প্রবন্ধ

ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম যুদ্ধ

লেখকঃ মুহাম্মদ মাছুম বিল্লাহ

বদর যুদ্ধকে ইসলামের ইতিহাসে প্রথম নিষ্পত্তিমূলক যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয়। মুসলিম শক্তি এ যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্ব জয়ের সোপান আরোহন করে।

এ যুদ্ধে কুরাইশ শক্তিকে পর্যুদস্ত করে মুসলমানরা প্রথম বারের মত বিশ্বময় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে।এই যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার প্রসারের দিগন্ত উন্মোচিত হয়। আর এই কারণেই বদর যুদ্ধের দিনকে বলা হয় “ইয়াওমুল ফুরকান বা পার্থক্য নিরুপণের দিন।ইসলামের ইতিহাসে এই দিনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এদিন সংঘটিত হয়েছিল বদরের যুদ্ধ। ২ হিজরির ১৭ ই রমজান মোতাবেক ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ ই মার্চ রোজ শুক্রবার। মদিনার মুসলিম ও মক্কার অমুসলিমদের মধ্যে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যা ছিল মদিনার হিজরতের ১ বছর ৬ মাস ২৭ দিন পরের ঘটণা। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কুরাইশরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মদিনা শরীফ থেকে বের করে দেওয়ার জন্য নানাবিধ অপচেষ্টা চালায়। কিন্তু তারা বর্থ্য হয়েছিল। বদর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হল নাখলার খণ্ড যুদ্ধ। ইসলামের ইতিহাসে এ প্রথম সামরিক যুদ্ধে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে। মুসলমানদের বিজয় অন্যদেরকে বার্তা পৌঁছায় যে,মুসলিমরা আরবে নতুন শক্তি হিসেবে আবিভূ্র্ত হয়েছে। কুরাইশ বণিক কাফেলার প্রস্হান এবং যুদ্ধ বাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করণীয় ঠিক করতে বিশিষ্ট সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শে বসেন।তন্মধ্যে হয়রত মিকদাদ বিন আমর (রাঃ) এর পরামর্শ অন্যতম।তিনি বলেন, আমরা আপনার সঙ্গে আছি।আল্লাহর শপথ! বনি ইসরাঈল হযরত মুসা (আঃ) কে যেমন জবাব দিয়েছিল, আমরা আপনাকে সেরুপ জবাব দিব না।কিন্তু আমরা বলব, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আপনি ও আপনার রব যুদ্ধ করুন;আমরাও আপনার সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করব।’ হযরত মিকদাদ (রাঃ) মতামত শুনে নবীজি অত্যন্ত খুশি হলেন এবং তার জন্য দোয়া করলেন। এরপর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাজির ও আনসার সাহাবিদের নিয়ে অগ্রসর হন এবং বদর প্রান্তরে পৌঁছে আল আরিসা পাহাড়ের পাদদেশে মুসলিম বাহিনীর শিবির স্হাপন করেন। ফলে পানির কূপগুলো তাদের আয়ত্তে ছিল। আর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেনা সমাবেশের জন্য এমন একটি জায়গাই বেছে নেন, যেখানে সূর্যোদয়ের পর যুদ্ধ হলে কোনো মুসলমান সেনার চোখে সূর্য কিরণ পড়বে না। অমুসলিমদের সেনাসংখ্যা ছিল ১০০০। ছিল ১০০টি ঘোড়া, ৬০০ লৌহবর্ম এবং ৭০০ উট। অমুসলিম বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন আবু জাহেল এবং সেনাপতি ছিলেন ওতবা বিন রবিআ। যুদ্ধে ৭০ জন অমুসলিম নিহত হন এবং বন্দীও হন ৭০ জন।

 

