প্রবন্ধ

করোনাকালে ঈদুল আজহা ও কুরবানি

আসছে কুরবানির ঈদ। মহামারির অবস্থাও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা। গত বছরের তুলনায় আতঙ্ক কম থাকলেও জনগণের মধ্যে তেমন সচেতনতা বাড়েনি, যা বড় বিপদ ডেকে এনেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। জীবন-জীবিকার যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে অনেক জীবন। উপায়হীন হয়ে সরকার উভয় কুল রক্ষা করার নীতি গ্রহণ করেছে। এদিকে কুরবানির ঈদ অত্যাসন্ন। ইসলাম ধর্মীয় বিধানে সক্ষম ব্যক্তির জন্য কুরবানি দেয়া ওয়াজিব। এর সাথে উৎসবের বিষয়টি জড়িত। যদিও কুরবান অর্থ ত্যাগ, তবুও এখানে আনন্দের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত।

আনন্দ এ-জন্য যে, কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত সম্পদ খরচ করে তাঁর শুকরিয়া আদায় করা হয়। কুরবানির পশু ক্রয়, জবাই, মাংস বণ্টন, আপ্যায়ন ইত্যাদির মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক আনন্দ আছে। অন্যের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের বিষয় আছে। আছে ত্যাগের সুখ। পশু পছন্দ ও ক্রয় করা, এ উদ্দেশ্যে বাজারে ঘোরাঘুরি, কয়েকদিন পশু লালনপালন করার মাধ্যমে কমবয়স্করা ঢের আনন্দ উপভোগ করে। ঈদের মাঠে আশারাফ-আতারাফ একাকার হয়ে নামায আদায় এবং তদোত্তর কোলাকুলি, সালাম-কালাম, কুশল বিনিময়ের মধ্যেও অন্যরকম আনন্দ অনুভূত হয়। ঈদ উপলক্ষে প্রায় শহুরে গ্রামে চলে আসে। দীর্ঘদিন পর প্রিয় মানুষদের সাথে সাক্ষাত হয়। একে অপরের ঘরে দাওয়াত খায়। এভাবে হাজার বছর ধরে ঈদুল আজহার উৎসব পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু করোনা নামক অদৃশ্য শক্তি যেন সব কিছু ম্লান করে দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে আনন্দের সব পর্ব। এখন জীবন বাঁচানো দায়। কঠোর লকডাউনের মধ্যে চলছে ঈদের আয়োজন। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ীও এখন অনেক কিছু নিষিদ্ধ। তবুও ধর্মীয় দায়িত্ববোধ থেকে কুরবানির চিন্তা ও আয়োজন চলছে। এর বিকল্প আছে বলেও ফতোয়া দেয়া যাচ্ছে না। তবে ফিক্হ-ফতোয়ার কিতাবে এতটুকু আছে যে, কেউ যদি কুরবানির দিনগুলোতে (যিলহজ মাসের ১০, ১১, ১২ তারিখ) পশু না পায় অথবা যৌক্তিক কারণে কুরবানি দিতে না পারে তাহলে অন্তত একটি ছাগলের মূল্য ছদকা করে দেবে।

যা-হোক এখন চিন্তা চলছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কুরবানি দেয়ার। কেউ কেউ প্রস্তাব দিয়েছেন ছোট আকারে করার। অর্থাৎ যতটুকু না করলে নয়, ততটুকু করার। কারণ, মহামারিতে উৎসবের বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে কুরবানির দায়িত্বটি পালন করতে পারাই প্রধান লক্ষ্য। সেই আলোকে প্রস্তাব এসেছে বড় পশুর কুরবানি না দিয়ে ছোট গরু বা ছাগল দিয়ে কুরবানি দেয়ার। এটাও প্রস্তাব আছে, যারা বড় গরুর কুরবানি দেন তারা যেন বাকি টাকাটা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দারিদ্র বিমোচনের মত প্রকল্পে ছাদকায়ে জারিয়ার নিয়তে ব্যয় করেন। মহামারিতে কষ্টে পতিত বা কর্মহীন মানুষের জন্য খরচ করার প্রস্তাবও যৌক্তিক।

