلا أنت، خَلقتني وأنا عبدك، وأنا على عهدك وعدك ما استطعت، أعوذ بك من شر ما صنعت، أبوء لك بنعمتك علي، وأبوء لك بذنبي فاغفر لي، فإنه لا يغفر الذنوب إلا أنت

“হে আল্লাহ! আপনিই আমার প্রতিপালক। আপনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। আপনিই আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি আপনার গােলাম। আমি যথাসাধ্য আপনার সঙ্গে কৃত প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারের উপর আছি। আমি আমার সব কৃতকর্মের কুফল থেকে আপনার কাছে পানাহ চাচ্ছি। আপনি আমার প্রতি আপনার যে নিয়ামত দিয়েছেন তা স্বীকার করছি। আর আমার কৃত গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। কারণ আপনি ছাড়া কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারবেনা।”

যে ব্যক্তি দিনের (সকাল) বেলায় দৃঢ়বিশ্বাসের সাথে এ ইস্তেগফার পড়বে আর সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বেই সে মারা যায়, তবে সে জান্নাতী হবে। আর যে ব্যক্তি রাতের (প্রথম) বেলায় দৃঢ়বিশ্বাসের সাথে এ দোয়া পড়বে আর ভাের হওয়ার পূর্বেই সে মারা যায়, তবে সে জান্নাতী হবে।(সহীহ বুখারী শরীফ)

হযরত গাউসুল আযম দস্তগীর আব্দুল কাদের জিলানী (র.) বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তির উপর তাওবা ফরযে আইন। কারণ কোন ব্যক্তি গুনাহ থেকে মুক্ত নয়।

আল্লামা ইমাম নববী (র.) বলেন, ওলামাগণের মতে সব ধরণের গুনাহ থেকে তাওবা করা ওয়াজিব। গুনাহ যদি আল্লাহর হক সম্পর্কিত হয় তাহলে তিনটি শর্ত রয়েছে। প্রথমতঃ গুনাহ পরিত্যাগ করা, দ্বিতীয়তঃ কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হওয়া এবং তৃতীয়তঃ ঐ গুনাহের কাজে পুনরাবৃত্তি না ঘটার প্রতিজ্ঞা করা। এ তিনটি থেকে কোন একটি পাওয়া না গেলে তাওবা শুদ্ধ হবে না। আর যদি গুনাহ বান্দার হক সম্পকীয় হয়, তবে হকদার থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। (রিয়াউস সালেহীন)

ইমাম গাযযালী (র.) বলেন, তাওবার রোকন হলাে চারটি। প্রথমত, সংঘটিত গুনাহের কারণে লজ্জিত হওয়া।

দ্বিতীয়ত, ঐ গুনাহ তাৎক্ষণিক ভাবে পরিত্যাগ
করা।

তৃতীয়ত, ভবিষ্যতে ঐ গুনাহ থেকে বিরত থাকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা।

চতুর্থত, যথাসম্ভব ঐ গুনাহের তদারকী ও ক্ষতিপূরণ করা। যেমন নামায ছুটে গেলে তাড়াতাড়ি কাযা করা। কারাে সম্পদ ছুরি করলে, তা তাড়াতাড়ি ফেরত দেওয়া এবং কাউকে গালি দিলে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া।(এয়াহিয়াউল উলুম)

নবীগণ ব্যতীত সকলেই গুনাহ করে, গুনাহ ছােট হােক বড় হােক। তবে কোন গুনাহকেই ছােট ও তুচ্ছ মনে করা উচিত নয় বরং প্রত্যেক গুনাহকে মহাপাপ মনে করে সাথে সাথে তাওবা করা উচিত। বান্দাহ কোন গুনাহকে ছােট ও তুচ্ছ মনে করলে আল্লাহর নিকট তা বড় গুনাহে পরিণত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে বান্দা গুনাহকে বড় মনে করলে আল্লাহর নিকট তা ছােট ও তুচ্ছ হয়ে যায়। সাধারণত মু’মিন ব্যক্তিরা ছােট গুনাহকেও বড় মনে করে আর পাপিষ্ট ব্যক্তিরা বড় গুনাহকেও ছােট মনে করে। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন-
إن المؤمن يرى ذنوبه كأنه قاعد تحة جبل يخاف أن يقع عليه وأن الفاجر يرى ذنوبه كذباب مر على أنفه

