জুমার-খুৎবা

জুমার খুতবা | সূরা লাহাব’র শিক্ষা ও তাৎপর্য

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি।

১৭ জমাদিউস সানি|১৪৪৩ হিজরি|শুক্রবার|২১ জানুয়ারি’২২

“সূরা লাহাব’র শিক্ষা ও তাৎপর্য”

সূরা লাহাব প্রসঙ্গ:

মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ১১১তম সূরা লাহাব মক্কী সূরা হিসেবে প্রসিদ্ধ। এতে রুকু সংখ্যা এক, আয়াত সংখ্যা পাঁচ, শব্দ সংখ্যা বিশ, বর্ণ সংখ্যা সাতাত্তর টি।
আল্লাহর নামে আরম্ভ যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।

 

সূরার অনুবাদ:

 

১. ধ্বংস হোক আবু লাহাবের হস্তদ্বয় এবং সে ধ্বংস হয়েই গেছে।
২. তার কোন কাজে আসেনি তার ধন সম্পদ এবং যা সে উপার্জন করেছে।
৩. অচিরেই সে প্রবেশ করবে লেলিহান অগ্নিতে।
৪. এবং তার স্ত্রী জ্বালানী কাঠের বোঝা মাথায় বহনকারীনী।
৫. তার গলদেশে খেজুর পাতার পাকানো রশি।
(তরজমা: কানযুল ঈমান, সূরা: লাহাব, পারা:৩০, আয়াত: ১-৫)

সূরার আলোচ্য বিষয়:

১. রাসূলুল্লাহর প্রতি বেয়াদবী প্রদর্শনকারী দ্বীনের শত্রু আবু লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মে জামিলের চরম নিকৃষ্ট পরিণতির বর্ণনা। ২. জাহান্নামের প্রজ্জ্বলিত লেলিহান শিখার তীব্রতা ও প্রখরতার বর্ণনা। ৩. হাত, কাঠ, রশি, অগ্নি লেলিখান শিখার বর্ণনা। ৪. রাসূলের শানে বেয়াদবীর প্রতিবাদে আল্লাহ কর্তৃক চুড়ান্ত অভিশাপ ও শাস্তির ঘোষণা।

 

সূরার শানে নুযুল:

 

একদা আল্লাহর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের দাওয়াতের উদ্দেশ্যে আরববাসীদেরকে সাফা পর্বতে আহবান করলেন। চতুর্দিক থেকে লোকেরা সমবেত হলো। উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে নবীজি বললেন, আমি যদি তোমাদেরকে বলি এ পর্বতের (অন্তরালে) একদল শত্রু তোমাদের ধ্বংস করার জন্য লুকিয়ে বসে আছে তোমরা কি আমার কথাকে সত্য মনে করবে? সকলেই সমস্বরে বললো হ্যাঁ অবশ্যই আমরা তা সত্য বলে বিশ্বাস করবো। তাদের জবাবের পর নবীজি বললেন, “নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে এক কঠিন শাস্তির ভীতি প্রদর্শনকারী, সতর্ককারী , আমি দেখতে পাচ্ছি তোমাদের জন্য এক কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে। নবীজি একথা বলার সাথে সাথে আবু লাহাব চরম বেয়াদবী প্রদর্শন করলো, আবু লাহাব উত্তেজিত হয়ে নবজিকে লক্ষ্য করে বললো, তুমি ধ্বংশ হয়ে যাও, একথা বলার জন্যই কি তুমি আমাদেরকে একত্রিত করেছো? আবু লাহাবের এ রূঢ় আচরণ ও ধৃষ্ঠতার প্রতিবাদে আল্লাহ তা’আলা এ সূরা নাযিল করেন। এতে অভিশপ্ত আবু লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মে জামিলার নিষ্ঠুরতা ও পাশবিক আচরণের বর্ণনা ঘোষিত হয়েছে। আল্লাহর প্রিয় মাহবুব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কষ্ট ও যন্ত্রণা দেওয়ার পরিণতিতে আবু লাহাব ও তার স্ত্রীর অনিবার্য ধ্বংস ও জাহান্নামে তাদের ভয়াবহ, বিপর্যয় ও শাস্তির কথা উপস্থাপিত হয়েছে। নবীজির শানে কুঠুক্তিকারী, অসম্মান ও অবমাননাকারী, ধৃষ্ঠতা প্রদর্শনকারী, কুলাঙ্গার ব্যক্তিদের জন্য সূরা লাহাব এক স্মরণীয় ও শিক্ষনীয় নিদর্শন হিসেবে দু:সংবাদের জলন্ত দৃষ্টান্ত ও সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে অনন্তকাল অনন্য বার্তা প্রচার করে যাবে। [তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান, পারা: ৩০, পৃ: ১০৯৮ কৃত: আল্লামা ফয়েজ আহমদ ওয়েসি (র.)]

