প্রবন্ধ

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রিয়নবি মুহাম্মদ (দঃ)

রাশেদুল বারী

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর আদর্শ

 

“আজকে যত পাপী ও তাপী 
সব গুনাহের পেল মাফী
দুনিয়া হতে বেইনসাফী
জুলুম নিল বিদায়। “

রসুল ﷺ এর আগমনে দুনিয়া থেকে জুলুম অবিচার বিদায় নিয়েছে; সেকথা নির্দ্বিধায় সকলে স্বীকার করবে। কিন্তু দুনিয়া থেকে অশুভের আখড়া উপড়ে সত্য সুন্দর মানবতার ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠায় রসুল ﷺ কে অবলম্বন করতে হয়েছিল  নানা কৌশল-হেকমত । রসুল ﷺ এর আদর্শ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বোত্তম এবং সর্বজন স্বীকৃত আদর্শ। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এই আদর্শ অনুকরণের বিকল্প নেই।

নেতৃত্বগুণ বিনির্মাণে নবীর আদর্শ :

প্রথম বসন্তের দ্বাদশে
তিমিরান্তিক দিবাকরের আবছা প্রকাশে
আলোচ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে
আলোৎস মুহাম্মদ এলো সত্য বিকাশে।

বাল্য,তারুণ্যকাল কোন ব্যক্তিকে জাজ করার জন্য যথেষ্ট। সে হিসেবে প্রিয়নবী তাঁর বাল্য এবং তারুণ্য সময়কে সুন্দর মানবিকতা দিয়ে সাজিয়েছিলেন।  বিশ্বস্ততার দরুন তিনি আল আমিন তথা বিশ্বাসী নামে প্রসিদ্ধি পেয়েছিলেন। বিশ্বস্ততা একজন নেতার জন্য অতীব প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ গুণ। বর্তমান বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মাঝে এ গুণাবলি না থাকায় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অস্থিরতা ও অশান্তি বিরাজ করছে। নেতাদের থেকে দেশবাসী, সাধারণ জনগোষ্ঠী ও বিশ্ববাসী আস্থা হারিয়ে ফেলছে। অথচ রাসূলের জীবনী পর্যালোচনা করে দেখা যায় তাঁকে যারা নিজেদের শত্রু জ্ঞান করতো অমুসলিম বিধর্মীরাও পর্যন্ত তাঁর আমানতদারিতা এবং বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ ছিল।

ঐক্য সংকট মোকাবিলায় :

হারবুল ফুজ্জারের ধ্বংসলীলার পরক্ষণেই গঠন করেন হিলফুল ফুযুল নাম্নী শান্তি সংঘ। যা শান্তীচ্ছুক মানুষদের মনোযোগ আকর্ষণে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। সে সাথে একটি শান্তিপূর্ণ সভ্য সমাজ গঠনের নিমিত্তে হিলফুল ফুজুল এখন অবধি সর্বোত্তম ও কার্যকরী আদর্শ হিসেবেই স্বীকৃত। তিনি তৎকালীন সময়ে আরবের শান্তিকামী যুবকদের মাঝে ঐক্য তৈরি করেন। তিনি যুদ্ধবাজ আরবদের শান্তির পতাকাতলে সমবেত করেন এবং বিবাদমান গোত্রগুলো একটি সুসংহত জাতিতে রূপান্তরিত হয়। তিনি ‘হিলফুল ফুজুল’ নামের শান্তিসংঘ গঠন করে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আর্তের সেবা করা, অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা, অত্যাচারিতকে সহযোগিতা করা, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং গোত্রীয় সম্প্রীতি বজায় রাখা ছিল শান্তিসংঘের অঙ্গীকার বাণী। মানুষের কল্যাণে তাঁর গড়া স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সাংগঠনিক রীতিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এভাবে প্রাক্-নবুয়তি জীবনে মক্কায় অবস্থানকালে তিনি একটি সুস্থ সমাজ অবকাঠামোর প্রধান দিকগুলো তুলে ধরেছেন। যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে সমাজজীবনে শৃঙ্খলা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। মহানবী ﷺ হিলফুল ফুজুল বা শান্তিসংঘ গঠনের মাধ্যমে মক্কা থেকে যাবতীয় অন্যায়-অত্যাচার ও সন্ত্রাসবাদ উচ্ছেদ করে আদর্শ সমাজ গঠনে সচেষ্ট হন।

কৌশলপূর্ণ পশ্চাৎপদ চাতুর্যপূর্ণ বিজয় :

