প্রবন্ধ

তাকওয়া

তাকওয়ার সংজ্ঞা-

তাকওয়া শব্দটি আরবী ভাষায় বেঁচে থাকা ও বিরত থাকার অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া ভয় করা অর্থেও ব্যবহার হয়। কারণ যেসব বিষয় থেকে বেঁচে থাকা বা বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেগুলাে ভয় করারই বিষয় এবং তাতে খােদায়ী শাস্তিরও ভয় থাকে। আল মু’জামুল ওয়াসীত অভিধানে تقوى শব্দের আভিধানিক অর্থ বলা হয়েছে اخوف والخشية অর্থাৎ ভয়-ভীতি।

আল্লাহর প্রতি তাকওয়া মানে হলাে خشته وامتثال او امره واجتناب نواهيه অর্থাৎ আল্লাহকে ভয় করা, তাঁর নির্দেশ পালন করা এবং তাঁর নিষেধকৃত বিষয়সমূহ থেকে বেঁচে বা বিরত থাকা। (আল মু’জামুল ওয়াসীত)

 

ইমাম রাগিব ইস্পাহানী (র.) তাকওয়ার পারিভাষিক অর্থ বর্ণনায় বলেন-

 

وصار التقوى في تعارف حفظ النفس عما يؤثم وذلك بترك المحظور ويتم ذالك بترك بعض المباحات-

অর্থাৎ শরীয়তের পরিভাষায় নিজকে গুনাহের কাজ থেকে বিরত রাখা বা বেঁচে থাকাকে তাকওয়া বলা হয়। আর তা অর্জিত হয় নিষিদ্ধ বস্তু পরিত্যাগের মাধ্যমে এবং তা পূর্ণতা লাভ করে কিছু বৈধ কাজ পরিহারের মাধ্যম। (মুফরাদুল লুগাত)

 

মুফতি আমীমুল ইহসান (র.) বলেন-

 

التقوى هو الاحتراز بطاعة الله عن عقوبته-

অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্যের দ্বারা তাঁর শাস্তি থেকে বেঁচে থাকা।(কাওয়ায়েদুল ফিকহ)

 

আল্লামা সৈয়্যদ শরীফ জুরজানী (র.) বলেন –

 

هو الاحتراز بطاعة الله عن عقوبته وهو صيانة النفس عم يستحق به العقوبة من فعل أو ترك-

অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়া। আর তা অর্জিত হয় কোন কাজ করা বা পরিহারের দ্বারা শাস্তির উপযােগী হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা।(কিতাবুত ফিকহ)

 

আল্লামা নাছির উদ্দিন বায়যাভী (র.) বলেন-

 

وهو فى عرف الشرع اسم لمن يقى نفسه عما يضره فى الاخرة-
অর্থাৎ শরীয়তের পরিভাষায় মুত্তাকী বলা হয় ঐ ব্যক্তিকে যিনি পরকালের যাবতীয় ক্ষতিকারক বস্তু থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখেন। (তাফসীরে বায়’যাভী)

আব্বাস (রা.) বলেন, যারা ঈমানের সহিত শিরক ও কবীরা গুনাহ হতে বিরত থাকেন এবং আল্লাহর বিধি-নিষেধ যথাযথভাবে পালন করেন তারাই মুক্তাকী।

 

হযরত হাসান বসরী (র.)’র মতে, যারা হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকেন এবং ফরয কাজসমূহ পালন করেন তারাই মুক্তাকী।

 

অতএব উপরােক্ত সংজ্ঞা ও বিজ্ঞজনদের ভাষ্যানুযায়ী প্রতীয়মান হয় যে, যাবতীয় অন্যায়, নিষিদ্ধ, গর্হিত এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থেকে খােদাভীতি অন্তরে ধারণ করে আল্লাহর আনুগত্য করাকে তাকওয়া বলে।

তাকওয়ার স্তর-

সুফীয়ায়ে কিরামগণ তাকওয়াকে তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন। যথা:

প্রথম স্তর হলাে কুফর ও শিরক থেকে বেঁচে থাকা। এ অর্থে প্রত্যেক মুসলমানকেই মুক্তাকী বলা যায় যদিও মাঝে মধ্যে গুনাহে লিপ্ত হয়। আর ইহা তাকওয়ার সর্বনিম্ন স্তর।

