১১ মহররম ১৩৭৪ হিজরী মোতাবেক ১৯২২ সাল । ফুটফুটে চেহেরার এক স্নেহময় শিশু। জন্ম নিলো চট্টগ্রাম শহরের বাকলিয়াস্থ মিয়া খান এলাকায়।নবজাতকের পিতার নাম হাজী মুহাম্মদ হোসেন।সদ্য জন্ম নেওয়া আনন্দময় মুহুর্তে সকলের সিদ্বান্তে শিশুটির নাম রাখা হয়, নূর মুহাম্মদ

পিতা হাজী মুহাম্মদ হোসেন সাহেবের ছিল ক্ষুদ্র ব্যবসা।তার সংসার চলত এই ব্যবসার আয় দিয়ে। শিশু পুত্র নূর মুহাম্মদ আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল। বাবার ব্যবসার কাজে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হলো প্রিয় পুত্রের।

যার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি দুর অগ্রসর হয়নি।বাবাকে সাহায্য করতে করতে নিজে অর্জন করে নিল ব্যবসার অভিজ্ঞতা। এক পর্যায়ে তিনি চট্টগ্রাম শহরে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে “সওদাগর” এর খ্যাতি লাভ করেন।অর্থ্যা এখন তাঁকে সবাই চিনেন, “নূর মুহাম্মদ সওদাগর” নামে।

পারিবারিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনে তার প্রতিপত্তি এবং অর্থ বিত্তের প্রাচুর্য লাভ করার পরও যেন কিসের অভাবে নিজকে একজন পরিপূর্ণ এবং স্বার্থক মানুষ ভাবতে পারেননি।তিনি নিজকে অসম্পূর্ণ মনে করলেন। দীলের মধ্যে এই হতাশা নিয়ে চলতে লাগল জীবন প্রবাহ, কিন্তু না। নিজের অন্ধকার জীবনে হঠাৎ সন্ধান পেয়ে যান “বেলায়তের এক সূর্য”।

পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকের কথা।ইতিপূর্বে ১৯৪১ সাল থেকে চট্টগ্রামের কিছু মুরিদ ভক্তদের আবেদনের প্রেক্ষিতে শাহেন-শাহে সিরিকোট বাংলার জমিনে তাশরীফ আনতে লাগলেন। সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরীয়া, সিরিকোট শরীফের চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ঐ সব সোনালী মানুষ গুলোর মধ্যে অন্যতম হলেন।

আলহাজ্ব ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক, সূফি আবদুল গফুর এবং আলহাজ্ব ডাঃ টি হোসেন প্রমুখ। এই আলোকিত লোকদের মাধ্যমে জনাব নূর মুহাম্মদ সওদাগর সাহেব অনুসন্ধান পেলেন যুগখ্যাত বেলায়তের শ্রেষ্ঠ নক্ষত্র, আল্লাহর ওলী, পীর সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রাহঃ)কে।যিনি একজন আওলাদে রাসুল (দরুদ)ও বটে।

বেলায়তের এই সমুজ্জ্বল নক্ষত্র শাহেন-শাহে সিরিকোট (রাহঃ) এবং তাঁর তরিকতের শাজরা সম্পর্কে, ইমামে অাহলে সুন্নাত গাজীয়ে দ্বীন ও মিল্লাত শেরেবাংলা (রাহঃ) বলেন-

আমি দুনিয়ার বুকে তন্ন তন্ন করে দেখেছি, হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি পেশোয়ারী (রাঃ)’র মতো উঁচু স্তরের পীর তাঁর যুগে আমি কাউকে দেখিনি। এবং তাঁর সিলসিলায় কোন বিতর্কিত ব্যক্তি নেই।এই সিলসিলা একটি সন্দেহ মুক্ত দরবার।

নূর মুহাম্মদ সওদাগর আল-কাদেরী (রঃ) শাহেন-শাহে সিরিকোটের সংস্পর্শ পেয়ে জীবনকে পুরাপুরি স্বার্থক করে নিলেন।সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরীয়া। সিরিকোট শরীফের আলোক রশ্মির আলোকে মোরাকাবা মোশাহেদার মাধ্যমে কুতুবুল আউলিয়া হুজুর কেবলায়ে আলমের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। আর সওদাগর সাহেবও হুজুর কেবলাকে নিজের অর্জিত অর্থ সম্পদ, ধন-দৌলত এমনি পরিবার পরিজন থেকেও বেশি ভালবাসতে লাগলেন।

শুধু মুখের কথাবার্তা আর চালচলনে নয় বরং প্রতিটি অধ্যায় শাহেন-শাহে সিরিকোটের জন্য উৎসর্গ করতে লাগলেন।

যার অন্যতম দৃষ্টান্ত, বলুয়ার দীঘি পাড়স্থ তার বাসভবনের উপরের দু’টি তলা তরিকতের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ওয়াকফ করে দেন।উপরের তলা হুজুর কেবলার জন্য হুজরা শরীফ আর অপর তলা খানকা শরীফ হিসেবে সিলসিলার সমস্ত কার্যাদির প্রধান মারকাজ হিসেবে ব্যবহার হতো।

