প্রবন্ধ

সাদক্বাতুল ফিতর কি ও কেন | সাদক্বাতুল ফিতর সম্পর্কে বিস্তারিত

সাদক্বাতুল ফিতর কি ও কেন

 

সাদক্বাতুল ফিতর’ একটি উত্তম সাদক্বাহ। পরম করুণাময় আল্লাহ তা’আলার অনন্ত-অপার বরকতের যেই ফল্গুধারা সর্বশ্রেষ্ট ও সর্বশেষ রাসূলের উম্মতের প্রতি রয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মহা বরকতমণ্ডিত ‘রমযান মাস’। প্রিয়তম রাসূল এ মাসকে বলেছেন ধৈর্যের মাস, সহমর্তিতার মাস। আল্লাহ তা’আলা এ মাসে সিয়াম সাধনার জন্য মু’মিনদের প্রতি নির্দেশ দান করেছেন

من شهد منكم الشهر فليصمه

অর্থাৎ- তোমাদের মধ্যে যে এ মাসকে পাবে, সে যেন সেটার রোযা পালন করে। রোযা পালন কেবল সোবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার আর স্বামী-স্ত্রী মিলন বর্জন এবং রাতের দীর্ঘক্ষণ জাগ্রত থাকার নাম নয়; এর সাথে রসনা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং চিন্তা-চেতনাকেও সকল প্রকার মিথ্যাচার ও অন্যায়-অনাচার থেকে হেফাযত করতে হয়। রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমাচ্ছেন

من لم يدع قول الزور والعمل به فليس لله فيهم حاجة في أن يدع شرابه وطعامه

অর্থাৎ- “যে ব্যক্তি (রোযা অবস্থায় ) মিথ্যা কথা বলা অনুরূপ কার্যকলাপ ত্যাগ করতে পারে নি, তার পানাহার ত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” বান্দা এ কঠিন সাধনায় রমযান মাস অতিবাহিত করতে পারলে আল্লাহ পাক বলেন- তোমরা নিশ্চয় মুত্তাক্বী হতে পারবে। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম এরশাদ ফরমান, এ মাসে তাক্বওয়া অর্জনকারীদের জন্য রাব্বুল আলামীন-এর দরবার থেকে যে মহা পুরস্কার রয়েছে তা হচ্ছে ‘রহমত’ অর্থাৎ অবারিত দয়া, ‘মাগফিরাত’ অর্থাৎ পাপের মার্জনা এবং ‘ইতকুম মিনান্নার’ অর্থাৎ জাহান্নাম থেকে মুক্তি।

পবিত্র কোরআনে বলছে – মহান আল্লাহর দরবার থেকে দয়া ও ক্ষমা প্রাপ্তি, যা জীবনের সমস্ত সঞ্চয় থেকে অনেক উত্তম।

فمن زحزح عن النار وأدخل الجنة فقد فاز

অর্থাৎ- “যাকে আগুন (জাহান্নাম) থেকে রক্ষা করে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে সেই সফলকাম হয়েছে।”

এ কঠোর সাধনায় যারা উত্তীর্ণ হয়ে এ নি’মাতগুলো লাভ করে ধন্য হয়েছে নিশ্চয় তারা আনন্দের বন্যায় ভাসবে, খুশী হবে, ঈদ করবে। অবশ্য এ ধরনের আনন্দঘন মূহূর্তে মানুষ আচার-আচরণে নিজের করণীয় সম্পর্কে ভুল করে বসে, কিছুটা সীমালঙ্ঘন করে বসে। তাই আল্লাহ তা’আলা নির্দেশ করেন, দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ থাকতে সবাই মিলে আনন্দ শুরু করার আগে দু’রাক’আত নামায পড়ে নাও। অন্যদিকে এ শুভ ও সুন্দরতম দিনে হুযূর রাহমাতুল্লিল আলামীন শফী উল মুযনিবীন, পাপী উম্মতের কাণ্ডারী রাসূল আপন উম্মতকে নির্দেশ করলেন, দেখ, মুত্তাক্বীদের আমলের ভুলত্রুটি সংশোধন করে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন আল্লাহ তা’আলা। তাই আজকের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার আগেই তোমাদের এ শারিরীক এবাদত ‘রোযা’র যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মোচনার্থে এবং এ আনন্দের মিছিলে সকল এতিম, আত্মীয়-স্বজন আর এলাকার গরীব-মিসকীনদেরও শামিল করতে কিছু মা-লী সাদক্বাহ করো। পরিবারে তোমাদের অধীনস্থ সকলের পক্ষ হতে এ সাদক্বাহ আদায় করো, যা গরীব ও এতিম এবং মিসকীনদের দু’বেলা অন্নের ব্যবস্থা হবে এবং এর দ্বারা মহা উপকারী এবাদত রোযাগুলো ও সামগ্রিক ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে পবিত্রতা অর্জনের ওসীলা হবে।