 

 

দ্বিতীয় স্তর হলাে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপছন্দনীয় যাবতীয় বিষয় থেকে বেঁচে থাকা। ইহা বিশেষ মুমিনদের তাকওয়া। কুরআন ও হাদিসে যে সব তাকওয়ার ফযিলত ও কল্যাণ সম্পকে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা এ পর্যায়ের তাকওয়ার উপর ভিত্তি করেই হয়েছে।

তৃতীয় স্তরের তাকওয়া হলাে অন্তরকে আল্লাহ ব্যতীত সবকিছু থেকে বাঁচিয়ে রাখা এবং আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর সন্তুষ্টি কামনা দ্বারা পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধি রাখা। একমাত্র আম্বিয়া ও আউলিয়ায়ে কিরামগণই এ ধরণের তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হন। আর ইহাই তাকওয়ার সর্বোচ্চ স্তর।

 

 

পবিত্র কুরআনের আয়াত-
يا أيها الذين أمنوا الله حق تقاته
“হে মুমিনগণ! আল্লাহকে যেভাবে ভয় করা উচিত সেভাবে ভয় করতে থাকে।” (সূরা আল ইমরান, আয়াত-১০২) দ্বারা এ পর্যায়ের তাকওয়া বলা হয়েছে।

তাকওয়ার স্তর সম্পর্কে তাফসীরে জালালাইন শরীফের প্রান্ত টীকায় বলা হয়েছে –

 

التقوي على ثلاثة اقسام احدها تقوى العوام وهي اتقاء الكفر بالإيمان وثانيها الخواص وهی امتثال الاوامر واجتناب النواهی وثالثها تقوى اخص الخواص وهی اتقاء ما يشغل عن الله

 

অর্থাৎ তাকওয়া হলাে তিন প্রকার। প্রথম প্রকারের তাকওয়া হলো সাধারণত মুসলমানদের জন্য। আর তা হলাে ঈমানের সহিত কুফরী থেকে বেঁচে থাকা। দ্বিতীয় প্রকারের তাক্ওয়া হলাে বিশেষ মুসলমানদের জন্য। আর তা হলাে সকল আদিষ্ট বিষয় পালন করা এবং নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বিরত থাকা। তৃতীয় প্রকারের তাকওয়া হলাে “আখাসসুল খাওয়য়াস” বিশিষ্ট ও বিশেষ তথা সর্বোচ্চ পর্যায়ের মু’মিনগণের জন্য। আর তা হলাে-আল্লাহ বিমুখ যাবতীয় কার্যাবলী থেকে বিরত থাকা। (তাফসীরে জালালাইন)

 

 

তাকওয়ার প্রয়ােজনীয়তা ও গুরুত্ব-

তাকওয়া অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরজ। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় তাকওয়া অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং এর প্রতি বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছেন। আর আল্লাহর নির্দেশ পালন করা ফরয।

যেমন আল্লাহ বলেন-
يا أيها الذين آمنوا اتقوا الله حق تقاته
হে মুমিনগণ! তােমরা আল্লাহকে ভয় কর। যেভাবে ভয় করা উচিত। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত;১২০)

অন্যত্র বলেন-

يا أيها الذين آمنوا اتقوا الله وابتغوا إليه الوسيلة
হে মুমিন! তােমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর ওসীলা বা নৈকট্য অন্বেষণ কর। (সূরা মায়িদা, আয়াত;৩৫)

তিনি আরাে বলেন-
يا أيها الذين آمنوا اتقوا الله وكونوا مع الصادقين
হে মুমিনগণ! তােমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।

আরাে এরশাদ করেন-
يا أيها الذين آمنوا اتقوا الله وقولوا قولا سديدا

হে মুমিনগণ। তােমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক ও সত্য কথা বল। (সূরা আহযাব, আয়াত;৭০)

অন্য আয়াতে বলেছেন,
واتقوا الله واعلموا أن الله مع المتقين
“তােমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর জেনে রেখ যে, নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন। (সূরা বাকারা, আয়াত; ১৯৪)

নবী করিম এরশাদ করেন- যদি তােমরা নামায পড়তে পড়তে ধনুকের ন্যায় বাঁকা হয়ে যাও এবং রােযা রাখতে রাখতে তারের মত চিকন ও দূর্বল হয়ে যাও তবুও তাকওয়া ব্যতীত এত প্রচুর ইবাদত কোান কাজে আসবেনা।(গুনিয়াতুত তালেবীন)