“মুমিন ব্যক্তি তার গুনাহ গুলােকে এত বিরাট মনে করে যেন সে একটা পাহাড়ের নিচে বসে আছে। আর সে আশংকা করছে যে, সম্ভবত: পাহাড়টা তার উপর ধ্বসে পড়বে। আর পাপিষ্ট ব্যক্তি তার গুনাহ গুলােকে মাছির মত (তুচ্ছ) মনে করে, যা তার নাকে বসে চলে যায়।(সহীহ বুখারী শরীফ) ৷

তওবা ও তওবাকারীকে আল্লাহ ভালবাসেন। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-

الله أفرح بتوبة عبده من أحدكم، سقط علی بعيره، وقد أضله في ارض فلاة
“আল্লাহ তায়ালা তােমাদের তাওবার কারণে সেই লােকটির চেয়ে বেশী খুশী হন, যে মরুভূমিতে তার উট হারিয়ে পরে তা পেয়ে যায়।(সহীহ বুখারী শরীফ)

আল্লাহ তায়ালা বলেন-
إن الله يحب التوابين ويحب المتطهرين
নিশ্চয় আল্লাহ অধিক তাওবাকারী ও অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীকে ভালবাসেন।(সূরা বাকারা,আয়াত;১২২)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
إن الله يحب العبد المؤمن من المفتن التواب
“নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ঐ মুমিন বান্দাকে ভালোবাসেন, যে গুনাহে লিপ্ত হয়ে অধিক পরিমাণে তাওবা করে। কিয়ামত পর্যন্ত তাওবার দরজা উন্মুক্ত থাকবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে ব্যক্তি গুনাহ মাফের জন্য তাওবা করবে, আল্লাহ তায়ালা তার তাওবা কবুল করবেন।(মিশকাত শরীফ) তাওবা হলাে সফলতার চাবিকাঠি। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وتوبوا إلى الله جميعا أيه المؤمنون لعلكم تفلحون

“হে মু’মিনগণ! তােমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর। যাতে তােমরা সফলকাম হতে পার।(সূরা নূর, আয়াত;৩১) তাওবা দ্বারা গুনাহ মাফ হয়ে যায়।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-
وهو الذي يقبل التوبة عن عباده ويعفو عن السيئات ويعلم ما تفعلون
“আর তিনি (আল্লাহ) তাঁর বান্দাদের তাওবা কবুল করেন, পাপ সমূহ মার্জনা করেন এবং তােমাদের কৃত বিষয় সম্পর্কে অবগত রয়েছেন।(সূরা আশ শুরা, আয়াত;২৫)

আল্লাহ তায়ালা বলেন –

ياَ أيها الذين آمنوا توبوا إلى الله توبة نصوحا عسى ربكم أن يكفر عنكم سيئاتكم ويدخلكم جنات تجري من تحتها الانهار
“তােমরা আল্লাহ তায়ালার কাছে তওবা কর আন্তরিক তাওবা। আশা করা যায় তােমাদের পালনকর্তা তােমাদের গুনাহগুলোে মােচন করে দেবেন এবং তােমাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। (সূরা আত্ তাহরীম, আয়াত;৮)

