পরধর্ম সহিষ্ণুতার উজ্জ্বল উদাহরণ ইসলাম
সাইফুল ইসলাম চৌধুরী
সুচারুরূপে চলছিল অর্ধপৃথিবীর শাসক দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুক (রাঃ)’র খেলাফতকাল। ঠিক একই সময়ে মিসরের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ)। সে সময় একদিন আলেক জান্দ্রিয়ার খ্রিষ্টান পল্লীতে হৈচৈ পড়ে গেলো। কেউ একজন যিশু খ্রীষ্টের প্রস্তরনির্মিত মূর্তির নাক ভেঙ্গে ফেলছে। খ্রিষ্টানদের সন্দেহের তীর মুসলমানদের দিকে। তারা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। খ্রিষ্টান বিশপ অভিযোগ নিয়ে শাসনকর্তা আমর ইবনুল আস -এর কাছে আসলেন। আমর ঘটনা শুনে অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করলেন। তিনি চুক্তিপূরণ স্বরূপ মূর্তিটি নতুনভাবে তৈরি করে দিতে চাইলেন। কিন্তু খ্রিষ্টান নেতাদের প্রতিশোধ স্পৃহা ছিলো অন্যরকম। তারা চাইলো মুহাম্মদ (দ.)’র মূর্তি তৈরি করে অনুরূপভাবে নাক ভেঙ্গে দিতে।খ্রিষ্টানদের এ মতামত ব্যক্ত করার মধ্যে দিয়ে যে ঔদ্ধত্য প্রকাশ পেয়েছে, তাতে তাদের কতটুকু বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিলো তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
যে নবী (দ.) আজীবন পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, সে নবীর মূর্তি তৈরীকে মুসলমানরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারলেন না। হযরত আমর কিছুক্ষণ নীরব থেকে খ্রিস্টান বিশপকে বললেন, “আমার অনুরোধ, এ প্রস্তাব ছাড়া অন্য যে কোন প্রস্তাব করুন, তা বাস্তবায়নে আমি রাজি আছি। আমাদের যে কোন একজনের নাক কেটে আমি আপনাদের দিতে প্রস্তুত, যার নাক আপনারা চান।”
খ্রিষ্টান নেতারা সকলে এ প্রস্তাবে সম্মত হলো। পরদিন খ্রিষ্টান ও মুসলমানরা বিরাট এক ময়দানে একত্রিত হলো। মিসরের শাসক সেনাপতি আমর (রাঃ) সবার সামনে হাজির হয়ে বিশপকে বললেন, “এদেশ শাসনের দায়িত্ব আমার। যে অপমান আজ আপনাদের, তাতে আমার শাসনের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তাই তরবারী গ্রহণ করুন এবং আপনিই আমার নাসিকা ছেদন করুন।”
একথা বলেই তিনি বিশপকে একখানি তীক্ষ্ণ ধারালো তরবারী হাতে দিলেন। জনতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খ্রিষ্টানেরা স্থম্বিত। চারদিকে থমথমে ভাব। সে নীরবতায় নিঃশ্বাসের শব্দ করতেও যেন ভয় হয়। সহসা সেই নীরবতা ভঙ্গ করে একজন মুসলিম সৈন্য এগিয়ে এলো। চিৎকার করে বললো, “আমিই দোষী, সিপাহসালারের কোন দোষ নেই। আমিই মূর্তির নাক ভেঙ্গেছি, তা আমার হাতেই আছে। তবে মূর্তি ভাঙ্গার কোন ইচ্ছা আমার ছিলোনা। মূর্তির মাথায় বসা একটি পাখির দিকে তীর নিক্ষেপ করতে গিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।”
সৈন্যটি এগিয়ে এসে বিশপের তরবারীর নীচে নিজের নাসিকা পেতে দিলো। নির্বাক সকলে! বিশপের অন্তরাত্মা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো। তরবারী ছুড়ে দিয়ে বিশপ বললেন, “ধন্য সেনাপতি, ধন্য এই বীর সৈনিক, আর ধন্য আপনাদের মুহাম্মদ (দ.), যাঁর মহান আদর্শে আপনাদের মতো মহৎ উদার নির্ভিক ও শক্তিমান ব্যক্তি গড়ে উঠেছে। যিশু খ্রীষ্টের প্রতিমূর্তির অসম্মান করা হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার চাইতেও অন্যায় হবে যদি অঙ্গহানি করি। সেই মহান ও আদর্শ নবীকেও আমার সালাম।”
