জুমার-খুৎবা

ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব | জুমার খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

জুমার খুতবা

১৬ রজব|১৪৪৩ হিজরি|শুক্রবার|১৮ ফেব্রুয়ারি’২২

“ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব”

 

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! জেনে রাখুন, একমাত্র আল্লাহই পৃথিবীর সব ভাষার স্রষ্টা। বিশ্ববাসীর ভাষার বৈচিত্র ভিন্নতা ও স্ব স্ব জাতির ভাষায় নবী রাসূল ইসলাম ও তাওহীদকে অনুধাবন করা তাঁরই শ্রেষ্ঠত্ব ও মহানত্বের উজ্বল নিদর্শন।

আল কুরআনের আলোকে ভাষার গুরুত্ব:

ভাষা ও বর্ণের সৃষ্টির মাধ্যমে মহান আল্লাহ তাঁর অনুপম সৃষ্টির মহিমাই ঘোষণা করেছেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র, এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে। (সূরা: ৩০ রুম, আয়াত: ২২, পারা: ২১)

পবিত্র কুরআনে আরো এরশাদ হয়েছে, “আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তাঁর স্ব-জাতির ভাষায় প্রেরণ করেছি। যাতে করে সে তাদের কাছে আমার আয়াত স্পষ্ট করে বর্ণনা করতে পারে। (সূরা: ইবরাহীম, ১৪:৪)

ভাষা ভাব প্রকাশের মাধ্যম:

মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, “করুণাময় মানুষকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা। (সূরা: আর-রাহমান, ১-৪)

মনের ভাব প্রকাশের ভঙ্গিই ভাষা, তা কণ্ঠধ্বনির মাধ্যমে হোক বা অন্যকোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ইশারার মাধ্যেমে হোক।

পারিভাষিক অর্থে, কারো কণ্ঠ নি:সৃত অর্থবোধক ধ্বনিকেই ভাষা নামে অভিহিত করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বৈচিত্র সংস্কৃতির সমন্বয়ে বিশ্ব মানবতার প্রকাশ ও বিকাশ ঘটে। ইসলাম পৃথিবীর কোন ভাষা ভাষীর প্রতি হিংসা বিদ্বেষ পোষণ করা, উগ্রজাতীয়তাবাদ, গোষ্ঠীবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ, বর্ণবাদ, স্বীকার করেনা। পৃথিবীর সব ভাষার প্রতি সম্মানবোধই ইসলামের শিক্ষা। ভাষা কোন মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড নয়। ভাষাগত শ্রেষ্ঠত্বের চেয়ে নৈতিকতা ও তার বাস্তব রূপায়নই তার শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি।

মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্ব:

আমাদের মহান নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মাতৃভাষার প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, মাতৃভাষার সঠিক ও শুদ্ধ উচ্চারণ, এর অনুশীলন, চর্চা ব্যবহার ও গবেষণার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন। আমরা আমাদের ধর্মীয় ও জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতি, তাহজীব তমুদ্দুন শিক্ষা ও দর্শন মাতৃভাষার মাধ্যমে তুলে ধরে একটি সুন্দর ও আদর্শ সমাজ বিনির্মানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারি। বিশিষ্ট ভাষা বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, মাতা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি মানুষের শ্রদ্ধার বস্তু।

পৃথিবীর দেশে দেশে মাতৃভাষায় ইসলাম প্রচার:

আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্ব শেষ নবী। তাঁর পর আর কোন নবীর আগমন হবেনা। পূন্যাত্ন সাহাবায়ে কেরাম, সূফী সাধক ও আউলিয়ায়ে কেরামের মাধ্যমে পৃথিবীর দেশে দেশে ইসলামের অমীয় বানী প্রচারিত ও প্রসারিত। ইসলাম প্রচারকগন, সুদুর আরব ইয়েমেন, ইরান, ইরাক, মিসর, বুখারা সমরকন্দ, খোরাসান, তুরস্ক, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হতে ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে এদেশে এসে প্রথমে এদেশের ভাষা আয়ত্ব করেছেন, মানুষের মাঝে শান্তির ধর্ম ইসলামের বানী প্রচার করে ইসলামের আদর্শ ও সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন। মানুষ তাঁদের ব্যবহারিক আদর্শে মুগ্ধ হয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রিত হয়েছেন।