হযরত হাসান বসরী (র.) একদিন মক্কা শরীফে গেলেন। সেখানে হযরত আলী (রা.)’র আওলাদগণের মধ্যে একজন সাহেবজাদা লােকদেরকে নসীহত করতে দেখে তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন- দ্বীনের স্তম্ভ বা দ্বীন রক্ষাকারী বস্তু কী? উত্তরে তিনি বলেন- তাকওয়া। তিনি পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন দ্বীন ধ্বংসকারী বস্তু কী? উত্তরে বলেন- লােভ। (প্রাগুক্ত)

হযরত হাসান বসরী (র.) বলেন- বিন্দু পরিমাণ তাকওয়া পরহেযগারী সহস্র নফল রােযা ও নফল নামায থেকে উত্তম।(প্রাগুক্ত)

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে

يا أيها الذين اتقوا الله ولتنظر نفس ما قدمت لغد واتقوا الله إن الله خبير بما تغملون

হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর। প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত, আগামী কালের জন্য সে কি প্রেরণ করে, তা চিন্তা করা। আল্লাহকে ভয় করতে থাক, তােমরা যা কর , আল্লাহ তা অবহিত।(সূরা হাশর,আয়াত;১৮)

তাকওয়া মানব চরিত্রের অন্যতম সম্পদ। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের মূল ভিত্তি হচ্ছে তাকওয়া। তাই তাকওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।

তাকওয়া মর্যাদার মাপকাঠিঃ

স্রষ্টার সামনে সৃষ্টির, মালিকের সামনে গােলামের কোন মূল্য নেই বটে, কিন্তু তাকওয়া এমন এক গুণ যা দ্বারা বান্দা আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হয়।

আল্লাহ বলেন-
إن أكرمكم عند الله أتقاكم –
নিশ্চয় তােমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই সবচেয়ে সম্মানী যে তােমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মুক্তাকী। (সূরা হুজরাত, আয়াত-১৩)

ধন-সম্পদের নাম, আর আল্লাহর কাছে ইজ্জত হচ্ছে তাকওয়া-পরহযগারীর নাম। হযরত হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন- দুনিয়ার মানুষের কাছে ইজ্জত হচ্ছে ধন-সম্পদের নাম, আর আল্লাহর কাছে ইজ্জত হচ্ছে তাকওয়া-পরহযগারীর নাম।

হযরত বেলাল হাবশী (রা.) একজন কৃষ্ণবর্ণ কৃতদাস হওয়া সত্বেও মক্কা বিজয়ের দিন বায়তুল্লাহর ছাদে উঠে আযান দেওয়ার মর্যাদা লাভ করেছেন তাকওয়া ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি নিখুঁত ভালবাসা পােষণ করার কারণে। শুধু এতটুকু নয় বরং তাঁর পদচারণের জুতার শব্দ শুনেছেন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি’রাজের রাতে। যার আযান না শুনলে আরশ আযমের ফেরেশতাদের সকাল হতনা। আর আল্লাহর নিকট যে মর্যাদাবান হয়ে যায়। সমগ্র সৃষ্টির কাছেও সে মর্যাদাবান হয়ে যায়। নবী করিম এরশাদ করেন-
من سره ان يكون اكرم الناس فليتق الله-

“যে ব্যক্তি মানুষের নিকট অধিক সম্মানিত হতে চায়, সে যেন আল্লাহকে ভয় করে অর্থ্যাৎ খােদাভীতি অর্জন করে।”

হযরত বিশর হাফী (র.) আল্লাহকে এতবেশী ভয় করতেন যে, আল্লাহ প্রদত্ত বিছানা তথা মাটির উপর জুতা পরে হাটতেন না। ফলে জীব-জন্তু পর্যন্ত তাকে এমন সম্মান এবং ভয় করত যে, তার চরণযুগল অপবিত্র হবে বলে তাঁর চলার পথে মল-মূত্র ত্যাগ করতনা।

মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.) তাফসীরে কবীরের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি মানুষের কাছে সম্মানিত হতে চায়, সে যেন আল্লাহকে ভয় করে এবং তাকওয়া- পরহেযগারী অর্জন করে। (তাফসীরে নঈমী)

