প্রবন্ধ

ইবাদতের ভরা বসন্ত মাহে রমজান (১ম পর্ব)

লেখকঃ এম সাইফুল ইসলাম নেজামী

শাবান মাসের শেষ দিন। দিনের আলো ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। মুমিন দৃষ্টি পশ্চিম আকাশে। প্রাণে খুশির দোলা। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলে হন্যে হয়ে কী যেন খুঁজছে। ঐ দূর মিনারে অনুরণিত হলো মাগরিবের আযান। আল্লাহু আকবর.. আল্লাহু আকবর। এলো সত্যবাদীদের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। একদিকে ঘরে ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলে উঠেছে। অন্যদিকে পশ্চিম দিগন্তে আঁধারের বুক ছিঁড়ে হেসে উঠেছে চিকন সুতার মতো বাঁকা চাঁদ। রমজানের চাঁদ উঠেছে, চাঁদ উঠেছে বলে আনন্দের ঢেউ তুলেছে শিশু-কিশোররা।

আলহামদুলিল্লাহ কণ্ঠে মালিকের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে ভুল করেননি মুমিন আত্মা। কারো মুখে এক জলক হাসি! আবার কারো নয়নে আনন্দাশ্রু। মুমিন হৃদে প্রভুভক্তির ভরা জোয়ার। বছর ঘুরে আবার এলো মাহে রমজান। অফুরন্ত রহমত, বরকত, কল্যাণ ও ইবাদতসমৃদ্ধ এ মাস। জাগতিক লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে দূরে রেখে আত্মসংশোধনের মাধ্যমে ইনসানে কামেল হওয়ার অবারিত সুযোগ এনে দেয়- মাহে রমজান। মহান আল্লাহ ইসলামি বিধি-বিধানকে চাঁদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। রাসূলে পাক (দ.) ইরশাদ করেন, “তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো এবং চাঁদ দেখে ঈদ করো। কিন্তু যদি আকাশে মেঘ থাকে তাহলে ৩০ দিন পূর্ণ করো।” সহিহুল বোখারি। চাঁদ দেখে আন্দোলিত মনে দোয়া পড়ারও শিক্ষা দিয়েছেন নিখিলের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাগুরু।

 

সুনানে তিরমিজির বর্ণনা মতে চাঁদ দেখে প্রিয়নবী এই দোয়া পড়তেন- আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমানি, ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলামি, রাব্বি ওয়া রাব্বুকাল্লাহ। চাঁদ তো বারো মাসেই ওঠে কিন্তু রমজান আর শাওয়ালের নতুন চাঁদ দেখার মতো আগ্রহ অন্য মাসে থাকে না। রমজানের চাঁদ দেখা সুন্নাত। পুণ্যময় আমল। কবি ফজলে-এ খোদা চাঁদ দেখে শোকরিয়া করেছেন এভাবে- আল্লাহ তোমার হাজার শোকর, দিলে মাহে রমজান- অধম নাদান বান্দার তরে, তুমি যে মেহেরবান।

 

রমজানের এই রহমতী মাস, মিটায় প্রাণের বেহেশতী আশ, খোদা আমরা তোমার দাসানুদাস, চাই যে শান্তি সত্য জ্ঞান। মাহে রমজানের চাঁদ দেখার পুণ্য হাসিলের মাধ্যমে শুরু হয় ধৈর্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ রোজার তোড়জোড়। সিয়াম সাধনার মাসে যে শুধু সিয়ামই আছে তা কিন্তু নয়। ইবাদতের ভরা বসন্ত মাহে রমজানের দিন শুরু হয় প্রভুভক্তির সিয়ামে; আর রাতে আছে কিয়াম (তারাবিহ)।

 