হাদীস শরীফের আলোকে ভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা:

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমরা তিনটি কারণে আরবী ভাষাকে ভালবাস। আমি আরবভাষী, কুরআন আরবি, জান্নাতবাসীদের ভাষা আরবি। (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস : ১৬১০)

নবীজি আরো এরশাদ করেছেন, আমি সর্বাপেক্ষা শুদ্ধভাষী, নবীজির উচ্চারণ পদ্ধতি ছিল সর্বাধিক বিশুদ্ধ, ভাষা প্রয়োগে নবীজির প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ ও বাক্য ছিল ব্যাপক অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি এরশাদ করেছেন, আমাকে ব্যাপক অর্থবহ কথা বলার যোগ্যতা দেয়া হয়েছে। (বুখারী শরীফ)

নবীজি কখনো অশ্লীল ও অশালীন ভাষায় কথা বলতেন না। কারো প্রতি অভিসম্পাৎ করতেন না, গালমন্দ করতেন না।(সহীহ বুখারী শরীফ)

আল্লাহ তা’আলাই সব ভাষার স্রষ্টা:

কোন ভাষার প্রতি অসম্মান ও অশ্রদ্ধা ইসলাম সমর্থন করে না। সব ভাষাই আল্লাহর দান। হযরত মুসা আলাইহিস সালাম’র উপর অবতীর্ণ আসমানী কিতাব তাওরীত শরীফ হিব্রুভাষায়, ঈসা আলাইহিস সালাম’র উপর ইঞ্জিল শরীফ সুরয়ানি ভাষায়, দাউদ আলাইহিস সালাম’র উপর যবুর শরীফ ইউনানী ভাষায়, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উপর কুরআন মজীদ আরবী ভাষায় মহান আল্লাহ তা’আলা নাযিল করেছেন। ভাষার প্রতি অবজ্ঞা ও মাতৃভাষার প্রতি উদাসীনতা ভাষার যিনি স্রষ্টা মহান আল্লাহর প্রতি ধৃষ্ঠতা প্রদর্শনের শামিল।

ভাষা শিক্ষার প্রতি নবীজির অনুপ্রেরণা:

নবীজি তাঁর প্রিয় সাহাবী হযরত যায়েদ বিন সাবিতকে বিদেশী ভাষা শিখে তাদের প্রতি চিঠি পত্র লিখা ও ভাব বিনিময়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন। (বুখারী শরীফ)

অনেক সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শি ছিলেন, অনেকে পারস্য, মিসরীয় রোমান ও আফ্রিকান ভাষা জানতেন। আমাদের প্রিয়নবীর ভাষাজ্ঞান ছিল অত্যন্ত উচুঁ মানের, তাঁর শব্দ চয়ন, ভাষাশৈলী সর্বজনগ্রাহ্য হৃদয়গ্রাহী, মর্মস্পর্শী, যা শিক্ষিত অশিক্ষিত সব মানুষকে মুগ্ধ করত। নবীজি এরশাদ করেছেন আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে শুদ্ধভাষী। (মিশকাত)

মাতৃভাষার অধিকার মৌলিক অধিকার:

মত প্রকাশের অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ ও কথা বলার অধিকার শুধু মানুষের সাংবিধানিক অধিকার নয় এ অধিকার মহান আল্লাহই মানুষকে দান করেছেন। ভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় যারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের আত্নত্যাগ ও অবদানকে অস্বীকার করা তাদের আত্নত্যাগকে অবমূল্যায়ন করা আল্লাহর নিয়ামতের প্রতি অবজ্ঞা ও অকৃতজ্ঞতার শামিল। আল্লাহ তা’আলা হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করার পর তাঁকে পৃথিবীর সকল প্রকার ভাষা জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহর নবী হযরত সোলায়মান (আ.) পৃথিবীর সব ভাষা বুঝতেন পশু পাখির ভাষা বুঝতেন তাদের সাথে কথা বলতেন। হযরত দাউদ আলাইহি সালাম সুমধুর কন্ঠের অধিকারী ছিলেন। তাঁর সুললিত কণ্ঠের তিলাওয়াত শ্রবণের জন্য সমুদ্রের মৎসরাজি ভীড় জমাতো।

পৃথিবীতে আল্লাহর সৃষ্ট ভাষার প্রকৃত সংখ্যা কত তিনিই অধিক জ্ঞাত। তবে ইউকিপিডিয়ার তথ্য মতে পৃথিবীতে এ পর্যন্ত ৭৩৩০টি ভাষার সন্ধান পাওয়া যায়। প্রত্যেক জাতির কাছেই তার মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম।

মাতৃভাষা আমাদের গর্ব অহংকার:

পৃথিবীর সর্বাধিক প্রচলিত ১১টি ভাষার অন্যতম বিশ্বনন্দিত জনপ্রিয় ভাষা বাংলা ভাষা। বিশ্বে সর্বাধিক প্রচলিত ভাষার তালিকায় রয়েছে ১১টি ভাষা যথাক্রমে চীনা, ইংরেজি, হিন্দি, স্পেনীয়, আরবি, পূর্তগীজ, রূশ, বাংলা, জাপানী, জার্মানী ও ফরাসী। এটা বাংলা ভাষা ভাষীদের আনন্দের গৌরবের ও সম্মানের। অথচ সংস্কৃত, গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষা বর্তমানে ইতিহাসের যাদুঘরে স্থান করে নিয়েছে। বাংলা ভাষা আজ বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বর্তমানে জাতিসংঘের অধীনে বিশ্বের প্রায় ১৮৯টি রাষ্ট্রে ২১ ফেব্রুয়ারি দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়। এ অর্জন ও প্রাপ্তি সহজেই আসেনি বহু ত্যাগ, সংগ্রাম ও রক্তের বিনিময়ে এ সাফল্য অর্জিত, রফিক, সালাম, জব্বার ও বরকতসহ অসংখ্য ভাষা শহীদদের রক্তের বদৌলতে বাংলা ভাষা আজ রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা লাভ করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

বাংলা ভাষায় ইসলামী গ্রন্থাবলীর অনুবাদ:

ইসলামই আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম। বিশ্ব মানবতার মুক্তির সনদ মহা গ্রন্থ “আলকুরআন” সকল প্রকার জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎস। ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় আরবি, উর্দূ ও ফার্সী ভাষায় রচিত গ্রন্থাবলী আজ মাতৃভাষা বাংলায় অনুদিত হওয়ার সুবাধে বাংলা ভাষাভাষীরা নিজেদেরকে ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ করার পথ সুগম হয়েছে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের অনুবাদ ও তাফসীর গ্রন্থ সমূহ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ সমূহ, ইসলামী ফিক্‌হ তথা আইন শাস্ত্রের মৌলিক গ্রন্থাবলী আমাদের মাতৃভাষায় অনুদিত হওয়ার কারনে ইসলাম শরীয়ত, মাযহাব, তারীকত ও ধর্ম দর্শন সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে।

মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, মাতৃভাষার ব্যাপক প্রচলন, চর্চা, ব্যবহার বিকাশ, গবেষণা ও সমৃদ্ধি সাধনে ইসলাম মানব জাতিকে বিভিন্নভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।

 

হে আল্লাহ! আমাদেরকে মাতৃভাষায় কুরআন সুন্নাহর সঠিক মর্ম অনুধাবন করার তাওফিক দিন। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় যারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের কবুল করুন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম;
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।