হযরত আলী আত্তার (র.) বলেন, আমি একদিন বসরার একটি গলি দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেখানে কয়েকজন বয়স্ক বুযু্র্গলােক বসে আছেন। তাতে পাশে বালকরা খেলা করছে। আমি বালকদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম- এ সব বুযুর্গ ব্যক্তিদের সামনে খেলা করতে তােমাদের লজ্জা হয়না? তাদের মধ্যে একজন বালক বলল, যেহেতু ঐ বুযু্গদের মধ্যে তাকওয়া কমে গিয়েছে বিধায় তাদের প্রতি ভয়ও কমে গিয়েছে। (গুনিয়াতুত তালেবীন)

তাকওয়া সাফল্যের চাবিকাঠিঃ

তাকওয়া দুনিয়া-আখিরাতের সাফল্যের চাবিকাঠি ও গ্যারান্টি। আল্লাহ তায়াল এরশাদ করেন-
فاتقوا الله يا أولي الالباب لعلكم تفلحون
হে বুদ্ধিমানগণ! আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তােমরা সফল হও। (সূরা মায়িদা,আয়াত-১০০)

যারা তাকওয়া অর্জন করেছে এবং সংশােধন হয়েছে তাদের কোন ভয় নেই। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক বলেন-
واتقوا الله أن الله مع المتقين
তােমরা আল্লাহকে ভয় কর, আর জেনে রেখ, আল্লাহ মুকত্তাকীদের সাথে আছেন। (সূরা বাকারা, আয়াত -১৯৪)

অপর আয়াতে বলেছেন-
إن الله يحب المتقين
নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালবাসেন।(সূরা তাওবা, আয়াত -৪)

অন্য আয়াতে বলেছেন-
إن الظالمين أولياء بعض والله ولي المتقين

যালিমরা একে অপরের বন্ধু, আর আল্লাহ হলেন মুক্তাকীদের বন্ধু।(সূরা জাসিয়া, আয়াত-১৯)

পবিত্র কুরআনে আরাে বলা হয়েছে-
ومن يتق الله يجعل له مخرجا ويرزقه من حيث لا يحتسب
যে আল্লাহকে ভয় করবে আল্লাহ তাকে বিপদাপদ থেকে নিস্কৃতি দেবেন এবং তাকে ধারণাতীতভাবে রিযিক দান করবেন। (সূরা তালাক, আয়াত-২৩)

অতএব মুক্তাকীদের কোন ভয় নেই, তাদের সাথে আল্লাহ আছেন। আল্লাহ তাদের বন্ধু, তিনি তাদের বিপদাপদ থেকে উদ্ধার করেন এবং তাদের রিযিকের ব্যবস্থা করেন- ইহাই তাে সফলতা।

তাকওয়া জান্নাত পাওয়ার উপায়ঃ

কুরআন মাজীদে আরাে বলা হয়েছে-
إن المتقين في جنات وعيون
নিশ্চয় মুত্তাকীরা (কিয়ামত দিবসে) নিরাপদ স্থানে থাকবে- উদ্যানরাজি ও নির্বরণীসমূহে থাকবে। (সূরা দুখান, আয়াত- ৫১ ও ৫২)

আরাে বলা হয়েছে –
إن المتقين في الجنة والنهار
নিশ্চয় মুত্তাকীরা জান্নাতেও এর নির্বরণীতে থাকবে।(সূরা কামর, আয়াত-৫৪)

إن المتقين في جنات ونعيم ، فاکهين بما آتاهم ربهم ووقاهم ربهم
নিশ্চয় মুক্তাকীরা থাকবে জান্নাতে ও নেয়ামতে, তারা উপভােগ করবে, যা তাদের পালনকর্তা তাদের দেবেন এবং তিনি জাহান্নামের আযাব থেকে তাদেরকে রক্ষা করবেন। (সূরা তূর, আয়াত-১৭ও১৮)

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে –

وسيق الذين أتقوا ربهم إلى الجنة زمرا حتی إذا جاءوها وفتحت أبوأبها وقال لهم خزنتها سلام عليكم طبتم فادخلوها خالدين

যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করত তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা উন্মুক্ত দরজা দিয়ে জান্নাতে পৌছবে তখন জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে- তােমাদের প্রতি সালাম, তােমরা সুখে থাক। অতঃপর সর্বদা বসবাসের জন্য তােমরা জান্নাতে প্রবেশ কর। (সূরা যুমার, আয়াত-৭৩)

আল্লাহ আরাে বলেন-
وسارعوا إلى مغفرة من ربكم وجنة عرضها السماوات والارض أعدت للمتقين
তােমরা তােমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও, যার প্রশস্ত হচ্ছে আসমান ও জমিন সমান, যা তৈরী করা হয়েছে মুক্তাকীদের জন্য। (সূরা আলে ইমরান,আয়াত;১৩৩)

তিনি আরাে বলেন-
قل أؤنبئكم بخير من ذلكم للذين اتقوا عند ربهم جنات تجري من تحتها الأنهار خالدين فيها وأزواج مطهرة رضوان من الله

বলুন, আমি কি তােমাদেরকে এ সবের চেয়ে উত্তম বিষয়ের সন্ধান দেবাে? যারা মুত্তাকী তাদের জন্য আল্লাহর নিকট রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশে প্রস্রবণ প্রবাহিত। তারা সেখানে থাকবে অনন্তকাল। আর রয়েছে পরিচ্ছন সঙ্গীনীগণ এবং থাকবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত;১৫)

আল্লাহর নিয়ামত ও দানের মধ্যে সর্বোত্তম দান হলাে তাঁর সন্ভষ্টি। এ কারণে সুফিয়ায়ে কিরামগণের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য জান্নাত কিংবা জান্নাতের বিভিন্ন প্রকারের নিয়ামত নয় বরং তাদের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলাে আল্লাহর সন্তুষ্টি যা সবকিছুর মূল। যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছে দুনিয়া-আখিরাতের যাবতীয় নিয়ামত ও সফলতা তার পদচুম্বন করবে। আর এ সন্তুষ্টি অর্জিত হয় তাকওয়া দ্বারা।

আল্লাহ মুক্তাকীদের সম্পকে আরাে বলেন-
لكن الذين اتقوا ربهم لهم جنات تجري من تختها الأنهار خالدين فيها نزلا من عند الله وما عند الله خير للابرار

কিন্তু যারা নিজেদের পালনকর্তাকে ভয় করে, তাদের জন্য রয়েছে এমন জান্নাত যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত রয়েছে প্রস্রবণ। তাতে আল্লাহর পক্ষ হতে সবর্দা আপ্যায়ন চলতে থাকবে। আর যা আল্লাহর নিকট রয়েছে তা সৎকর্মশীলদের জন্য একান্তই উত্তম।

তাকওয়া মাগফিরাতের উপায়ঃ

পবিত্র কুরআনে কারীমে আল্লাহ তায়ালা তাকওয়া অর্জনকারী মুত্তাকীদের জন্য মাগফিরাত ও ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

আল্লাহ বলেন-
يا أيها الذين آمنوا إن اتقوا الله يجعل لكم فرقانا ويكفز عنكم سيئاتكم ويغفر لكم والله ذو الفضل العظيم
হে মুমিনগণ!তােমরা যদি আল্লাহকে ভয় করতে থাক, তবে তিনি তােমাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেবেন, তােমাদের পাপ মােচন করবেন এবং তােমাদের ক্ষমা করবেন। বস্তুত আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহশীল। (সূরা আনফাল, আয়াত;২৯)

অন্য আয়াতে বলেছেন-

ومن يتق الله يكفر عنه سيئاته ويعظم له أجرا
যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার পাপসমূহ মােচন করেন এবং তার পুরস্কার বাড়িয়ে দেন। (সূরা তালাক, আয়াত;৫)

উপরােক্ত আয়াতসমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তাকওয়ার মধ্যে নিম্নোক্ত কল্যাণসমূহ বিদ্যমান।

১. ইহকাল ও পরকালের যাবতীয় বিপদাপদ থেকে মুক্তিলাভ।
২. কল্পনাতীত রিযিক প্রাপ্ত হওয়া।
৩. সব কাজ সহজ হওয়া।
৪.ক্ষমা ও পাপ মােচন।
৫. বাড়তি পুরস্কার লাভ।
৬. সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করার যােগ্যতা অর্জন।
৭.নির্ভিক হওয়া।
৮. আল্লাহ সাথে থাকা।
৯. আল্লাহর বন্ধু হওয়া।
১০.আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা,
১১.সষ্টা ও সৃষ্টির নিকট মর্যাদাবান হওয়া,
১২. জান্নাত ও জান্নাতের যাবতীয় নিয়ামতের অধিকারী হওয়া।
১৩. সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