নবুয়ত প্রকাশ করেই প্রিয়নবী সর্বজনে ঘোষণা দেননি। বরং তিন বছরে গোপনে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করেন। হুদায়বিয়ার সন্ধি এ পয়েন্টের সবচে ইফেক্টিভ উদাহরণ। শান্তি রক্ষায় তিনি মক্কার কুরাইশদের দেয়া অযৌক্তিক শর্তগুলো মেনে নিয়েছিলেন হুদায়বিয়াতে। যা বাহ্যত মুসলমানদের পরাজয় বরণের মতোই ছিল। কিন্তু প্রিয়নবী ছিলেন শান্তিকামী ও মানবিক সর্দার এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চৌকশ রাষ্ট্র পরিচালক। তিনি এ সন্ধি মেনে নিয়ে কৌশলে মদিনা রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং শান্তি রক্ষার মাধ্যমে পরবর্তীতে মক্কা নগরী বিজয় করেন।

উপমাহীন উদারনীতি :

যারা সূচনা থেকে নানা ভাবে প্রিয় নবীর উপর অত্যাচার অবিচার করে আসছিল, সেসব জালিমদের তিনি সাধরণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে যে উদারতা প্রকাশ করেছেন তা বিশ্ব ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। বর্তমান বিশ্বে অরাজকতা বিরাজের নেপথ্যে উদারনীতির অভাব বেশ ভূমিকা রেখেছে। মক্কা বিজয়ের পর সেসব নবী বিদ্ধেষী অত্যাচারীদের অধীনস্থ পেয়েও তিনি ক্ষমা করে দিয়ে তাদেরকে সুপথে ফিরে আসার সুযোগ করে দেন। অথচ বর্তমানে কোন ব্যক্তি, রাষ্ট্র অন্য কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের ব্যাপারে উদারনীতি গ্রহণ করতে পারে না। যার ফলে বিশ্ব পরিস্থিতি দিনাদিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।

দাসত্ব থেকে বিশ্বসভ্যতার মুক্তি :

রসুল ﷺ এর আগমনী সময়টাকে জাহেলি তথা অজ্ঞতা,বর্বরতার যুগ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। মানুষ মানুষকে কিনে নিয়ে নিজের গোলাম বানিয়ে নিত। যার যত বেশি দাস ছিল সমাজে সে ততই বেশি মর্যাদাবান ছিল। এমন বর্বর সময়ে প্রিয়নবীর অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি পুরো সমাজের প্রথাই পরিবর্তন করে দেন। যে যত বেশি দাসমুক্ত করতে পারেন তাকেই সবচে মর্যাদাবান ঘোষণা করেন। যার ফলে নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের আস্থা ভালোবাসা ও ভরসার একমাত্র পথিকৃৎ হয়ে উঠেন প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা ﷺ।  দাস প্রথার বিরুদ্ধে প্রথম কার্যকরী প্রতিবাদ ছিল রসুল ﷺ এর। বর্তমান স্বাধীন বিশ্ব প্রিয়নবীর তৈরি করা সে রূপরেখারই ফসল।

শান্তিময় রাষ্ট্রতন্ত্র প্রতিষ্ঠা :

তৎকালীন সময়ে ছিল না কোন কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা। ছিল না রাষ্ট্র পরিচালনার কোন নিয়মনীতি বা সংবিধান। ফলে গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকতো। প্রিয়নবী ﷺ সর্বপ্রথম একটি রাষ্ট্র  গঠনের চিন্তাচেতনা দান করেন এবং সে লক্ষ্যে বেশ কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মদিনা সনদসহ বেশ কিছু গুরুত্ববহ পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে প্রিয়নবী একটি শান্তিময় পরামর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্র তন্ত্র গঠন করে পুরো বিশ্বকে আলোর পথ দেখিয়েছিলেন।

সর্বোপরি মাইকেল এইচ হার্টের একটি উদ্ধৃতির মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রিয়নবীর ﷺ এর অবদান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাবো। তিনি বলেছেন – “My choice of Muhammad to lead the list of the world’s most influential persons may surprise some readers and may be questioned by others, but he was the only man in history who was supremely successful on both the secular and religious level. It is probable that the relative influence of Muhammad on Islam has been larger than the combined influence of Jesus Christ and St. Paul on Christianity. It is this unparalleled combination of secular and religious influence which I feel entitles Muhammad to be considered the most influential single figure in human history”. [ Michael Hart in ‘The 100, A Ranking of the Most Influential Persons In History,’ New York, 1978. ]

বর্তমান অস্থিতিশীল বাকরুদ্ধ বিশ্বে শান্তির সুভাস ছড়িয়ে দিতে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শের পূর্ণাঙ্গ অনুসারী হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনায় গৃহীত সমরনীতি,উদারনীতি,পরামর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা নীতির বাস্তবায়িত হলে উত্তপ্ত অশান্ত বিশ্বে স্থিরতা ও শান্তি বিরাজ করবে এবং বিশ্ববাসীর বসবাস হবে স্বর্গীয় পরিবেশে।

লেখক-
রাশেদুল বারী
আরবি বিভাগ
২০১৮-১৯ সেশন