জীবনী

ইমাম তিরমিজি (রহ.)’র সংক্ষিপ্ত জীবনী

লেখক- আহমদ শাহ আদীল

নাম ও বংশ

ইমাম তিরমিজি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর প্রকৃত নাম- মুহাম্মদ। কুনিয়াত- আবূ ঈসা। তাঁর পিতার নাম ‘ঈসা। তাঁর বংশপরিক্রমা হল: মুহাম্মদ ইবনে ‘ঈসা ইবনে সাওরা ইবনে মূসা ইবনে আয-যাহহাক আস-সুলামী আয-যরীর আল-বূগি আত-তিরমিজি।

জন্মগ্রহণ

ইমাম তিরমিজি (রহঃ) এর জন্ম তারিখ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। ইমাম তিরমিজি (রহঃ) এর জন্মসাল হিসাবে ২০৯ হিজরী (৮২৪/৮২৫ খ্রিঃ) উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে, আয যাহাবি বলেন, ইমাম তিরমিজি (রহঃ) ২১০ হিজরীর (৮২৫/৮২৬ খ্রিঃ) কাছাকাছি সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। কেউ কেউ বলেন, ইমাম তিরমিজি (রহঃ) মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। আবার অনেকে বলেন, তিনি তিরমিজে জন্মগ্রহণ করেন (যেটি বর্তমানে উজবেকিস্তানের দক্ষিনে অবস্থিত)। প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী, তিনি ২০৯ হিজরীতে তিরমিজি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

 

 

শৈশবকাল

ইমাম তিরমিজি (রহঃ) শৈশবকাল নিজ জন্মভূমিতে কাটান। তবে, তিনি ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী এবং প্রখর বুদ্ধিমান ছিলেন। ফলে কোন হাদিসের প্রতি একবার চোখ বুলালে তা আর পুনরায় দেখার প্রয়োজন পড়তো না। সবাই তাঁর প্রখর মেধা দেখে আশ্চর্য হয়ে যেতো।

শিক্ষাজীবন

শৈশবকালে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে হাদিস শিক্ষা এবং হাদিস সংগ্রহে আত্মনিয়োগ করেন। ২০ বছর বয়সে তিনি হাদিস শিক্ষা শুরু করেন। তিনি মুসলিম জাহানের বিখ্যাত হাদিস শিক্ষাকেন্দ্রসমুহ বসরা, কুফা, ইরাক, খোরাসান, হিজাজে গমন করে হাদিস সংগ্রহ ও অধ্যয়ন করতেন। কোন কোন সময় ইমাম তিরমিজি (রহঃ) পরিবার পরিজন থেকে নিরুদ্দেশ থাকতেন।

 

 

তাঁর প্রখর স্মৃতিশক্তি

ইমাম তিরমিজি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। ‘আল্লামা শামসুদ্দীন আয-যাহাবী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এ সম্পর্কে একটি ঘটনা উল্লেখ করেন। ঘটনাটি হলাে: “ইমাম তিরমিজি এরা, জনৈক শায়খের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হলে সুবর্ণ সুযােগ মনে করে তাঁর কাছ থেকে সরাসরি উক্ত হাদীসগুলো শুনার মনস্থ করলেন। তিনি তাঁর শায়খকে হাদীসগুলাে শােনানাের জন্য নিবেদন করলে। শায়খ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজি হন এবং হইমাম তিরমিযী সেগুলাে অনেক খুঁজাখুঁজি করে পেলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন যে, ভুলবশত সেগুলাে বাড়িতে রয়ে গেছে। ইমাম তিরমিজি অগত্যা সাদা কাগজ হাতে নিয়ে এমন ভান করলেন যেন শায়খ যে হাদীসগুলাে পড়ছেন তিনি সেগুলাে তার লিখিত কপির সাথে মিলিয়ে নিচ্ছেন। হঠাৎ সাদা কাগজের ওপর শায়খের দৃষ্টি পড়তেই তিনি রেগে বললেন, তুমি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছ? শায়খের ধমক শুনে ইমাম তিরমিজি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর নিকট ঘটনা খুলে বললেন এবং তিনি আরও বলেন, আপনি এখন পর্যন্ত যেসব হাদীস পড়েছেন তার সবগুলােই আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। শায়খের সন্দেহ দূর করার জন্য তিনি নতুন আরও কিছু হাদীস শােনানাের নিবেদন করলেন। শায়খ তখন আরও দুষ্প্রাপ্য চাল্লশটি হাদীস ইমাম তিরমিজি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-কে শুনিয়ে দিলেন। এতে শায়খের বিশ্বাস হল এবং চমৎকৃত হয়ে মন্তব্য করলেন, ‘আমি আপনার মতাে স্মৃতিশক্তির অধিকারী আর কাউকে দেখিনিদেখিনি’

