ইতিহাস

মুহাম্মদ (দ.)-এর ভবিষ্যদ্বাণীতে কনস্টান্টিনোপল বিজয়

সেনানী ডেস্ক

আজ ২৯ শে মে। আজকের এই দিনে রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতাস্বরুপ সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রহঃ -এর মাধ্যমে কনস্টান্টিনোপল তথা ইস্তাম্বুল শহর বিজিত হয়।

হযরত আবূ ইমরান আসলাম (রাঃ) বলেন, ‘আমরা মদীনা থেকে কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) অভিমুখে বের হলাম। আমাদের সেনাপতি ছিলেন ‘আব্দুর রাহমান ইবনু খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ (রাঃ)। রোমের সৈন্যবাহিনী শহরের প্রাচীর-বেষ্টনীর বহির্ভাগ থেকে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিলো। জনৈক মুসলিম সৈনিক শত্রুবাহিনীর উপর হামলা করে বসলো। লোকেরা বললো, হায়, থামো! লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। সে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আবূ আইয়্যুব আল-আনসারী (রাঃ) বললেন, এ আয়াত (সূরা আল-বাকারাহঃ ১৯৫) আমাদের আনসার সম্প্রদায় সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছিলো। আল্লাহ যখন তাঁর নবী ﷺ কে সাহায্য করলেন এবং দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী করলেন, ‘আমরা মনে মনে বললাম, এসো! এবার ‘আমরা নিজেদের ধন-সম্পদ দেখাশুনা ও ঠিকঠাকে মনোযোগ দেই। মহান আল্লাহ তখন এ আয়াত অবতীর্ণ করলেনঃ ‘‘তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করো এবং নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না।’’
[সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত ১৯৫]

 

আমাদের নিজের হাতকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করা এর অর্থ হচ্ছে, ধন-সম্পদ নিয়েই ব্যস্ত থাকা, এর পরিবৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করা এবং জিহাদ ছেড়ে দেয়া। আবূ ‘ইমরান (রাঃ) বলেন, এরপর থেকে আবূ আইয়্যুব আল-আনসারী (রাঃ) সর্বদা মহান আল্লাহর পথে জিহাদে শরীক হতেন, অবশেষে তিনি জিহাদ করতে করতে কুসতুনতুনিয়াতে (ইস্তাম্বুল) সমাহিত হন। [১]

 

আবূ আইয়্যুব আল আনসারি রাঃ বার্ধক্যে উপনীত হলেও জিহাদের প্রতি তাঁর তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ কর্তৃক ভবিষ্যদ্বাণীকৃত সেই উত্তম বাহিনীর মধ্যে শামিল হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষার কারণে অভিযানে যান। যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি তার সঙ্গীদের বলেন যাতে তাকে শত্রু সীমানার যত ভেতরে পারা যায় তত ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কনস্টান্টিপোলের দেয়ালের কাছে তাকে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুর পর মুসলিম সৈনিকরা তার ইচ্ছাপূরণ করে।

 

এভাবে এর পূর্বে এবং পরে অনেকেই ইস্তাম্বুল বিজয়ের চেষ্টা করতে থাকেন। অবশেষে প্রিয় নবী ﷺ এঁর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রহঃ ১৪৫৩ সালে এই শহরের বিজেতারুপে আবির্ভূত হন। প্রিয় নবী ﷺ বলেন, ‘মুসলমানরা অবশ্যই কনস্টান্টিনোপল বিজয় করবে। কতই না উত্তম হবে সে বাহিনীর আমির/সেনাপতি। কতই না উত্তম সেই বাহিনী। [২]

 

১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর কিংবা অন্তর্বর্তী সময়ে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ আল ফাতিহ এর উপদেষ্টা সুফি আলেম আঁক-শামসউদ্দিন (মুহাম্মদ শামসউদ্দিন বিন হামজা) রহঃ আধ্যাত্মিক শক্তিবলে তাঁর কবর খুজে বের করেন এবং সুলতান ফাতিহ মুহাম্মদ রহঃ তাঁর কবরের উপর মাজার নির্মাণ করে। তাঁর সম্মানে কবরের পাশে মসজিদও নির্মাণ করা হয়। এর পর থেকে স্থানটি তার নামে পরিচিতি পায়। পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হওয়ার অনেক উসমানীয় কর্তাব্যক্তি সেখানে দাফন হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতেন।