সাহরি, ইফতার, ইতেকাফ, তাহাজ্জুদ, কুরআন তেলোয়াত, নফল ইবাদত, দান-খয়রাত, জিকির, দরুদ-সালাম আর কুরআনের রজনী লাইলাতুল কদর তো আছেই মহিমান্বিত রমজানে। খোদার রাহে সিয়ামের মাধ্যমে মালিকের সুদৃষ্টি, পবিত্রতম অশ্রুজলে অতীত পাপ মার্জনা আর মওলার সন্তুষ্টি অর্জনে মুক্তির মহা অফার মাহে রমজান। মুমিন প্রাণে সাহস মরুর দুলাল (দ.) ফরমান, “যে ব্যক্তি এ মাসে একটি কল্যাণময় কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করবে, সে অন্য সময়ের ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব পাবে এবং যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ ইবাদত করবে সে অন্য সময়ের ৭০টি ফরজ আমলের সওয়াব পাবে।” সুবহানাল্লাহ। মুসলিম মাত্রই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মুনিব প্রদত্ত আবশ্যকীয় ডিউটি। ঈমানদারের নিদর্শনও বটে। যে নামাজ বান্দার মেরাজ। রমজান মাসে নামাজে আসে ভিন্ন মাত্রা। মসজিদের মিনার থেকে যখন ভেসে আসে এশারের আজান তখন মা-বোনরা ঘরে আর পুরুষদের লক্ষ্য মসজিদ। মসজিদ ভর্তি মুসল্লী। মসজিদের বুকে ভরা মজলিস পেয়ে মসজিদের ইট বালিরও খুশি অন্ত নেই। এশারের ফরজ ও সুন্নাত শেষে ইমাম সাহেব নিয়ত করেন বিশেষ এক সালাতের। নাম তার সালাতুত তারাবি! তারাবি শব্দটি আরবি তারভিহাতুন থেকে, যার অর্থ বিশ্রাম করা, প্রশান্তি লাভ করা। তারাবি নামাজে যেহেতু প্রতি চার রাকাত পর পর একটু বিশ্রাম নিয়ে তাসবিহ ও দোয়া পাঠ করা হয়, তাই এই নামাজকে সালাতুত তারাবিহ বা তারাবি নামাজ বলা হয়। রমজান মাসে তারাবির নামাজ সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। তারাবি বিশ রাকাত সুন্নাত। এটা রাসুল (দ.), সাহাবী, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন এবং মুজতাহিদ ইমামগণের আমল দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত।

 

হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসুল (দ.) রমজান মাসে বিশ রাকাত তারাবি এবং বিতির পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা)। আবু দাউদ শরীফের রেওয়াত: হযরত আলী ইবনে হাসান (রা:) থেকে বর্ণিত, হযরত ওমর (রা:) এর নির্দেশে লোকদেরকে নিয়ে উবাই বিন কাব (রা:) বিশ রাকাত তারাবি পড়েছেন। এভাবে খলিফা ওমর, ওসমান, আলী (রা:)-সহ সকল সাহাবীদের ঐক্যমতে বিশ তারাবি পড়া হয়েছে। যেটা গুরুত্বের দিক থেকে ওয়াজিবের কাছাকাছি। তারাবি সম্পর্কে রাসুল (দ.) বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে নেকীর আশায় কিয়ামুল লাইল তথা তারাবি আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করা হবে। আমরা পাপীতাপীদের জন্য পাপ মার্জনার সুবর্ণ সুযোগ বিশ রাকাত তারাবিহ। এ অফার রমজান মাসেই সীমাবদ্ধ। তারাবির জামাত শেষে বিতিরও জামাতে।

 