পরধর্ম সহিষ্ণুতার এ জলন্ত উদাহরণ আজো বিশ্ববাসিকে হতবাক করে। হযরত আলী (রাঃ) যখন মুসলিম জাহানের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, সে সময়ে একবার তাঁর ঢাল চুরি হলো। চুরি করলো একজন ইহুদী। হযরত আলী (রাঃ) আদালতের শরণাপন্ন হলেন। কাজী (বিচারপতি) খলিফা হযরত আলী (রাঃ)’র কাছে সাক্ষী চাইলেন। সাক্ষী হিসেবে খলিফা হাজির করলেন তাঁর এক ছেলে এবং চাকরকে। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে আপন সন্তান ও চাকরের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় বিধায় কাজী খলিফার অভিযোগ নাকচ করে দিলেন।
মুসলিম জাহানের অধিপতি হয়েও তিনি কোন বিশেষ বিবেচনা পেলেন না। ইসলামী আইনে শাসক-শাসিত, উঁচু-নীচু, শত্রু-মিত্র সকলেই সমান। ইহুদী বিচার দেখে অবাক বিস্ময়ে বলে উঠলো, অপূর্ব এই বিচার, ধন্য সেই বিধান যা খলিফাকে পর্যন্ত খাতির করেনা আর ধন্য সেই নবী যার প্রেরণায় এরূপ মহৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ জীবনের সৃষ্টি হতে পারে।
হে খলিফাতুল মুসলিমীন, ঢালটি সত্যই আপনার। আমিই তো চুরি করেছিলাম। এই নিন আপনার ঢাল। শুধু ঢাল নয় তার সাথে আমার জান-মাল, আমার সবকিছু ইসলামের খেদমতে পেশ করলাম।
হযরত মওলা আলী (রাঃ)’র খেলাফতকালে জনৈক মুসলিম কর্তৃক একজন জিম্মা নিহত হয়। হযরত আলী আততায়ী মুসলমানের প্রাণদন্ডের আদেশ দেন। হযরত আলী (রাঃ) সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, “আমরা যাদের জিম্মি বা দায়িত্ব নিয়েছি, তাদের রক্ত আমাদের রক্ত তুল্য। তাদের রক্ততুল্য আমাদের রক্তমূল্য।” উপর্যুক্ত ইতিহাসখ্যাত ঘটনাপ্রবহ প্রমাণ বহন করে ইসলামী শাসনব্যবস্থায় অমুসলিমদের জীবনযাত্রা, জান-মালের নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা কতটুকু ছিল। বিধর্মীদের অধিকারের ব্যাপারে মানবতার মুক্তির দূত, সারা জাহানের রহমত নবী মুহাম্মদ মোস্তফা (দ.) হাদিস শরীফে ইরশাদ করেন, “কোন অমুসলিম নাগরিককে যে অত্যাচার করলো বা তার অধিকার ক্ষুন্ন করলো বা তাকে সাধ্যাতীত পরিশ্রম করালো বা তার অমতে তার থেকে কিছু নিয়ে নিলো, কিয়ামতের দিন আমি হব তার বিপক্ষে মামলা দায়েরকারী।” তিনি আরো বলেন, “যে কোন অমুসলিম নাগরিককে কষ্ট দিলো আমি তার বাদী হব। আর আমি যার বিরুদ্ধে বাদী হবো কিয়ামতের দিন আমি হবো বিজয়ী।”
তিনি অন্যত্র বলেন, “যে সংখ্যালঘুকে উত্যক্ত করলো সে আমাকে উত্যক্ত করলো, আর যে আমাকে উত্যক্ত করলো আল্লাহকেই সে উত্যক্ত করলো।” অমুসলিম নাগারিককে হত্যা করা সম্পর্কে রাসুলে মকবুল (দ.) বলেছেন, “যে কোন সংখ্যালঘুকে হত্যা করবে সে বেহেশতের সুঘ্রাণও উপভোগ করতে পারবেনা। অথচ বেহেশতের সুঘ্রাণ চল্লিশ বছরের দূরত্ব হতেও অনুভব করা যাবে।” মানবাধিকার দিয়েছেন মহান আল্লাহ, দিয়েছেন প্রত্যেক ধর্মের মানুষকে ধর্মীয় অধিকার। অমানবিকতা কেড়ে নিয়েছেন। যেমন- যে মানব অন্য নিরহ মানুষের রক্তপিপাসু তাকে বাঁচার অধিকার দেয়নি। যে মানব অপর মানবের সন্মান নষ্ট করে তার সে অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এরকম আরো অনেক। কখনো কোন মানুষকে জোর করে ইসলামে দীক্ষিত করা, ইসলামে নিষিদ্ধ বা হারাম করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “আর আপনার রব্ব যদি চাইতেন, তাহলে পৃথীবিতে যারা আছে তারা সবাই ঈমান আনত। তবে কি আপনি মানুষের উপর বল প্রয়োগ করবেন?” বিশ্ব মানবতার নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম সুস্পষ্ট ভাষায় অমুসলিমদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য ঘোষণা দিয়েছেন, “তাঁদের রক্ত আমাদের রক্তের মতো এবং তাঁদের ধন সম্পদ আমাদের ধন সম্পদের মতো।” অমুসলিমদের জান-মাল মুসলমানদের নিজের জানমালের ন্যায় পবিত্র ও নিরাপত্তাযোগ্য।