উপরােক্ত আয়াতে তাওবাকারীর জন্যে দু’টি পুরষ্কারের কথা বলা হয়েছে। প্রথমটি হলাে গুনাহ মার্জনা আর দ্বিতীয়টি হলাে সকল মুমিনের একান্ত কাম্য জান্নাতে প্রবেশ। তাওবা দ্বারা বান্দা গুনাহ থেকে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ হয়ে যায়। সুতরাং তাওবা করার পর পুনরায় গুনাহ করা অনুচিত। যদি পুনরায় গুনাহ সংঘটিত হয়ে যায় তবে পুনরায় তাওবা করতে হবে। এ ব্যাপারে হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে- হযরত আবু হােরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- নিশ্চয় বান্দা একটি গুনাহ করার পর আল্লাহর নিকট আরয করে, হে প্রভু! আমি গুনাহ করেছি, আপনি তা ক্ষমা করে দিন। তখন তার প্রভু বলেন, আমার বান্দা কি জানে যে, তার প্রভু গুনাহ ক্ষমা করে দেন এবং করবেন? আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম। অতঃপর বান্দা আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী অবস্থান করেন।তারপর সে পুনরায় গুন্নাহ করে এবং আরয করে হে প্রভু! আমি গুনাহ করে ফেলেছি। আপনি তা ক্ষমা করে দিন। তখন তার প্রভু বলেন, আমার বান্দা কি জানে যে, তার প্রভু গুনাহ ক্ষমা করে দেন এবং এ জন্যে তাকে পাকড়াও করবেন? আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম। তারপর যতদিন আল্লাহর ইচ্ছা অবস্থান করেন। অতঃপর পুনরায় গুন্নাহ করে ফেলে।আর আরয করে, হে প্রভু! আমি গুনাহ করে ফেলেছি। আপনি তা ক্ষমা করে দিন। তখন তার প্রভু বলেন, আমার বান্দা কি জানে যে, তার প্রভু গুনাহ ক্ষমা করে দেন এবং এ জন্যে তাকে পাকড়াও করবেন? আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম। সুতরাং সে যা চায় তা করতে পারবে।(মিশকাত শরীফ)

তবে এরূপ বারংবার তাওবা করা আল্লাহর সাথে উপহাস করার সমতুল্য। তাওবার মূল উদ্দেশ্যহ হলোে গুন্নাহ পরিত্যাগ করা এবং কৃত গুনাহে কারণে লজ্জিত হওয়া। তবে শয়তানের প্ররােচনায় পরে অনিচ্ছাকৃতভাবে বার বার গুনাহ সংঘটিত হলে বার বার তাওবা করা যাবে এবং আল্লাহ তায়ালা তা কবুল করবেন। হযরত আবু সাঈদ খুদুরী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, শয়তান বলেছে হে প্রভু! তােমার ইজ্জতের শপথ, আমি তােমার বান্দাকে পথভ্রষ্ট করব যতক্ষণ তাদের শরীরে প্রাণ থাকবে। তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমার ইজ্জতের, আমার জালালিয়তের এবং উচ্চ মর্যাদার শপথ! আমি তাদেরকে ক্ষমা করতে থাকব, যতক্ষণ তারা আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে।(মিশকাত শরীফ)

আল্লাহ তায়ালা বলেন-
أنه من عمل منكم سوءا بجهالة ثم تاب من بعده وأصلح فأنه غفور رحيم
“তােমাদের যে কেউ অজ্ঞতাবশত কোন মন্দ কাজ করে, অতঃপর তাওবা করে নেয় এবং সৎ ও সংশােধন হয়ে যায়, তবে তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, করুণাময়।(সূরা আল আনআম)

আল্লাহ তায়ালা আরাে বলেন-

إنما التوبة على الله للذين يعملون السوء بجهالة ثم يتوبون من قريب فأولئك يتوب الله عليهم

“অব্যশই আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে। অতঃপর অনতিবিলম্বে তাওবা করে, এরাই হলাে সেসবলােক , যাদেরকে আলাহ ক্ষমা করে দেন।(সূরা নিসা,আয়াত;১৭)

উপরোক্ত আয়াতে প্রতীয়মান হয় যপ, গুন্নাহের সাথে সাথে কাল বিলম্ব না করে দ্রুত তাওবা করে নেয়া উচিত। এতে তাওবা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
التائب من الذنب كمن لا ذنب له
“গুনাহ থেকে তাওবাকারী সে ব্যক্তির ন্যায় যার কোন গুনাহই নেই।” (মিশকাত শরীফ)

হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
كل ابن آدم خطاء وخير الخطائين التوابون

“প্রত্যেক আদম সন্তান পাপ করে থাকে, আর পাপীদের মধ্যে তারাই অধিক ভাল যারা তাওবা করে।”(মিশকাত শরীফ)