আবু লাহাব’র পরিচিতি:

আবু লাহাব ছিল তার উপাধি, নাম ছিল আবদুল উয্‌যা ইবনে আবদুল মুত্তালিব, সে নবীজির আপন চাচা ছিল, সে খুব ফর্সা ও সুন্দর পুরুষ ছিল, আবু লাহাব উপনামেই সে পরিচিত ছিলো, আয়াতে বর্ণিত, ‘না-রান যা-তা লাহাব’ দ্বারা জাহান্নামে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখার তীব্রতা ও লেলিহান শিখার প্রখরতা বুঝানো হয়েছে। আবু লাহাব ছিল আরবের সম্পদশালী ব্যক্তি, যখন তাকে জাহান্নামের শাস্তির ভয় দেখানো হতো তখন সে বলতো আমার ভাতুস্পুত্রের কথা যদি সত্য হয় আমার প্রাণরক্ষার্থে কিয়ামতের দিন আমার সমুদয় ধন সম্পদ সন্তান-সন্তুতি উৎসর্গ করে মুক্তি পাব, তার প্রতিবাদে আল্লাহ তা’ আলা আয়াতে বর্ণনা করেন, তার ধনসম্পদ ও তার উপার্জন তার কোন উপকারে আসেনি। বদর যুদ্ধের সাতদিন পর আবু লাহাবের শরীরে বিষাক্ত গুটি দেখা দেয় এতেই তার মৃত্যু হয়। তার সংস্পর্শে গেলে সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে পরিবারের কেউ তাকে স্পর্শও করেনি, তিন দিন পর্যন্ত লাশ পরিত্যক্ত থাকে। পরিশেষে শ্রমিক ডেকে গর্ত খনন করে মরদেহ গর্তে ফেলে মাটি ও পাথর চাপা দেয়। নবীজির শানে বেয়াদবীর কারনেই তার এমন শোচনীয় অপমানকর মৃত্যু হলো। পরকালের শাস্তি কত ভয়াবহ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। (সীরাতুল মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, পৃ:১৮৭, ১ম খন্ড, কৃত: আল্লামা ইদ্রীস কান্ধলবী)

 

 

আবু লাহাবের দুষ্ট স্ত্রী ও তার করুণ পরিণতি:

আবু লাহাব’র স্ত্রীর নাম ছিল আরওয়া বিনতে হারব ইবন উমাইয়া, উম্মে জামীল নামে সকলের কাছে পরিচিত ছিলো, সে ছিল আবু সুফিয়ানের বোন, কুফর, শির্ক, খোদা দ্রোহীতা ও নবী দ্রোহীতার কাজে সে তার স্বামী আবু লাহাবকে অসৎ পরামর্শ দিত ও সার্বিক সহযোগিতা করত। জাহান্নামেও সে স্বামীর সহযোগী হবে। (তফসীরে ইবনে কাছীর, একাদশ খন্ড: পৃ: ৬২১)

আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিল একজন দুষ্ট নারী ছিল। রাসূলুল্লাহর প্রতি সে চরম বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করত, নবীজির চলার পথে রাতের বেলা কাঁটা বিছায়ে রাখত। কোনো কোনো বর্ণনায় উল্লেখ হয়েছে, রাসূলুল্লাহর ঘর ছিল আবু লাহাবের ঘরের খুবই কাছে আবু লাহাব ও তার স্ত্রী রাসূলুল্লাহর সাথে নিয়মিত বিভিন্নভাবে অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণ করত। উম্মে জামীলা নবীজির চলার পথে কাঁটা বেঁধে বিছিয়ে দিতো, সে খেজুর পাতার পাকানো রশি দিয়ে বেঁধে নিজেই কাঁটাযুক্ত কাঠের বোঝা বহন করে আনতো, উম্মে জামীলাহ আরবের ধনবতী মহিলা হওয়া সত্বেও নবীজির প্রতি শত্রুতার কারণেই নিজের ক্রীতাদাসী বা সেবিকাদের সহযোগিতা ছাড়াই জঙ্গলে গিয়ে নিজেই কাঁটা সংগ্রহ করে মাথার উপর বোঝাই করে আনতো। আল্লাহ তা’আলা আবু লাহাবের স্ত্রীকে কাঠের বোঝা বহনকারীনী উল্লেখ করে তার মর্মান্তিক শোচনীয় পরিণতির দিকে ঈঙ্গিত করেছেন। “তাফসীর নুরুল ইরফান ও খাযাইনুল ইরফানে” উল্লেখ রয়েছে, একদিন জঙ্গল থেকে বোঝা আনার পথে ক্লান্ত হয়ে পথিমধ্যে একটি পাথরের উপর বসে পড়েছিল। আল্লাহর আদেশক্রমে একজন ফেরেস্তা পিছন থেকে বোঝা টান দিলে বোঝার রশি দ্বারা গলায় ফাঁস আটকে গেলো সেখানেই লাঞ্চনাকর অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটলো। আল্লাহর নবীর শানে বেয়াদবীর কারণে মহান আল্লাহ কর্তৃক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সম্মুখীন হতে হলো, আল্লাহর ফরমান চুড়ান্তরূপে বাস্তবায়িত হলো। নবীজির প্রতি ধৃষ্ঠতা প্রদর্শনের উপর্যূক্ত জবাব দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা। প্রখ্যাত তাফসীরকার হাকিমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.) প্রণীত “তাফসীরে নূরুল ইরফানে” উল্লেখ হয়েছে, আল্লাহর রাসূলের শানে অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ও উপর্যূক্ত জবাব দেওয়া আল্লাহর সুন্নাত। আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় রাসূলকে শত্রু থেকে রক্ষা করেছেন। সূরা লাহাব নাযিল হওয়ার পর আবু লাহাবের স্ত্রী ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য পাথর হাতে নিয়ে নবীজিকে আঘাত করার প্রত্যয়ে সম্মূখে ছুটলেন এমন সময় নবীজি হযরত আবু বকর (রা.) সহ মসজিদে উপবিষ্ট ছিলেন। হযরত আবু বকর (রা.) দুষ্ট মহিলাটিকে সম্মূখ পানে আসতে দেখে নবীজিকে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার আশংকা হয় মহিলাটি আপনাকে দেখে ফেলে কিনা? আপনি যদি সরে না যান সে আপনাকে আঘাত হানবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর (র.) কে বললেন, সেই আমাকে কিছুতেই দেখবেনা। আল্লাহ তা’আলা এ দুষ্ট মহিলার দৃষ্টি থেকে আমাকে আড়াল করে রাখবেন। অল্পক্ষণের মধ্যে দুষ্ট মহিলাটি হযরত আবু বকর (রা.) সামনে উপস্থিত হয়ে বললো, হে আবু বকর! তোমার সঙ্গী নাকি আমাদের বিরুদ্ধে দূর্নাম মূলক কবিতা রচনা করে আমাদের গালমন্দ করছে, হযরত আবু বকর বললেন, ক্বাবা ঘরের মালিকের শপথ! আমার সঙ্গী তো কখনো কবিতা চর্চা করেন না, তাঁর মুখ থেকে কখনো কবিতা নিসৃত হয় না। মহিলাটি হযরত আবু বকরের কথা শুনে ফিরে গেল। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন সময় হযরত আবু বকর’র সঙ্গে থাকার পরও মহিলাটি নবীজিকে দেখতে পেলনা। হযরত আবু বকর বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে কি আপনাকে দেখতে পায়নি? নবীজি বললেন, যতক্ষণ মহিলাটি এস্থানে দাড়িয়ে ছিলো আমার প্রভূ মহিলার দৃষ্টি ও আমার মাঝখানে আবরণ সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। এ ঘটনা নবীজির নবুওয়াতের প্রকৃষ্ট প্রমাণ ও বিস্ময়কর মুজিযা। (তাফসীরে ইবনে কাছীর, কৃত: আল্লামা ইবনে কাছীর (র.) একাদশ খন্ড, পৃ: ৬২২),

 

 

হে আল্লাহ! আপনার প্রিয় হাবীবের শক্রদের চক্রান্ত থেকে আমাদের ঈমান আক্বিদা হিফাজত করুন। কুরআন সুন্নাহর আলোকে আপনার প্রিয় রাসূলের সুমহান মর্যাদা অনুধাবন করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।