শরীয়তের পরিভাষায় রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর পক্ষ থেকে নিদের্শিত ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রত্যেক সামর্থ্যবান ধনী তথা মালিকের নিসাবের জন্যে অবশ্য পরিশোধযোগ্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সাদক্বাহ আদায় করাকে সাদক্বাতুল ফিতর বলে। হানাফী মাযহাব মতে এ সাদক্বাহ আদায় করা ওয়াজিব। পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছোট-বড় এমনকি নিজের মালিকানাধীন সকল ক্রীত দাস-দাসীর পক্ষ থেকেও পরিবারের কর্তাকে এ সাদক্বাহ আদায় করতে হয়। সাদক্বাতুল ফিতরের জন্য নিসাব শর্ত হলেও তা এক বৎসর যাবৎ থাকতে হবে এমন বিধান নেই। শাওয়ালের ১ম তারিখ অর্থাৎ ঈদের দিন সোবহে সাদিকের পরক্ষণেও কেউ নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী হলেই তার উপর সাদক্বাতুল ফিতর ওয়াজিব। এটা ঈদের নামাযের পূর্বে আদায় করা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। এটা আদায় না করা পর্যন্ত দায়মুক্ত হবে না; তাই নামাযের পরে আদায় করলে কিংবা জীবনের যে কোন সময় আদায় করলেও আদায় হয়ে যাবে, তবে বিলম্বের জন্য গুনাহগার হবে। উল্লেখ্য যে, ফিরার উপযুক্ত গরীব আত্মীয়-স্বজন দূরে অবস্থান করলেও তাদের জন্য ফিতরা আলাদা করে রেখে দিলে অসুবিধা নেই। সাদক্বাতুল ফিতর শুকনো খেজুর, কিসমিস, ভুট্টা, যব, চাউল এবং গম-বা আটার সুনির্দিষ্ট পরিমাণে পরিশোধ করতে হয়। গম বা আটা ছাড়া অন্যান্য বস্তু দিয়ে এক সা’ এবং গম-আটা দ্বারা হলে অর্ধ সা’ পরিশোধ করতে হয়। বর্তমানে মুসলিম দুনিয়ায় সাধরণতঃ গমের পরিমাণ বা তার স্থানীয় মূল্য হিসেব করেই সাদক্বাতুল ফিতর আদায় করা হচ্ছে। বিশুদ্ধ তাহক্বীক মতে অর্ধ সা’-এর পরিমাণ হচ্ছে আমাদের দেশীয় ওজনে দুই সের তিন ছটাক আধা তোলা যার পরিমাণ প্রচলিত মাপে দু’কে.জি ৫০ গ্রাম হয়।

সাদক্বাতুল ফিতর এবং যাকাতের খাত একই ধরনের। অর্থাৎ যাদের যাকাত দেয়া যায় তাদের ফিতরাও দেয়া যাবে। এভাবে যাকাত যাকে দেয়া জায়েয নেই তাকে ফিতরাও দেয়া যাবে না। একটি ফিতরা একজন মিসকীনকে যেমন দেয়া যায় তেমনি কয়েকজনের ফিতরাও একই মিসকীনকে দিতে বাধা নেই। আবার প্রয়োজনে একজনের ফিতরা কয়েকজন মিসকীনকেও ভাগ করে দেয়া জায়েয।

সদক্বা-ই ফিতর সম্পর্কিত কিছু মাসআলা

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, বান্দার রোযা আসমান ও যমীনের মাঝখানে ঝুলন্ত থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত সদক্বা-ই ফিতর আদায় না করে। [দায়লমী, খতীব, ইবনে আসাকির]

 

মাসআলাঃ 

সদক্বা-ই ফিতর ওয়াজিব। এর সময় সারা জীবন। অর্থাৎ যদি যথাসময়ে আদায় না করে থাকে, তাহলে যে কোন সময় আদায় করা যায়। আর আদায় না করলে বাতিল হয়ে যাবে না এবং যখনই আদায় করা হোক, ক্বাযা হিসেবেও গণ্য হবে না, বরং ‘আদা’ হিসেবেই গণ্য হবে। তবে ঈদের নামাযের আগে আদায় করাটা সুন্নাত। (দুরুল মুখতার)

 

মাসআলাঃ 

ঈদের দিনে সুবহে সাদিক্ব হওয়ার সাথে সাথে সদক্বা-ই ফিতর ওয়াজিব হয়ে যায় সুতরাং যে ব্যক্তি সুবহে সাদিকের আগে মারা গেলো কিংবা বা গরীব হয়ে গেলো, ওই ব্যক্তির উপর সাদক্বা-ই ফিতর ওয়াজিব হলো না। (আলমগীরী)