আসলে ইসলামি শরিয়া সামর্থবান ব্যক্তির ওপর ওয়াজিব করেছে একটি ছাগল বা ছাগল জাতীয় পশু অথবা একটি গরু বা গরু জাতীয় পশুর সাত ভাগের এক ভাগ কুরবানি। তবে বেশি দিলে ছাওয়াব বেশি। এতে দরিদ্র ও আত্মীয়স্বজনরা উপকৃত হয় বেশি। যারা অর্থাভাবে মাংস কিনে খেতে পারে না তারা কুরবানিতে মাংস খেতে পারে। দরিদ্ররা পায় কুরবানির পশুর চামড়ার টাকা। উল্লিখিত প্রস্তাবনা যৌক্তিক, শরিয়ত সম্মতও বটে। তবে এতে পশু মোটাতাজা করণ কর্মসূচির ব্যহত হবে। খামারি শিল্পের সাথে জড়িতরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্রামেগঞ্জের প্রায় ঘরে ঘরে দুই-চারটা পশু পালন করে যারা আশা করে বসে আছে তারাও আশাহত হবে। মোটাতাজা করণ করতে গিয়ে ঋণগ্রস্তরা কুরবানির বাজারে বেশি দামে পশু বিক্রি করে ঋণ মুক্ত হওয়ার আশায় বুক বেঁধেছে; তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

উপরন্তু কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে পশু পালন ও মোটাতাজা করণ কর্মসূচিকে অনুৎসাহিত করা হলে ভবিষ্যতে এর কুপ্রভাব পড়তে পারে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে বাধা সৃষ্টি হবে। তবে মোটাতাজা করণ করতে গিয়ে কৃত্রিমতার আশ্রয় নেয়া, অতিরঞ্জন করা এবং পশুর বিভিন্ন নাম দিয়ে দশ-বিশ লাখ টাকা দাম হাঁকানো আবার সেগুলো ক্রয় করে ক্রেতা নিজেকে জাহির করার প্রক্রিয়ার মধ্যে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় কোন উপকার নেই। এটি অশুভ প্রতিযোগিতা; ক্ষেত্র বিশেষে লৌকিকতা। লৌকিকতা শিরকের অন্তর্ভুক্ত।

কুরবানি একান্ত আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির নিয়তে হতে হবে। তাই একটি গরু বা গরু জাতীয় পশুর সাত শরিকের কারো উদ্দেশ্য যদি শুধু মাংস সংগ্রহ করা হয় তাহলে কারো কুরবানি হবে না। তাই এ ক্ষেত্রে অশুভ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে ওজন করে পশু ক্রয়বিক্রয় নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে।

মহামারিকালীন বড় চ্যালেঞ্জ হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে কুরবানি দেয়া। আসলে “স্বাস্থ্যবিধি মানা” কথাটি এখন বেশি উচ্চারিত হলেও বাস্তবে মানামানি খুবই কম। বর্তমান মহামারির যে চরিত্র তাতে স্বাস্থ্যবিধি বুঝাও কঠিন। স্বাভাবিক অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধিতে যারা উদাসীন তারা তো বুঝার চেষ্টা করছে না। অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও বুঝতে নারাজ। তদুপরি আছে ধর্মীয় নানান মত। এমন বাস্তবতায় সরকার একটি মধ্যপন্থার নীতি ঘোষণা করবেন বলে আশা করা যায়। যেরকম সিদ্ধান্তই আসুক, জনগণ যদি সচেতন না হয় তাহলে কোন নীতিই সুফল বয়ে আনবে না। বিশেষত ধর্মীয় বিষয়ে ধর্মীয় ব্যক্তিদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।