তাকওয়া অর্জনের উপায়ঃ

পবিত্র কুরআনে যে সব জায়গায় তাকওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা শুধু মুমিনদেরকেই উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। কেননা, তাকওয়ার জন্য ঈমান পূর্বশর্ত।

ঈমানবিহীন তাকওয়া বস্তুত তাকওয়াই নয় বরং ভণ্ডামী। ঈমানের সাথে সগীরা ও কবীরাসহ যাবতীয় গুনাহ থেকে অন্তরকে পবিত্র রাখার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন সম্ভব। কারণ অন্তরের গুনাহই সমস্ত গুনাহের মূল। যেমন- রিয়া, নিফাক, অহংকার, লােভ, অন্যের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ, ক্রোধ ইত্যাদি। নফসের চাহিদার বিরুদ্ধে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর উপর সাের্পদ করার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে এ সব গুনাহ থেকে বিরত থাকার শক্তি অর্জিত হয়।

গাউছে পাক (র.) বলেন- মানুষ নিম্নোক্ত দশটি বস্তুকে যতক্ষণ পর্যন্ত যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করবেনা ততক্ষণ পর্যন্ত তার পরিপূর্ণ তাকওয়া অর্জিত হবেনা।
১. যবান তথা জিহ্বাকে গীবত থেকে বিরত রাখা।
২. কারাে প্রতি মন্দ ধারণা থেকে বিরত থাকা।
৩. ঠাট্টা-বিদ্রোপ পরিত্যাগ করা।
৪. নাজায়েয বস্তু থেকে চক্ষু বন্ধ রাখা।
৫. সত্য কথা বলা।
৬.আল্লাহর ইহসান ও দয়া স্বীকার করা।
৭. আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা।
৮. পার্থিব জীবনে উন্নতি কামনা না করা।
৯. সময়মতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা।
১০. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের উপর অটল থাকা।(গুনিয়াতুত তালেবীন)

তাকওয়া ও মুক্তাকীর আলামতঃ

তাক্ওয়া ও মুক্তাকীর কতিপয় আলামত ওলামায়ে কিরাম ও সুফিয়ায়ে কিরাম থেকে বর্ণিত আছে, ইমাম মালিক (র.) বলেন, ওহাব ইবনে কায়হান আমাকে বলেছেন যে, মদীনায় জনৈক ফকীহ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.)’র নিকট লিখেছেন যে, তাকওয়ার কতিপয় আলামত আছে, যা দ্বারা তাদেরকে চেনা যায়। যেমন- মুসিবতে ধৈর্য্য ধারণ করা, আল্লাহর হুকুমে সন্তুষ্ট থাকা, নিয়মিত প্রাপ্ত শোকর করা, আল্লাহর আহকাম যথাযথভাবে পালন করা এবং তাঁর অনুগত হওয়া।(প্রাগুক্ত)

কেউ কেউ বলেন-মানুষের তাকওয়া তিনটি বস্তু দ্বারা চেনা যায়। ১. যে বস্তু সে পাবেনা এবং ঐ বস্তু পর্যন্ত পৌছতেও পারবেনা এর উপর তাওয়াকুল করী, ২. যে বস্তু পেয়ে গেছে তার উপর সন্তুষ্ট থাকা এবং ৩. যে বস্তু চলে গিয়েছে বা হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে তার উপর সবর করা। (প্রাগুক্ত)

তবে তাক্ওয়ার সব চেয়ে বড় আলামত হলাে গুনাহের উপর কায়েম না থাকা। যারা মুত্তাকী তাদের থেকে ভুলক্রমে কোন গুনাহ সংঘটিত হলে তাওবা না করা পর্যন্ত তাদের অন্তর শান্তি হয়না। যেমন সাহাবায়ে কিরাম কোন গুনাহ করলে সাথে সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে গিয়ে অকপটে অপরাধ স্বীকার করে তাওবা করে নিষ্পাপ হয়ে যেতাে। তাদের কাছে লােকে কি বলবে- এই ভয়ের চেয়ে খােদার ভয় তথা তাকওয়া বেশী চিল। তাই খােদাভীতিই হলাে তাকওয়ার উজ্জ্বল আলামত।