মাসআলাঃ 

সুবহে সাদিক্ব শুরু হবার আগে কাফির মুসলমান হলো বা শিশুর জন্ম হলো বা যে গরীব ছিলো, সে সম্পদশালী হয়ে গেলো, তাহলে তার উপর সদক্বা-ই ফিতর ওয়াজিব। [আলমগীরী]

মাসআলাঃ 

সদক্বা-ই ফিতর প্রত্যেক মুসলমান আযাদ ও নেসাবের অধিকারীর উপর (মূল ব্যবহারিক সামগ্রী ব্যতীত যার পূর্ণ নেসাব থাকে) ওয়াজিব। এতে বিবেকবান, বালেগ এবং এক বছর অতিবাহিত হওয়া, সম্পদের মালিক হওয়া পূর্বশর্ত নয়। | দুরুল মুখতার |

 

মাসআলাঃ 

নেসাবের অধিকারী পুরুষের উপর নিজের পক্ষ থেকে এবং নিজের ছোট ছেলে মেয়েদের পক্ষ থেকে সদক্বা-ই ফিতর ওয়াজিব। যদি শিশু নিজেই নিসাবের মালিক হয় তাহলে তার সদক্বা-ই ফিতর তার সম্পদ থেকে দেয়া যাবে। পাগল সন্তান বালেগ হলেও যদি সম্পদশালী না হয়, তাহলে তার সদক্বা-ই ফিতর তার পিতার উপর ওয়াজিব। আর যদি সম্পদশালী হয়ে থাকে, তাহলে তার সম্পদ থেকে দেয়া যাবে। [ দুরুল মুখতার ও রদ্দুল মুহতার ]

মাসআলাঃ 

সাদক্বাহ্-ই ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্য রোযা রাখা পূর্বশর্ত নয়। যদি কোন ওযর, যেমন সফর, রোগ ও বার্ধক্যের কারণে বা খোদা না করুক কোন ওজর ছাড়া এমনিতে রোযা রাখলো না, তবুও সদক্বাহ-ই ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। (রদ্দুল মুহতার ও বাহার।

মাসআলাঃ

পিতা না থাকলে দাদা পিতার স্থলাভিসিক্ত হবেন। অর্থাৎ স্বীয় এতীম গরীব নাতি-নাতনীর পক্ষ থেকে সদক্বাহ-ই ফিতর পরিশোধ করা তার উপর ওয়াজিব।

মাসআলাঃ 

নিজের স্ত্রী এবং বিবেকবান বালেগ সন্তানের সদক্বা-ই ফিতর তার যিম্মায় নয়, যদিওবা পঙ্গু হয়ে থাকে এবং তাদের ভরণপোষণের জিম্মা তার উপর থাকে।

| দুরুল মুখতার ও বাহার|

সদক্বা-ই ফিতরের পরিমাণ

সদক্বা-ই ফিতরের পরিমাণ হচ্ছে গম বা এর আটা বা ছাত্তু অর্ধ সা’ এবং খেজুর, মুনাক্কা যব বা এর আটা বা ছাত্তু এক সা’। (হিদায়া, দুরুল মুখতার, আলমগীরী)

মাসআলাঃ 

গম বা যব দেয়ার চেয়ে ওই গুলোর আটা দেয়া উত্তম। তবে আরো উত্তম হচ্ছে মূল্য দিয়ে দেয়া, তা গমের হোক বা যবের বা খেজুরের হোক। কিন্তু দুর্ভিক্ষ দুর্গত এলাকায় মূল্য দেয়ার চেয়ে খাদ্য সামগ্রী দেয়া উত্তম আর যদি নিকৃষ্ট গম বা যবের মূল্য দেয়া হয়, তাহলে ভাল গম বা যবের মূল্য থেকে যা কম হবে, তা যেন পূর্ণ করে দেয়। [রদ্দুল মুহতার]

সা’র পরিমাণ

চূড়ান্ত যাচাই করার পর এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, এক সা’র ওজন হচ্ছে তিনশ একান্ন রূপার টাকার ওজনের সমপরিমাণ এবং অর্ধ সা’ ওজন হচ্ছে একশ পাঁচাত্তর টাকা আট আনা ওজনের বরাবর। [ফতওয়ায়ে রেযভীয়া আজকালকার প্রচলিত কেজির ওজন হিসেবে এক সা’ সমান প্রায় চার কেজি একশ গ্রাম এবং অর্ধ সা’ দু’কেজি পঞ্চাশ গ্রাম হয়ে থাকে]

মাসআলাঃ 

সদক্বা-ই ফিতরের হক্বদার তারাই, যারা যাকাতের হক্বদার। অর্থাৎ যাদেরকে যাকাত দেয়া যায়, তাদেরকে ফিতরাও দেয়া যায়; তবে যাকাত উসূলকারক ব্যতীত। কারণ, ওকে সদক্বা-ই ফিতর দেয়া যাবে না।

[ দুরুল মুখতার ও রদ্দুল মুহতার ]