তাওবার সবচেয়ে বড় উপকারীতা হলাে খালিস অন্তরে তাওবা করে ঈমান আনলে এবং সৎকাজ করলে আল্লাহ তায়ালা তাদের গুনাহসমূহকে নেকীতে রূপান্তর করে দেবেন। পবিত্র কুরআনুল কারীমে আছে-

إلا من تاب وآمن وعمل عملا صالحا فأولئك يبدل الله سيئاتهم حسنات وكان الله غفور رحيم

“কিন্তু যারা তাওবা করে, বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎ কর্ম করে, আল্লাহ তায়ালা তাদের গুনাসমূহকে পূণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন।” (সূরা আল ফুরকান, আয়াত;৭০)

বান্দার গুনাহ যত বেশী হােকনা কেন তা আল্লাহর রহমতের সামনে অতি নগণ্য ও তুচ্ছ। তাই কোন অবস্থাতেই আল্লাহর রহমত থেকে নৈরাশ হতে নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন-

لا تقنطوا من رحمة الله إن الله يغفر الذنوب جميعا إنه هُو الغفور الرحيم

“তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইওনা। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু।” ( সূরা যুমার,আয়াত;৫৩)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, বনী ইস্রাঈলের এক ব্যক্তি নিরান্নবই জন মানুষকে হত্যা করার পর তাওবার উদ্দেশ্যে বের হলো। একজন যাহেদ ও আবেদ ব্যক্তির নিকট গিয়ে নিজের অবস্থা বর্ণনা করে এবং তাওবা কবুল হওয়ার কোন পদ্ধতি আছে কিনা জানতে চাইল। আবেদ বললেন, তােমার তাওবা কবুল হবে না। সে আবেদকেও হত্যা করে একশটি পূর্ণ করল। তারপর কোন আল্লাহওয়ালাকে তালাশ শুরু করল। তখন একব্যক্তি তাকে বলল, তুমি অমুক গ্রামে চলে যাও। সেখানে একজন বুযূৰ্গ আলিম আছেন, যিনি তােমাকে তাওবার পদ্ধতি বলে দেবেন। অতঃপর সে ঐ গ্রামের দিকে যাত্রা করল। কিছু পথ অতিক্রম করার পর সে মৃত্যু বরণ করল এবং সে তার বক্ষ ঐ গ্রামের দিকে কিছুটা ঝুঁকে দিল। এসময় রহমতের ফেরেশতা ও আযাবের ফেরেশতা এসে ঝগড়ায় লিপ্ত হল। আযাবের ফেরেশতা লােকটাকে অপরাধী সাব্যস্ত করলেন আর রহমতের ফেরেশতা তাকে তাওবাকারী সাব্যস্ত করে নেককার বলে দাবী করলেন। তখন তার এলাকা ও ঐ গ্রামের মধ্যেবর্তী স্থানকে মেপে দেখার হুকুম দেওয়া হল। আর আল্লাহ তায়ালা ঐ আলিমের গ্রামকে সেই ব্যক্তির নিকটবর্তী হয়ে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করলেন। ফেরেশতাদ্বয় যখন মেপে দেখলেন তখন লােকটিকে ঐ আলিমের গ্রামের দিকে এক বিঘত পরিমাণ নিকটবর্তী পেলেন। এভাবে আল্লাহ তায়ালা তাওবার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেন।(মিশকাত শরীফ)