তাঁর উস্তাদগণ

ইমাম তিরমিজি (রহঃ) অনেক মুহাদ্দিস থেকে হাদিস গ্রহন করেন বা শিক্ষার্জন করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উস্তাদগণ হলেন-

 

 

• ইমাম বোখারী

• আদ দারেমী

 

• আবু দাউদ

 

• মুসলিম বিন হাজ্জাজ

 

• ইসহাক ইবনে মুসা

 

• মাহমুদ ইবনে গাইলান

 

• সাঈদ ইবনে আব্দুর রহমান

 

• কুতাইবা ইবনে সাঈদ

 

• মুহাম্মদ ইবনে বাশশার আল-বসরি

 

• মুহাম্মদ ইবনে আল মুসান্না আল-বসরি

 

তাঁর ছাত্রগণ

 

ইমাম তিরমিজি (রহঃ) খুব অল্প সময়ে হাদিসের পাণ্ডিত্য অর্জন করতে সক্ষম হন। ইমাম তিরমিজি রহঃ ছিলেন ইলমে হাদীসের এক বিশাল সাগর। ইমাম তিরমিজি রহ. এর পাণ্ডিত্য চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিদ্ধানুরাগী ও জ্ঞানপিপাসু ছাত্রগন তার নিকট থেকে হাদিসের দরস নিতে থাকেন। উল্লেখযোগ্য কিছু ছাত্র হলো-

• আবু হামেদ আহমদ ইবনে আব্দুল্লাহ মারুফী।

 

• আহমদ ইবনে ইউসুফ নাসাফী (রহঃ)।

 

• আবুল হারিস আসাদ ইবনে হামদাওয়াহ আন-নাসাফী।

 

 

• হুসাইন ইবনে ইউসূফ আল-ফিরবরী।

• হাম্মাদ ইবনে শাকির আল-ওয়ারাক।

 

 

• দাউদ ইবনে নাসার ইবনে সুহাইল আল-বযদওয়ী।

• রাবী ইবনে হাইয়ান আল-বাহিলী।

 

• নাসর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সাবরা আশ-শায়রাকসী।

 

তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ

ইমাম তিরমিজি (রহ.) অনেক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-

 

১| আল-জামি আল-মুখতাসার মিন আস-সুনান আন-রাসুলিল্লাহ, (এটি জামে তিরমিজি নামে বেশ পরিচিত)

 

২| আশ-শামাইল আন-নাবাউয়িয়াহ ওয়া আল-ফাদাইল আল-মুসতাফাউয়িয়াহ।

 

৩| আল-আসমা ওয়া আল-কুনা।

 

৪| আজ-জুহদ।

 

৫| আল-ইলাল আস-সুগরা।

 

৬| আল-ইলাল আল-কুবরা।

 

৭| কিতাব আত-তারিখ।

 

মাজহাব

ইমাম তিরমিজি ইমাম বুখারীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিরমিজি শাফেয়ী বা হাম্বলী মাজহাবের অনুসারী ছিলেন। এমন হতে পারে যে তিনি নিজে একজন মুজতাহিদ ছিলেন অথবা ইমাম বুখারীর খুব ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কিছু অভিমত অনুযায়ী তিনি তার মাজহাব অনুসরণ করতেন।