এদিকে মুসলিম বাহিনীতে সেনাসংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। মুহাজির ছিলেন ৮২ জন।৬১ জন আউস গোত্রীয় এবং খাজরাজ গোত্রের ১৭০ জন। মুসলিমদের উট ৭০ টি। প্রতি দু-তিনজন একটি উটে পালাক্রমে আরোহণ করতেন। মুসলিম বাহিনীর ঘোড়া ছিল ২টি – একটি হযরত জুবাইর ইবনুল আওয়াম( রাঃ) এর,অপরটি হযরত মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ) এর। মুসলিম বাহিনীর মুল ঝাণ্ডা ছিল হযরত মুসআব বিন উমায়র( রাঃ) এর হাতে, মুহাজির অংশের পতাকা ছিল হযরত আলী( রাঃ) এর হাতে।মুসলিম বাহিনীর ডানবাহুর নেতৃত্বে ছিলেন হযরত জুবাইর ইবনুল আওয়াম (রাঃ), বামবাহুর নেতৃত্ব হযরত মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ) এবং মধ্যবর্তী অংশের নেতৃত্বে ছিলেন হযরত কায়স বিন আবু সা’সাআহ( রাঃ)।আর পুরো বাহিনীর পরিচালন-দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছিল । যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর ১৪ জন শহীদ হন। এই যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রধান শত্রু আবু জাহেলের নিহত হওয়া। এ প্রসঙ্গে দুই কিশোরের অসীম সাহসিকতা নিয়ে একটি বীরত্বের গল্প প্রচলিত আছে। তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে।

 

চারদিকে শত্রুকে খুঁজছে সবাই। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) এক জায়গায় দাঁড়িয়ে লক্ষ করেছিলেন, শত্রুকে কীভাবে ঘায়েল করা যায়। তাঁর দুপাশে এসে দাঁড়াল দুটি বালক। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ)–কে তারা বলল, চাচা, আপনি আবু জাহেলকে চেনেন? আমাদেরকে দেখিয়ে দিন। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) আবু জাহেলকে দূর থেকে দেখিয়ে দিলেন। ছুটতে ছুটতে গিয়ে আবু জাহেলের সামনে হাজির হলো দুজন বালক। আবু জাহেল ঘোড়ায় চড়ে ছুটছিলেন। বালক দুজনের পক্ষে ঘোড়ায় চড়ে থাকা আবু জাহেলের শরীরে সরাসরি আঘাত করা অসম্ভব ছিল। একজন আক্রমণ করল আবু জাহেলের ঘোড়ায়। আরেকজন আবু জাহেলের পায়ে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করল। মুহূর্তের মধ্যেই আবু জাহেল মাটিতে গড়িয়ে পড়লেন। মাটিতে পড়েই ছটফট করতে লাগলেন তিনি। বালক দুজন সমানতালে তাঁকে আঘাত করে চলল। তারা আবু জাহেলের শরীরের ওপর চড়ে বসল। তখনো আবু জাহেল মারা যাননি। দূর থেকে বালকদের অভাবনীয় আক্রমণে আবু জাহেলের এই মরণ দশা দেখে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) এগিয়ে আসেন এবং আবু জাহেলের মৃত্যু নিশ্চিত করেন। সাহসী কিশোর দুজনের একজনের নাম হযরত মাআজ (রাঃ)। অপরজনের নাম হযরত মুআ ওয়াজ( রাঃ)।

 

বদরের যুদ্ধ সে সময় সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। মদিনার অন্য আরব গোত্রগুলো মুসলিমদের নতুন শক্তি হিসেবে দেখতে শুরু করে। যুদ্ধ জয়ের ফলে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম –এর কর্তৃত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। বদরের বন্দীদের প্রতি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করেন। এসব বন্দীকে পরে তিনি সহজ শর্তে মুক্তি দেন। অনেকেই তখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মক্কা থেকে মদিনা যাওয়ার পুরোনো রাস্তায় গেলে বদরের প্রান্তর পড়ে। মক্কা থেকে ১২০ মাইল ও মদিনা থেকে ৮০ মাইল দূরে মধ্যবর্তী স্থানে এর অবস্থান।

 

বদরের যুদ্ধ মুসলিম উম্মাহর জন্য এক নিদর্শন ও অনুপ্রেরণা লাভের অন্যতম শিক্ষা। এ যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় এটা প্রমাণ করে যে সত্যনিষ্ঠ কাজে বিজয়ের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করার পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ়তা, ধৈর্য ও সহনশীলতার বিকল্প নেই।