যেটি খানকায়ে কাদেরীয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবীয়া নামে সকলের কাছে সুপরিচিত। তবে তিনি তরিকতে প্রবেশ করার আগে শাহেন-শাহে সিরিকোট আমাদের দেশে শুভাগমন করলে,হুজুর কেবলা আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কোহিনুর ইলেক্ট্রনিকস প্রেসের উপর তলায় অবস্থান করতেন। শরীয়ত তরিকতের প্রাথমিক সিদ্বান্ত গুলো সেখানেই বসে নেওয়া হতো।

১৯৫৪ সাল।একদা জামেয়া প্রতিষ্ঠার লক্ষে ঐ কোহিনুর ইলেক্ট্রনিকস প্রেসের উপর তলায় শাহেন-শাহে সিরিকোটের হুজরা মোবারকে বসে হুজুর কেবলার সভাপতিত্বে পরামর্শ সভা আয়োজন করা হয়। জনাব নূর মুহাম্মদ সওদাগর আল কাদেরী সাহেবও এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

মাদ্রাসার ভিত্তি ও অবকাঠামোগত আলোচনা নিয়ে বিশেষ পরামর্শ সভা চলছে। কেউ মতামত দিচ্ছেন, মাদ্রাসা বাঁশের বেড়া আর টিনের ছাউনি হবে। কেউ কেউ সেমি পাকার পক্ষ মতামত দিলেন।এভাবে বলে যাচ্ছেন যার যার মত।হুজুর কেবলা কিন্তু চুপচাপ নিরব ভুমিকায় থাকলেন।

সম্ভবত, হুজুর কেবলার নিকট কোন মতামতই মনঃপুত হলো না। অবশেষে হুজুর কেবলা সওদাগরের কাছে, তার মতামত জানতে চাইলে উৎসাহের সহীত বললেন, ” এই (জামেয়া) মাদ্রাসা দালানই হবে।রড় সিমেন্ট যা লাগে আমিই দিব”।

সওদাগর সাহেবের এ কথা শুনে হুজুর কেবলায়ে অালম, গাউসে জামান খুবই খুশি হলেন- এবং বললেন, শাবাশ বেটা। আর সওদাগর সাহেব তার প্রতিশ্রুতি মতে ট্রাক ভর্তি রড় সিমেন্ট পাঠিয়ে দিলেন, নাজির পাড়ায় নূহ কিশতি জামেয়া প্রতিষ্ঠার জন্য।

এই সওদাগর সাহেব, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে একজন নামকরা প্রতিষ্ঠিত বিনিয়োগকারী হিসেবে নিজকে তৈরি করে নেন। যা তার কর্ম ও সাংগঠনিক জীবনে পরিলক্ষিত হয়।তার সক্রিয় সাহায্য সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আরো অসংখ্য মসজিদ,মাদ্রাসা এবং স্কুল কলেজ। আর প্রতিষ্ঠা লাভ হয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক ও ব্যবসায়ীক সংগঠন।ততমধ্যে কয়েকটি সবিশেষ উল্লেখ যোগ্য হলো-

ক) বাকলিয়া ফোরকানিয়া মাদ্রাসা।
খ) চন্দনপুরা গুলজার বেগম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
গ) চর চাক্তাই বালক উচ্চ বিদ্যালয়।

আর ধর্মীয়, সামাজিক এবং ব্যবসায়ীক সংগঠন গুলোর মধ্যে হলো-

১) বাংলাদেশ হজ্ব কমিটি।
২) আঞ্জুমান-এ খাদেমুল হজ্ব
৩) ঢাকাস্থ “চট্টগ্রাম সমিতি”

এ ছাড়াও তিনি যে সব গুরুত্বপূর্ণ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন তা হলো-

১) আঞ্জুমান ট্রাস্টের সিনিয়র সহ সভাপতি।
২) জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসার সহ সভাপতি
৩) চট্টগ্রাম শহরের সাবেক পৌরসভার কমিশনার, তার দায়িত্বকাল ছিল ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত।
৪) চট্টগ্রাম বন্দর ট্রাস্টির সম্মানিত সদ্যস
৫) বক্সির হাট মার্চেন্ট ডিফেন্স কমিটির সভাপতি
৬) বক্সির হাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান
৭) চট্টগ্রাম জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা গভর্নর।
৮) তৎকালিন পূৃর্ব পাকিস্তানের সয়াবিন ও তুলাবীজ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি।
৯) চট্টগ্রাম বর্ণিক সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সম্মানিত সদ্যস।

বানিয়ে জশনে জুলুছ, মাতৃগর্ভের ওলী, গাউসে জামান হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ কেবলা (রাহঃ)’র সাথে তিনি ১৯৭৮ সালে বাগদাদ শরীফ গাউসুল আজম দস্তগীর মাহবুবে সোবাহানি হযরত শায়েখ সৈয়্যদ আবদুল কাদের জীলানী গীলানী (রাহঃ)’র মাজার শরীফ জিয়ারত করেন। এবং একই বছর স্বস্ত্রীক হজ্ব পালন করেন। তাছাড়াও তিনি সফর করেন বার্মা, চীন, ভারত এবং পাকিস্তান সহ বিভিন্ন দেশ।