বর্তমান বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করে সাধারণ মানুষকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে হবে। ফতোয়া দেয়ার ক্ষেত্রে “মাকাসিদুশ্ শরিয়া” বা শরিয়ার উদ্দেশ্যগুলো সামনে রাখতে হবে। এটাও সত্য যে, বড় ও দামি পশুর কুরবানি না করে তদস্থলে ছোট গরু/মহিষ বা ছাগল দিয়ে কুরবানি দিয়ে বাকি টাকাটা ছদাকায়ে জারিয়ার খাতে বা মানুষের কষ্ট লাঘবে ব্যবহার করবে- এমন মানুষ হয়ত তেমন একটা পাওয়া যাবে না। এমনটি করা হলে মানুষের আরো বড় প্রয়োজন মিটতো। যেমন পরিবহন শ্রমিক, দিনমজুর, ননএমপিও শিক্ষক সহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ এখন অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছে। অপরদিকে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষগুলোর অবস্থা নাজুক। বড় পশুর কুরবানির চেয়ে তাদের জন্য দু’বেলা ভাতের ব্যবস্থা করা খুবই জরুরি। তাদের এখন মাংসের চেয়ে চাল-ডাল ও মাথা গোঁজানোর ঠাইয়ের প্রয়োজন বেশি। যেটার প্রয়োজন বেশি সেটার ব্যবস্থা করা যৌক্তিক, শরিয়ত সম্মত এবং এতে ছাওয়াবও বেশি। সামর্থবানরা চাইলে কুরবানির মাংসের পাশাপাশি অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীও প্রদান করতে পারেন। এতে উভয় কুল রক্ষা হবে। অযৌক্তিক আফসোস করতে হবে না যে, আমি সামর্থানুযায়ী কুরবানি করলাম না, ছেলে-মেয়েদের আবদার ও সামাজিক মান রক্ষা করতে পারলাম না।

ছোট পশুর কুরবানি হোক বা বড় পশুর, সর্বাবস্থায় মাথায় রাখতে হবে যে, করোনা সংক্রমণ ও অন্যান্য রোগ-ব্যাধি যেন না ছড়ায়। পরিবেশ দূষণের বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। পশুর বাজেটের পাশাপাশি জবাইকৃত পশুর বর্জ্য যথা সময়ে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ পূর্বক অপসারণ করার বাজেট রাখতে হবে। এটা মহামারিকালীন তো অবশ্যই, স্বাভাবিক অবস্থার জন্যও প্রযোজ্য। কারণ, ইসলাম বাস্তব ধর্ম। মানুষের কল্যাণে এর সমস্ত বিধিবিধান আরোপিত। নিজের বা অন্যের জান-মালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে, স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে কুরবানি বা অন্য কোন ইবাদত কবুল হবে মনে করা একান্তই ভুল। তাই যেনতেন ভাবে পশু জবাই পূর্বক মাংস তুলে নিয়ে নিজে খেয়ে বা অপরকে খাওয়ালে কুরবানির উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। জনবহুল বাংলাদেশে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতে হবে। পরিবেশ দূষণ করে যেন পূণ্যের কাজটি পাপে পরিণত না হয়- সেদিকে নজর রাখতে হবে।

কুরবানির জন্য কমিউনিটি সেন্টারগুলো ব্যবহার করা, কসাইখানা তৈরি করা, প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করা এখন সময়ের দাবি। সবাই একই দিনে কুরবানি না দিয়ে বাকি দুদিনের সুযোগটা কাজে লাগানোর এখনই উপযুক্ত সময়। নিষ্ঠা ফাউন্ডেশন, বিদ্যানন্দ সহ যারা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ পূর্বক মানুষের কুরবানি করে দিচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো পাড়ায় মহাল্লায় সে-রকম উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। এতে কুরবানি আনন্দ কিছুটা ম্লান হবে; কিন্তু দেশের জনসংখ্যা, বর্তমান পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির বিবেচনায় এর বিকল্প নেই। অতএব কুরবানি হোক, তবে স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে, ছোট-বড় পশুর কুরবানি হোক, তবে তা স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং পরিবেশ আইন রক্ষা করে, কুরবানির মাংস বণ্টন হোক, তবে তার সাথে অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী সহ (সামর্থ্য থাকলে), কুরবানি হোক, তবে তা লৌকিকতা মুক্ত; একান্ত সৃষ্টিকর্তার সন্তষ্টির আশায়, কুরবানি হোক পশুর; পাশাপাশি কুপ্রবৃত্তিরও (মনের পশুরে কর জবাই/পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই)- এমনটাই কাম্য।

সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।