আস-সুনানুত তিরমিযী -তাঁর অনবদ্য রচনা

ইমাম তিরমিজি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হাদীস শাস্ত্রে জ্ঞান লাভ করার পর একটি নির্ভরযােগ্য হাদীস গ্রন্থ সংকলন করেন। এটি জামি’উ আত-তিরমিযী নামে পরিচিত। এ গ্রন্থের মধ্যে সিয়ার, আদাব, তাফসীর, আকাইদ, ফিতান, আশরাত, আহকাম ও মানাকিব সম্পর্কিত আলােচনা সন্নিবেশিত হয়েছে বলে এটি জামি। অপরদিকে এটি সুনানও। কারণ এ গ্রন্থটি ফিকহের পদ্ধতির আলােকে বিন্যাস অনুযায়ী তাহারাত, সালাত, সাওম, যাকাত ও হজ্জ প্রভৃতি বিষয়গুলােকে তিনি ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করেছেন।

ইমাম তিরমিজি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর আল-জামে গ্রন্থে ৩৮১২টি হাদীসের স্থান দিয়েছেন। হাদীসগুলাে ৪৬টি অধ্যায়ে এবং ২৪১৪টি পরিচ্ছেদে সাজানাে হয়েছে। ইমাম ইবনে কসীর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ইমাম তিরমিযী এ ৪০০০টি হাদীস তাঁর গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন।

মনীষীগণের অভিমত

১. ‘আল্লামা শামসুদ্দীন আয-যাহাবী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি মীযানুল ই’তিদাল ফী নকদির রিজাল গ্রন্থে বলেন, “আবূ ঈসা আত-তিরমিযী ছিলেন হাফিয, ‘আলিম, জামি’ গ্রন্থের সংকলক নির্ভরযােগ্য এবং তাঁর বিশ্বস্ততার ব্যাপারে সকলেই একমত।”

২. আল্লামা আবূ ইয়ালা আল-খালীলী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ‘তিনি ছিলেন সকলের মতে নির্ভরযােগ্য। আমানতদারী এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রে ছিলেন প্রসিদ্ধ।’

৩. ইমাম হাফিয ইবনে হিব্বান রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, “আবূ ঈসা ছিলেন হাদীস মুখস্থকারী, সংগ্রহকারী ও সংকলনকারীগণের মধ্যে অন্যতম।

৪. ইমাম হাকিম আন-নিসাপুরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, “উমর ইবনে আলাক থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইমাম বুখারী তাঁর ইন্তিকালের পর খুরাসানে জ্ঞান, পরহেযগারী এবং দুনিয়া বিমুখিতার ক্ষেত্রে আবু ঈসা রহ.-এর অনুরূপ আর কাউকে রেখে যাননি। তিনি অধিক কান্নার জন্য অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং কয়েক বছর পর্যন্ত অন্ধাবস্থায় জীবনযাপন করেন।”

৫. ইমাম হাফিয মিযযী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, “তিনি ছিলেন উল্লেখযােগ্য হাফিযগণের মধ্যে অন্যতম এবং এমন এক ব্যক্তি, যার মাধ্যমে আল্লাহ মুসলমানগণকে উপকৃত করেছেন।”

দিদারে ইলাহী

ইমাম তিরমিজি (রহঃ) ২৭৯ হিজরীর ১৩ ই রজব সোমবার রাতে (৮ অক্টোবর ৮৯২ খ্রিঃ, বোরবার রাতে) বূগে ইন্তেকাল করেন। তাঁকে বর্তমানে উজবেকিস্তানের তিরমিজ থেকে ৬০ কি.মি. উওরে শিরাবাদে দাফন করা হয়। (সিয়ারু আলামিন নুবালা)

শিক্ষার্থী- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া।