১৯৭৪ সাল তাঁর জীবনের সবচেয়ে সৌভাগ্যের সময়।এখানেই তার জনম স্বার্থক। বানিয়ে জশনে জুলুছ, ইসলামের মহান সংস্কারক হুজুর কেবলা আল্লামা তৈয়্যব শাহ (রাঃ) যখন চট্টগ্রাম আঞ্জুমান-রাহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া- কে পত্র মারফত নির্দেশ দিলেন যে, ১২ রবিউল আউয়াল হুজুর করীম রউফুর রাহীম (দরুদ)’র দুনিয়ার জমিনে পবিত্র শুভাগমনের দিন জশনে জুলুছ বের করতে হবে।

ঐতিহাসিক এবং দুনিয়ার বুকে সর্বপ্রথম ১৯৭৪ সালের এই পবিত্র জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী (দরুদ)’র নেতৃত্ব দেওয়ার পরম সৌভাগ্য হয়— আলহাজ্ব নূর মুহাম্মদ (সওদাগর) আল কাদেরী (রঃ)’র।

তাঁর যখন ওফাতের সময় ঘনিয়ে আসে, তখন তিনি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন।তাঁর শারীরিক পরীক্ষা করতে আসেন, জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নুরুল ইসলাম। ডাক্তার সাহেব তার হাতের শিরা পরীক্ষা করার পর বলেন, “আশাহীন”।

এ কথা শুনার পর তার পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরা যখন কান্নাকাটি করে বিলাপ শুরু করে দিলেন। এর কিছুক্ষণ পর সওদাগর সাহেব হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন। আর পড়তে শুরু করলেন দরুদ ও সালাতুস সালাম।

অতঃপর ডাক্তার সাহেবকে বলতে লাগলেন, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সুস্থ আছি। আমার মুর্শীদে বরহক সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রাহঃ) এবং গাউসুল আজম হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রাহঃ) ফুলেল মালা হাতে নিয়ে আমাকে বরণ করতে অপেক্ষায় আছেন।

এ বলে তিনি কালেমা শরীফ পড়তে পড়তে ইহ জগত থেকে পরজগতে চলে যান।সময়টি ছিল, দুপুর ০১: ৫৫ মিরিট। ১০ ডিসেম্বর ১৯৭৯ সাল মোতাবেক ১৯ মহররম ১৪০০ হিজরী। তার ওফাতের সংবাদ তৎকালিন সময়ে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা সহ স্থানীয় পত্রিকা সমুহে বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছিল।

পর দিন লালদীঘির ময়দানে তার প্রথম জানাজ এবং জামেয়ায় দ্বিতীয় নামাজে জানাজার পর জামেয়ার পাশের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। সেখানেই তার মাজার শরীফ রয়েছে। অসংখ্য মানুষ তার মাজার জিয়ারত করে ধন্য হচ্ছেন।

ইতিপূর্বে ১৯৭৬ সালে তিনি দরবারে সিরিকোট শরীফ জিয়ারত করতে গেলে সেখানে ওলীয়ে মাদরজাদ আ’লে রাসুল (দরুদ), আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ কেবলা (রাহঃ) তাকে খেলাফত দান করেন। আর তরিকতে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭৬ সালে দিকে গাউসে জামান আল্লামা সৈয়্যদ তৈয়্যব শাহ (রাহঃ) কর্তৃক নূর মুহাম্মদ সওদাগর সাহেব “আল কাদেরী” খেতাবে ভূষিত হন। সে থেকে তিনি “নূর মুহাম্মদ আল-কাদেরী” নামে সবার কাছে প্রসিদ্ধ হন।

দরবারে আলিয়া কাদেরীয়া- সিরিকোট শরীফের হযরত কেরাম বারবার বলে থাকেন । এ সিলসিলার মধ্যে অনেকেই আছেন যারা বাহ্যিক দিক দিয়ে সাধারণ দেখা গেলেও, ভিতরে ভিতরে তারা ওলী আল্লাহ হয়ে গেছেন।যা তারা নিজেরাও জানে না”।

শাহেন-শাহে সিরিকোটদের এ বাণীর সমুজ্জ্বল অন্যতম প্রমাণ এই “আলহাজ্ব নূর মুহাম্মদ আল-কাদেরী (রঃ)।এ মহান আলোকিত মনিষীর জীবন অনুসরণে আমরাও যেন দরবারে আলিয়া কাদেরীয়া সিরিকোট শরীফের ফয়ুজাত হাসিল করতে পারি। মহান আল্লাহ তা’আলা তার হাবীব (দরুদ) ‘র উসিলায় তৌফিক দান করুক।আমিন।

সূত্রঃ মাসিক তরজুমান, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৭ সংখ্যা।