 

আঁক-শামসউদ্দিন (মুহাম্মদ শামসউদ্দিন বিন হামজা) রহঃ ছিলেন একজন উসমানীয় আলেম, কবি, সুফি এবং সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের বাল্যশিক্ষক ও উপদেষ্টা। সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদকে কনস্টান্টিনোপল জয়ের জন্য তিনি উৎসাহিত করতেন, সুলতানের চেষ্টা ব্যর্থ হলেও তিনি তাকে আশ্বস্ত করতেন। তাকে কনস্টান্টিনোপলের আধ্যাত্মিক বিজয়ী (الفاتح المعنوي- আল ফাতিহ আল মানাভী) বলে অভিহিত করা হয়। তাঁর শিক্ষক শাইখ হাজি বাইরাম ওয়ালির সাথে নিজের রচনা সমাপ্ত করার পর তিনি শামসিয়া-বাইরামিয়া সুফি তরিকা প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মীয় বিষয়াদির পাশাপাশি তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান ও ফার্মাকোলজির জ্ঞানের জন্য খ্যাত ছিলেন। এছাড়াও সুফিজম এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়েও বই লিখেছেন বলে জানা যায়। শায়খুল আকবর ইবনে আরাবী রহঃ এঁর কিছু কথা (লেখা) মানুষের মাঝে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করলে তিনি সেগুলোরও জবাব দিয়ে বুঝিয়ে দেন বলেও জানা যায়।

 

এভাবে শুধু কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী নয়, আল্লাহ সুবহানাহু প্রিয় নবী ﷺ কে অদৃশ্যের জ্ঞান দান করায় তিনি কিয়ামত পর্যন্ত ঘটিতব্য সকল ঘটনার কথাই সাহাবায়ে কেরামের নিকট বর্ণনা করেছেন।

 

একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ ফজর হতে মাগরিব পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে নামাজসমূহ আদায়ের পরপর মিম্বরে আরোহণ করে খুতবা (বর্ণনা) দিতে থাকেন। এ ভাষণে তিনি পূর্বে যা ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে যা ঘটবে সব জানিয়ে দেন। [৩] তিনি ﷺ সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে জ্ঞাত করলেন। অবশেষে তিনি জান্নাতবাসী ও জাহান্নাম বাসীর নিজ নিজ নির্দিষ্ট স্থানে প্রবেশ করার কথাও উল্লেখ করলেন। যাদের স্মরণশক্তি ভাল ছিল, তারা এগুলো স্মরণ রাখতে পেরেছেন, বাকিরা ভুলে গিয়েছেন। [৪] তিনি ﷺ কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে বলে জানান সেসবের কিছু ঘটলেই সাহাবায়ে কেরাম তা এরূপ স্মরণ করতে পারতেন যেরূপ কেউ তার পরিচিত লোকের অনুপস্থিতিতে তার চেহারা স্মরণ রাখে। অতঃপর তাকে দেখা মাত্র চিনে ফেলে। [৫] হযরত হুযায়ফা (রাঃ) আল্লাহ্‌র কসম করে বলেন যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ কিয়ামত পর্যন্ত ফিতনা সৃষ্টিকারী কোন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করতে বাদ দেননি, যাদের সংখ্যা হবে তিন শ’রও বেশী। তিনি তাদের নাম, তাদের পিতার নাম এবং তাদের গোত্রের নামও উল্লেখ করেন। [৬] এছাড়াও রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, দাজ্জালের সংবাদ সংগ্রাহক দলের (দশজন অশ্বারোহী ব্যক্তির) প্রতিটি ব্যক্তির নাম, তাদের বাপ-দাদার নাম এবং তাদের ঘোড়ার রং সম্পর্কেও তিনি অবগত আছেন। এ পৃথিবীর সর্বোত্তম অশ্বারোহী দল সেদিন তারাই হবে। [৭]

 

[১] সুনান আবূ দাউদ ২৫১২
[২] মুসনাদে আহমদ ১৮৯৫৭, আল মুসতাদরাক ৮৩৪৯
[৩] সহীহ মুসলিম ৭১৫৯
[৪] সহীহ বুখারী ৩১৯২
[৫] সুনান আবূ দাউদ ৪২৪০
[৬] সূনান আবু দাউদ ৪২৪১
[৭] সহীহ মুসলিম ৭১৭৩