প্রবন্ধ

রমজানের শেষ দশক ও পবিত্র লাইলাতুল ক্বদর

সৈয়দ মুহাম্মদ জালাল উদ্দীন আযহারী

দেখতে দেখতে মাহে রামাজান আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে। আমরা এসে পৌঁছেছি এ মাসের শেষ দশকে। তবে কল্যাণের বারি বর্ষণ কিন্তু এখনো শেষ হয়ে যায় নি। বন্ধ হয়ে যায় নি তাওবার দরজা; বরং আরও বেশি সুযোগ নিয়ে আমাদের মাঝে সমাগত মাহে রামাজানের শেষ দশক।

রামাজানের শেষ দশকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রী-পরিবারসহ সারা রাত জেগে ইবাদত করতেন: উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: “রামাজানের শেষ দশক প্রবেশ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোমর বেঁধে নিতেন। নিজে সারা রাত জাগতেন এবং পরিবারের সদস্যদেরকেও জাগাতেন।” (কোমর বাঁধার অর্থ হল পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে চেষ্টা-সাধনায় লিপ্ত হওয়া।) (বুখারী-২০২৪, মুসলিম-১১৭৪)

তিনি আরও বলেন: “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাজানের শেষ দশকে (ইবাদত-বন্দেগীতে) যে পরিমাণ পরিশ্রম করতেন অন্য কোন সময় এভাবে করতেন না।” (মুসলিম-১১৭৫)

কারণ তিনি রামাজানের শেষ দশ দিন এতেকাফ করতেন। (বুখারী-২০২৫, মুসলিম-১১৭১) তিনি এরশাদ করেন, তোমরা রামাজানের শেষ দশ রাতে শবে ক্বদর সন্ধান কর। (বুখারী-২০১৭ ও মুসলিম-১১৭১)

পবিত্র লাইলাতুল ক্বদর :

‘লাইলাহ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রাত বা রজনী। আর ‘ক্বদর’ শব্দের অর্থ হলো মহিমা, মহাত্ম বা সম্মান। এই মহাত্ম ও সম্মানের কারণে একে লাইলাতুল ক্বদর, তথা মহিমান্বিত রাত বলা হয়। যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতটি আমাদের এ উপমহাদেশে ‘শবে ক্বদর’ হিসেবে পরিচিত।

ক্বদরের অর্থ :

নির্ধারণ করা, সময় নির্দিষ্ট করা ও সিদ্ধান্ত করা। অর্থাৎ লায়লাতুল কদর এমন এক রাত যে রাতে আল্লাহ প্রত্যেক বস্তুর সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করেন। তার সময় নির্দিষ্ট করেন এবং হুকুম নাযিল করেন ও প্রত্যেক বস্তুর ভাগ্য নির্ধারণ করেন। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, “ঐ রাতে সকল বিষয়ের সুষ্ঠু ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় আমার নির্দেশক্রমে” (সূরা দুখান, আয়াত-৪)

ক্বদরের রাত্রের ফযিলত ও মহাত্ম :

ক্বদরের রাত্রের ফযিলত ও মহাত্ম সম্পর্কে কুরআনুল করিমে সূরাতুল ক্বদর নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল হয়েছে। আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন এরশাদ ফরমান: (১) নিশ্চয়ই আমি একে (পবিত্র কুরআনকে) নাযিল করেছি শবে ক্বদরে। (২) শবে ক্বদর সম্বন্ধে আপনি কি জানেন? (৩) শবে ক্বদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। (৪) এই রাত্রিতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। (৫) এটা নিরাপত্তা যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (সুরা ক্বদর)

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন: “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে ক্বদরের রাতে ইবাদত করে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।” (বুখারী-৩৫ ও মুসলিম-৭৬০)

তিনি আরও এরশাদ করেন : যখন লায়লাতুল কদর আসে, তখন জিবরাঈল অন্যান্য ফেরেশতাগণের সাথে যমীনে নেমে আসেন এবং প্রত্যেক ঐ বান্দাহর জন্যে রহমত ও মাগফেরাতের দোয়া করেন যে দাঁড়িয়ে- বসে আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল থাকে। (বায়হাকী: ফাদায়েলুল আওকাত-১৪৬)

তিনি আরও এরশাদ করেন : লোক সকল! তোমাদের মধ্যে এমন এক রাত এসেছে যা হাজার মাস থেকেও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত রইলো সে সকল প্রকার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল এবং এ রাত থেকে সে-ই বঞ্চিত থাকে যে প্রকৃতপক্ষে বঞ্চিত। (ইবনে মাজাহ-১৬৩৪

লাইলাতুল ক্বদর নির্ধারণ :

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, তোমরা শবে ক্বদর তালাশ কর। রামাজানের শেষ দশকের বে-জোড় রাত্রিতে। (বুখারী-২০১৭)

সাহাবীদের মধ্যে অনেককেই স্বপ্ন দেখান হল, শবে ক্বদর (রামাজানের) শেষ সাত রাতের মধ্যে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন: “আমি দেখছি, তোমাদের সবার স্বপ্ন একই রকম- শেষ ৭ রাতেই সীমাবদ্ধ। তাই যে তা অনুসন্ধান করে, সে যেন শেষ ৭ (সাত) রাতে তা খোঁজ করে দেখে। (বুখারী-২০১৫ ও মুসলীম-১১৬৫)

