প্রবন্ধ

দো’আ

দো’আ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলাে ডাকা, আহ্বান করা ও প্রার্থনা করা। পরিভাষায়, আল্লাহর নিকট বিনয়ের সাথে কিছু প্রার্থনা করাকে দো’আ বলা হয়। কখনাে যিকরকেও দো’আ বলা হয়। আল্লাহর কাছে দো’আ খুবই প্রিয়। তাই তিনি বান্দাকে দো’আ করতে আদেশ দেন এবং তা কবুল করারও প্রতিশ্রুতি দেন।

ইতিপূর্বে আল্লাহ তায়ালা কেবল নবী-রাসূলগণকেই দো’আ করার আদেশ দিতেন এবং তাঁদের দো’আ কবুল করার প্রতিশ্রুতি দিতেন। কিন্তু বর্তমান উম্মতি মুহাম্মদীর জন্য এটি ব্যাপক করে দেয়া হয়েছে। এটি উম্মতি মুহাম্মদীর একটি বৈশিষ্ট্য। বান্দার যাবতীয় ইবাদত আল্লাহ তায়ালা কবুল করতেও পারেন কিংবা প্রত্যাখানও করতে পারেন।

কারণ কোন ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা কবুল করবেন বলে ওয়াদা দেননি। কিন্তু দোয়া এমন ইবাদত যা কবুল করবেন বলে ওয়াদা দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- وقال ربكم ادعوني أستجب لكم

“তােমাদের পালনকর্তা বলেন, তােমরা আমার নিকট দোয়া কর, আমি তােমাদের দোয়া কবুল করবাে।(সূরা মুমিন, আয়াত:৬০)

সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তিকে আল্লাহর কাছে দোয়া বা প্রার্থনা করতে হবে এবং তা কবুল হয়েছে বলে দৃঢ়বিশ্বাস রাখতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
إذا سألك عبادي عني فإني قريب أجيب دعوة الداع إذا دعان فليستجيبوا لي وليؤمنوا بي لعلهم يرشدون
“আর আমার বান্দারা যখন আপনার কাছে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে, বস্তুত আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা দোয়া করে তাদের দোয়া কবুল করে নিই, যখন আমার কাছে দোয়া করে। কাজেই আমার আদেশ মান্য করা এবং আমার প্রতি বিশ্বাস স্হাপন করা তাদের একান্ত কর্তব্য। যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে।(সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৬)

অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন-
ادعوه خوفا وطمعا إن رحمت الله قريب من المحسنين
“তোমরা আল্লাহকে ডাক ভয় এবং আশা নিয়ে সন্নিকটে।(সূরা আ’রাফ,আয়াত;৫৬) কেউ কেউ বলেন, জীবন্ত ও সুস্থ অবস্থায় আল্লাহকে ভয়ের মাধ্যমে ডাকলে এবং অসুস্থ ও দুঃসময়ে আল্লাহকে আশা নিয়ে ডাকলে কার্যকরী হয় বেশী।

আল্লাহ তায়ালা আরাে বলেন-
ادعوا ربكم تضرعا وخفية إنه لايحب المعتدين 
“তােমরা তােমাদের প্রভূকে ডাক কাকুতি-মিনতি করে এবং সংগােপনে।(সূরা আ’রাফ, আয়াত;৫৫)

অতএব, দোয়ার মধ্যে বিনয়ী ও নম্রতা, ভদ্রতা থাকতে হবে। কারণ দোয়া হলাে ইবাদত। হাদিস শরীফে আছে الدعاء هو العبادة “দোয়াই হলাে ইবাদত” অথবা ইবাদতই হলাে দোয়া।(তিরমিজি শরীফ) অন্যত্র বর্ণিত আছে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- الدعاء مخ العبادة
দোয়া ইবাদতের মগজ বা মূল। অর্থাৎ দোয়ার মাধ্যমেই ইবাদত কবুল হয়।(প্রাগুক্ত)

সুতরাং যে কোন ইবাদত করার পর আল্লাহর দরবারে কাকুতি-মিনতি করে ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য দোয়া করা উচিত। দোয়া আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয়। তিনি প্রতি রাতের শেষ ভাগে পৃথিবীর সন্নিকট আসমানে তাশরীফ এনে বান্দাকে আহবান করেন-