বাহ! আজ ইবাদতের বাধ ভেঙেছে। পুণ্য আর পুণ্য। পল্লী কবি জসীম উদ্দিনও তারাবি প্রেমিক। তাই তিনি লেখেন- ‘নামাজ পড়িতে যাইব মোল্লাবাড়িতে আজ, মেনাজদ্দীন, কলিমদ্দীন, আয় তোরা করি সাজ। তারাবি শেষে সাহারির অপেক্ষা; এ সময়টাও ইবাদত হিসেবে ধরা হবে। যদিও বান্দা ঘুম থাকে। রাতের শেষাংশ। মুয়াজ্জিন মাইকে ঘোষিল। ওঠে যান, ওঠে যান, সাহারির সময় হয়েছে ওঠে যান। ঘড়িতে তখন ভোররাত আড়াইটা থেকে তিনটা। আমরা অনেক সময় প্রয়োজনে ভোররাতে ওঠি। ঐটা কিন্তু ইবাদতের খাতায় গণ্য হয় না। এ ওঠা ইবাদত। এ ভোররাতের রান্নাও ইবাদত। হ্যাঁ, আমি ঠিক বরকতময় সাহারির কথাই বলছি। রোজা রাখার উদ্দেশ্যে শেষ রাতে উষা উদয়ের আগে যে খাবার গ্রহণ করা হয়, তা সাহরি। সাহরি খাওয়া সুন্নাত। পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার ১৮৭ নং আয়াত ইরশাদ হচ্ছে, “আর তোমরা পানাহার করো, যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রাত পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করো।” তাবরানি শরীফে এসেছে- নবী করিম (দ.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি সাহরি খায়, তার ওপর আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা রহমত বর্ষণ করেন।” কুরআন-সুন্নাহ’র বর্ণনায় স্পষ্ট যে, সাহারি গ্রহণ একটি বরকতময় ইবাদত। সাহরি খাওয়ার মধ্যে অফুরন্ত রহমত, বরকত, নিয়ামত ও কল্যাণ আছে। কবি সুন্দর বলেছেন- জাগো জাগো রোজাদাররা জাগো, জাগো রে এবার, লও সেরে লও থাকতে সময়, সেহরি তোমার। সাহারির মাধ্যমে শেষ রাতে ওঠার অভ্যাস হয়। শেষ রাতে আল্লাহর রহমত অবিরাম ধারায় বর্ষিত হতে থাকে। এ সময় রয়েছে এক বিশেষ মর্যাদাময় আমল। আর তা হলো তাহাজ্জুদ নামাজ। রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ হলো আম্বিয়া আলাইহিস সালামদের সুন্নাত, আল্লাহর মাহবুব বান্দাদের অভ্যাস আর আল্লাহর সঙ্গে বান্দার গভীর সম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম পন্থা। তাহাজ্জুদের ফজিলত প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ সুরা বনি ইসলাইলের ৭৯ নং আয়াতে বলেন, “রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ নামাজ কায়েম করুন; এটা আপনার জন্য এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায়, আপনার প্রতিপালক আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন মাকামে মাহমুদে।” প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (দ.)’র হাদিসেও তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্বের কথা উল্লেখ রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি। “আফদালুস সালাতি বাদাল মাফরুদাতি সালাতুল লাইলি” অর্থাৎ ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ। এ সময় আল্লাহ প্রেমিকেরা সৃষ্টিকর্তার কাছে কায়মনোবাক্যে দোয়া মুনাজাত করেন।

 

ইসলামের প্রাথমিক যুগে শত্রুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ী হওয়ার পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল তারা রাতের শেষ ভাগে আল্লাহ দরবারে চোখের পানি ফেলতেন। যেমন সুরা আল ইমরানের ১৭নং আয়াতে বলা হয়েছে, “তারা ছিল কঠিন পরীক্ষায় অত্যন্ত ধৈর্যশীল, অটল-অবিচল, সত্যের অনুসারী, পরম অনুগত। আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ উৎসর্গকারী এবং রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।” তাহাজ্জুদ নামাজ নফসের রিয়াজাত ও তারবিয়াতের এক বিশেষ মাধ্যম। কারণ প্রভুর প্রেমে গভীর রাতে সুখশয্যা ত্যাগ করেই আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হতে হয়। এ নামাজ মন ও চরিত্রকে নির্মল ও পবিত্র করা এবং সত্য পথে অবিচল রাখার জন্য অপরিহার্য ও অতীব কার্যকর পন্থা। অন্য আর এগারো মাসে সম্ভব না হলেও রমজানে এ মর্যাদা হাসিল হয় অনায়াসে। নিয়মিত তাহাজ্জুদ অনুশীলনের সুযোগও রমজানের ভরা বসন্তের অংশ। সাহারির সময় শেষ, সাহারির সময় শেষ! এ আওয়াজ কর্ণকুহরে আসতেই রোজাদারের পানাহার বন্ধ। বন্ধ মানে বন্ধ। আল্লাহর ভয়ে এক ফোঁটা পানি বা একটি দানাও আর দাঁতে কাটে না মুসলমান। শুধু পানাহার নয়; বরং রোজাবস্থায় যা যা নিষিদ্ধ সবকিছু বন্ধ হয়ে যায় ঐ এক শব্দে (সাহারির সময় শেষ)।