তিনি আরও এরশাদ করেন: “তোমরা তালাশ করবে তাকে রামাজানের শেষ দশে- মাসের নয় দিন বাকি থাকতে, সাত দিন বাকি থাকতে, পাঁচ দিন বাকি থাকতে। (বুখারী-৩৫০৫)

উল্লেখিত হাদীসগুলো থেকে জানা যায় যে, শবে ক্বদও রামাজান মাসের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে কোনো একটিতে অর্থাৎ ২১শে, ২৩শে, ২৫শে, ২৭শে, অথবা ২৯শে রাত।

ইমামে আ’যম আবূ হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি সহ অসংখ্য ইমামদের মত হলো : অধিকতর সম্ভাবনার দিক দিয়ে রামাজান মাসের সাতাশ তারিখ শবে ক্বদর। তবে সুন্নত হলো পবিত্র রামাজানের শেষ দশকের প্রত্যেক বেজোড় রাতেই শবে ক্বদর তালাশ করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ রাতকে গোপন রেখেছেন আমাদের উপর রহম করে। তিনি দেখতে চান এর বরকত ও ফযিলত লাভের জন্য কে কত প্রচেষ্টা চালায়।

মহিমান্বিত রজনীর নিদর্শনসমূহ:

১. ক্বদরের রাত্রি তিমিরাচ্ছন্ন হবে না।
২. নাতিশীতোষ্ণ হবে। (না গরম না শীত এমন)
৩. মৃদু বায়ু প্রবাহিত হবে।
৪. উক্ত রাতে মু’মিনগণ ইবাদত করে অন্যান্য রাত অপেক্ষা অধিক তৃপ্তি বোধ করবে।
৫. এমন হতে পারে যে, আল্লাহ তা’আলা কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে তা স্বপ্নে দেখাবেন। (মুসনাদে আহমদ)
৬. ঐ রাতে বৃষ্টি হতে পারে। (বুখারী)
৭. সকালে হালকা আলোক রশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে, পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায়। অবশ্য এ আলামতটি ক্বদরের রাত অতিক্রান্ত হওয়ার পর সকাল বেলায় জানা যাবে। এর হেকমত হল লায়লাতুল ক্বদর অনুসন্ধানে বান্দাদেরকে অধিক পরিশ্রমী করে তোলা এবং যারা এ রাতের ফযীলত পাওয়ার জন্য পরিশ্রম করেছে তাদেরকে আনন্দিত করা।

ক্বদর রাতের দু’আ:

আয়েশা সিদ্দীক্বা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা বলেন: আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি ক্বদরের রাত খুঁজে পাই, তাহলে আমি ওই রাতে কী দুআ করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি বলবে, “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুভ্ভুন তুহিব্বুল আফ্ওয়া ফা’ফু আন্নী” অর্থ: হে আল্লাহ তুমি অবশ্যই ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা পছন্দ কর, তাই আমাকে ক্ষমা করে দাও। (তিরমিযী-৩৫১৩, ইবনু মাজাহ-৩১১৯)

শবে ক্বদর দু‘আ কবুলের অন্যতম রাত্রি। এই রাত্রিতে বান্দা আল্লাহর কাছে যা আরজি করে আল্লাহ পাক তাকে তা দিয়ে থাকেন প্রয়োজন অনুসারে। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন: “তোমরা আমার নিকট দু’আ করো আমি তোমাদের দু’আ কবুল করবো।”(সূরা গাফের, আয়াত-৬০)

তাই প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর দায়িত্ব-কর্তব্য হচ্ছে, রামাজান শরীফ-এর শেষ দশ দিনের প্রতি বিজোড় রাত্রিতে জাগ্রত থেকে লাইলাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদর তালাশ করা। রাত্রিতে জাগ্রত থেকে বেশি বেশি তওবা ইস্তিগফার ও ইবাদত-বন্দেগীতে কাটানো এবং যার মনে যতো আরজি রয়েছে তা আল্লাহর দরবারে পেশ করা। কেননা “যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট চায় না বা দু’আ করে না আল্লাহ পাক তার উপর অসন্তুষ্ট হন। (তিরমিযী-৩২৯৫)

কাজেই সকলের উচিত আল্লাহ পাক এবং তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্তুষ্টির জন্য, ইসলামের উপর, ঈমানের উপর অটল থাকার জন্য, দুনিয়া এবং আখিরাতের সর্বপ্রকার কল্যাণের জন্য অন্তর থেকে দু’আ করা। অবশ্যই আল্লাহ পাক তাকে এই মহিমান্বিত রাত্রির সম্মানার্থে তা দান করবেন।

লাইলাতুল ক্বদর-এর নামায:

লাইলাতুল ক্বদর-এ সুনির্দিষ্ট কোন নামায নেই। লাইলাতুল ক্বদর-এ সুন্নত-নফল অনেক নামায ও আমল করা যায়।

বিশেষভাবে লাইলাতুল ক্বদর-এর নিয়তে ৪/৬/৮/১২ রাকাআত নামায পড়া। দুরূদ ও মীলাদ শরীফ পাঠ করা। সালাতুত তাসবীহ’ আদায় করা। যিকির-আযকার করা। কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা। তাহাজ্জুদের নামায পড়া। বেশি