মহানুভব বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এর প্রতিষ্ঠিত মদিনা কেন্দ্রীক ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিল একটি মৌলিক নাগরিক অধিকার পূর্ণ-সাম্যের সমাজ। প্রেমের নবী হযরত মোহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (দ.)’র প্রদর্শিত জীবন ব্যবস্থার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, “প্রাচ্য যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত, প্রাচ্যের আকাশে তখন উদিত হলো এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং অন্ধকার পৃথিবীকে তা দিলো আলো ও ¯স্বস্তি। ইসলাম একটা মিথ্যা ধর্ম নয়। শ্রদ্ধার সঙ্গে হিন্দুরা তা অধ্যয়ন করুক, তাহলে আমার মতই তারা একে অপরকে ভালোবাসবে।” পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশ যেমন- সিরিয়া, মিশর, স্পেন, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়া, প্রভৃতি দেশে শত শত বছর ধরে অমুসলিমদের অবস্থান তাদের প্রতি মুসলিমদের সহনশীলতার প্রমান বহন করে।
এ অপরিসীম সহনশীলতার জন্য মুসলিমদের হাত থেকে স্পেন অন্য ধর্মালম্বীরা দখল করে নিয়েছিল। সেখানে মুসলিমরা প্রায় কয়েকশ বছর শাসন করেছিল। কিন্তু যখন খ্রিষ্টানরা শাসন ক্ষমতা দখল করে , তখন তারা প্রথমেই মুসলিমদের বিতারিত করার কাজে হাতে নেয়। তাই রবার্টসন বলেছিলেন, “অন্য ধর্মের অনুসারিদের প্রতি সহনশীলতার ইর্ষাণিত দাবিদার এবং দাবি করার উপযুক্ত একমাত্র মুসলিমরাই, তাদের ধর্ম পালনের মাধ্যমে এমনকি যখন তারা তাদের ধর্মকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য খোলা তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয় তখন বিজিত স্থানের লোকদেরকে তাদের ধর্মমত পরিত্যাগ করার জন্য বাধ্য না করে তাদের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেন।
শতাব্দীর পর শতাব্দী মুসলমানরা অমুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার ইসলামী আইন অনুয়ায়ী দিয়ে আসলেও কিছু হলুদ সাংবাদিক, বিতর্কিত লেখক, কিছু নিছক মিডিয়া ইসলামের সুমহান আদর্শ না জানার কারনেই হোক বা সাম্প্রদায়িক মন-মানসিকতা থেকেই হোক অথবা মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষের কারনেই হোক, তারা বরাবরই ইসলামকে নিচু দেখানোর জন্য ইসলাম সম্পর্কে অপপ্রচার করতে সিদ্ধহস্ত।
সম্প্রতি দেখা মিলছে বিভিন্ন মিডিয়ার টক শো’র টেবিলে মানবতার ধর্ম ইসলাম ও মুসলমানদের সন্ত্রাস-জঙ্গি হিসেবে উপস্থাপনের দুঃসাহস। মুসলমানরা অমুসলিমদের দমন নিপীড়ন নির্যাতন করছে রূপে মিডিয়া প্রচার চালাচ্ছে। পক্ষান্তরে অমুসলিম কর্তৃক আল আমিন (বিশ্বস্ত) খেতাবপ্রাপ্ত নবী মোস্তফা (দ.)’র আদর্শে আদর্শিত মুসলমানরা এর থেকে যোজন যোজন দূরে! বরং ইতিহাস সাক্ষী দেয় একমাত্র ইসলামই নাগরিক অধিকার পূর্ণাঙ্গভাবে প্রদান করে আসছে। যুগ যুগ ধরে ইসলামের সুমহান শান্তির অমীয় সুধা সংখ্যালঘুদেরও প্রশান্তি দিয়ে চলছে, এ সত্যতা প্রমাণে এ প্রবন্ধের অবতারণা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সংগঠক
সাইফুল ইসলাম চৌধুরী
শিক্ষার্থী: ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।