মােদ্দাকথা হলাে সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায়, হাসি- কান্নায়, দিনে-রাতে, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিতে, জীবনে- মরণে সর্বাবস্থায় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিজেকে আল্লাহর কাছে সাের্পদ করাই হলাে তাকওয়ার আলামত।

তাকওয়ার উপমাঃ

মুক্তাকী পরহেযগার আলিম ও সুফী-সাধকগণ থেকে তাকওয়ার যে সব বাস্তব চিত্র প্রকাশিত হয়েছে তা সাধারণ মানুষের জন্য দূর্লভ হলেও অন্তত সামান্যতমও নিজের জীবনে বাস্তবায়ন ও প্রতিফলন করার মানসে তাকওয়ার কয়েকটি উপমা পেশ করতে প্রয়াস পাচ্ছি।

বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবনে সীরিন (র.) চল্লিশ পাত্র ঘি ক্রয় করেছেন। তাঁর খাদেম একটি পাত্র থেকে মৃত ইঁদুর বের করেছে। কিন্তু কোন পাত্র থেকে বের করেছে তা নিশ্চিত না হওয়ায় সমস্ত ঘি সহ পাত্র ফেলে দেয়ার নির্দেশ দেন। (প্রাগুক্ত)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি সিরিয়ায় হাদিস লিখতে গিয়ে তার কলম ভেঙ্গে গিয়েছিল। তিনি কোন এক ব্যক্তি থেকে একটি কলম ধার নিলেন। কিন্তু কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর কলম ফেরত দিতে ভুলে যান এবং সিরিয়া থেকে মরু পৌঁছে দেখেন কলম তার কাছে রয়ে গেছে। তিনি শুধু একটি কলম ফেরত দেওয়ার জন্য পুনরায় মরু থেকে সিরিয়া গিয়ে তা ফেরত দেন। (প্রাগুক্ত)

গাউছে পাক (র.)’র সম্মানিত পিতা হযরত ছালেহ জঙ্গী (র.) নদীতে পাওয়া একটি ফল থেয়ে সেই ফলের মূল্য পরিশােধ করতে গিয়ে জীবনের একটি অংশ ব্যয় করতে দ্বিধাবােধ করেন নি।

হযরত কাহাশ (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি তাঁর এক প্রতিবেশীর দেয়াল থেকে বিনা অনুমতিতে মেহেমানের হাত পরিষ্কার করার জন্য একটু মাটি নিয়েছিলেন। সে গুনাহের লজ্জায় তিনি চল্লিশ বছর পর্যন্ত কেঁদে ছিলেন। (প্রাগুক্ত)

এভাবে ইমাম আবু হানিফা (র.) তাঁর শরীকদারের নিকট ব্যবসার কাপড় প্রেরণ করেন যাতে একটি কাপড় ক্রুটিযুক্ত ছিল। তিনি শরীকদারকে বলেছিলেন এই কাপড় বিক্রি করলে ক্রুটি উল্লেখ করবে। কিন্তু শরীকদার ক্রুটি উল্লেখ করতে ভুলে যান এবং ঐ কাপড় বিক্রি করে দেন। আর কার কাছে বিক্রি করেছেন অর্থাৎ ক্রেতা কে তাও মনে ছিলনা। ইমাম সাহেব যখন এ ব্যাপারে অবহিত হলেন, তখন ঐ দিনে বিক্রিত যাবতীয় মূল্য তিনি সদকা করে দিলেন যার তৎকালীন মূল্য ছিল ত্রিশ হাজার দিরহাম। (আল খায়রাতুল হিসান)

এতদ্ব্যতীত আরাে এমন অনেক মুত্তাকী বু্র্যুগানে দ্বীন আছেন যারা জীবনযাপনে এতবেশী তাকওয়া- পরহেযগারী এবং সর্তকতা অবলম্বন করেছেন যে, বহু হালাল ও বৈধ কাজও কেবল সন্দেহের কারণে ত্যাগ করেছেন এবং তাঁদের জীবনে মাকরূহ কাজ তাে দূরের কথা খেলাফে আওলা তথা অনুত্তম কাজও খুঁজে পাওয়া দুস্কর।