একদিন হযরত মুসা (আ.)’র সময়কালে বনী ইস্রাঈলের এলাকায় অনাবৃষ্টি হয়েছিল। হযরত মুসা (আ.) তাঁর সম্প্রদায়ের লােকজন নিয়ে বৃষ্টিপাতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন কিন্তু কোথাও কোন বৃষ্টিপাতের আলামত দেখা যাচ্ছিল না। তখন তিনি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উসিলায় দোয়া করলেন- এভাবে হে আল্লাহ! তােমার কাছে আমার কোন সম্মান না থাকলেও হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সম্মানের উসিলায় আমাদের দোয়া কবুল করুন। তখন আল্লাহ তায়ালা অহী প্রেরণ করে বলেন, হে মুসা! তােমার সম্মানও আছে আমার নিকট। তবে তােমাদের উপস্থিত লােকদের মধ্যে একব্যক্তি চল্লিশ বছর যাবৎ আমার অবাধ্যতা করছে অর্থাৎ গুনাহ করছে। তার কারণে তােমাদের দোয়া কবুল হচ্ছেনা। তখন হযরত মুসা (আ.) লােকদের সম্বােধন করে বললেন, হে লােক সকল! তােমাদের মধ্যে এমন ব্যক্তি কে আছ, যে বিগত চল্লিশ বছর যাবৎ আল্লাহর নাফরমানী করছ? সে আমাদের মজলিস হতে উঠে চলে যাও। নতুবা আমাদের দোয়া কবুল হবেনা। লােকটি মনে মনে বললাে এখন যদি আমি মজলিস থেকে উঠে যাই, তাহলে সকলের কাছে আমি পাপী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাবাে। তখন লােকটি মাথায় কাপড় ঢেকে দিয়ে মনে মনে আল্লাহর কাছে তাওবা করল এবং কৃত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হলাে। এরপর বৃষ্টিপাত আরম্ভ হলাে। মুসা (আ.) আল্লাহকে বললেন, হে আল্লাহ! একটু আগে বলেছিলেন সে গুনাহগারের কারণে দোয়া কবুল হচ্ছেনা ফলে বৃষ্টিপাত বন্ধ রয়েছে। এখন কি কারণে বৃষ্টিপাত হচ্ছে? আল্লাহ তায়ালা বললেন সেই গুনাহগারের কারণেই বৃষ্টিপাত হচ্ছে। কারণ সে মনে মনে খালিস নিয়্যতে তাওবা করেছে। তখন মুসা (আ.) বললেন, হে আল্লাহ! সে ভাগ্যবান ব্যক্তি কে? আমাকে পরিচয় করিয়ে দিন। আল্লাহ বলেন, হে মুসা! যাকে গুনাহগার অবস্থায় আমি লজ্জিত করিনি এখন যখন সে তাওবা করে আমার বন্ধু হয়ে গেছে এখন কিভাবে তাকে পরিচয় করিয়ে লজ্জিত করবাে? (নুযহাতুল মাজালিস)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, সূরা নিসার চারটি আয়াত মুসলমানদের জন্য সারা দুনিয়ার চেয়ে উত্তম।

١ ) إن الله لا يغفر أن يشرك به ويغفر ما دون ذلك لمن يشاء ومن يشرك بالله فقد افترى إثما عظيما

“নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তার সাথে শরীক করে। এছাড়া বাকী সব পাপ তিনি যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করবেন আর যে আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করল সে যেন অপবাদ আরােপ করল।” (সূরা নিসা, আয়াত;৪৮)

(۲)

ولو أنهم إذ ظلموا أنفسهم جاءوك فاستغفروا الله واستغفر لهم الرسول لوجدوا الله توابا رحيما 

“আর সেসব লােক যখন নিজেদের উপর অত্যাচার (গুনাহ) করে যদি আপনার কাছে আসত, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রাসূলও যদি তাদের ক্ষমা করে দিতেন, তাহলে অব্যশই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী মেহেরবানরূপে পেত। (সূরা নিসা, আয়াত; ৬৪)

٣) إن تجتنبُوا كبائر ما تنهون عنه نكفر عنكم سيئاتكم وندخلكم مدخلا كريما

“তােমরা যদি তােমাদের নিষিদ্ধ কাজগুলাের মধ্যে গুরুতরগুলাে (কবীরা গুনাহসমূহ) পরিহার কর, তাহলে আমি তােমাদের অন্যান্য গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবাে এবং তােমাদেরকে সম্মানিত স্থানে (জান্নাতে) প্রবেশ করাবাে।(সূরা নিসা, আয়াত;৩১)

٤) ومن يعمل سوءا أو يظلم نفسه ثم يستغفر الله يجد الله غفورا رحيمًا

“কোন ব্যক্তি অপর্কম করে কিংবা নিজের উপর অত্যাচার করে অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল অতি দয়ালু পাবে। (সূরা নিসা, আয়াত; ১১০)