،من يدعوني فأستجيب له من يسألني فأعطيه، من يستغفرني فأغفر له

“কে আমার নিকট দোয়া করবে আমি তার দোয়া কবুল করবাে, কে আমার নিকট চাইবে, আমি তার প্রয়ােজন পূরণ করবাে এবং কে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেবাে। (সহীহ বুখারী শরীফ)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- ليس شئي اكرم على الله من الدعاء
“আল্লাহর কাছে দোয়ার চেয়ে অন্য কোন বস্তু মর্যাদাবান নয়।” (তিরমিজি শরীফ)

হযরত আবু হােরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-

من لم يدع الله سبحانه، غضب عليه
“যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট দোয়া করেনা, আল্লাহ তায়ালা তার উপর রুষ্ট হন।”(ইবনে মাজাহ শরীফ)

হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
قال الله تعالى أنا عند ظن عبدی بی وانا معه اذا دعانى
“আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি আমার বান্দার ধারণা মােতাবেক হই। যখন সে আমার নিকট দোয়া করে, তখন আমি তার সাথে থাকি।” (মাজমাউয যাওয়ায়েদ)

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
تدعون الله فى ليلكم ونهاركم فان الدعاء سلاح المؤمن
“তােমরা দিবা-রাত্রি আল্লাহর নিকট দোয়া কর, কেননা দোয়া মু’মিনের হাতিয়ার। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ)

হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে –
اكثر من الدعاء فان الدعاء يرد القضاء المبرم
“বেশী বেশী দোয়া কর। কেননা, দোয়ার দ্বারা চূড়ান্ত তকদীর প্রত্যাখান হয়।” (কানযুল উম্মাহ)

তিরমিযী শরীফে বর্ণিত আছে-

من فتح له فى الدعاء منكم فتحت له ابواب الرحمة
তোমাদের মধ্যে যে দোয়ার দরজা উন্মুক্ত করবে, তার জন্য রহমতের দরজা উন্মুক্ত করা হবে। (জামে তিরমিজি)

যাদের দো’আ অধিক কবুল হয়ঃ

মুত্তাকী, নেককার, পরহেযগার, হালাল ভক্ষণকারী, সুন্নাতের অনুসারী বৃদ্ধ মুমিন এবং মযলুমের দোয়া আল্লাহর দরবারে বেশী কবুল হয়। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,

ان الله عزوجل يستحى من ذى الشيبة المسلم اذا كان مسددا لزوما للسنة ان يسأل الله فلا يعطيه

“হেদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত সুন্নতের অনুসারী কোন বৃদ্ধ মুসলিম আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে তার চাহিদা পূরণ না করতে আল্লাহর লজ্জাবােধ করেন। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা এরূপ বৃদ্ধের দোয়া ফেরত দেন না। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ)

হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াককাস (রা.) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললেন হে আল্লাহর রাসূল! আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি কিন্তু আমার দোয়া কবুল হচ্ছেনা। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

يا سعد اجتنب الحرام فان كل بطن دخل فيه لقمة من الحرام لا يستجاب دعائه اربعين يوما

“হে সাদ! তুমি হারাম বর্জন কর। কেননা যে পেটে এক লুকমা হারাম খাদ্য প্রবেশ করবে, চল্লিশ দিন যাবৎ তার দোয়া কবুল হয় না।(তান্বীহুল গাফেলীন)

হযরত আবু হােরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ
করেন,
دعوة المظلوم مستجابة وان كان فجر ففجوره على نفسه
মযলুমের দোয়া কবুল হয় যদিও সে ফাজির বা গুনাহগার হয়। কেননা তার গুনাহ তার উপর। অর্থাৎ মযলুম গুনাহগার হলেও তার দোয়া গৃহীত হবে।(প্রাগুক্ত)

অনুরূপভাবে রােযাদার ও মুসাফিরের দোয়াও কবুল হয়। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
ثلاث حق على الله أن لا يردلهم دعوة الصائم حتی يفطر والمظلوم حي ينصر والمسافر يرجع-

“তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহ তায়ালা প্রত্যাখ্যান করেন না। ১, রােযাদার ইফতার না করা পর্যন্ত , ২. মযলুম নিজে প্রতিশােধ না নেয়া পর্যন্ত এবং ৩. মুসাফির (ঘরে) ফিরে না আসা পর্যন্ত। (প্রাগুক্ত)