প্রবন্ধ

মাহে রমজান: অপার পুণ্যের সমাহার

মুহাম্মদ আবদুল করিম

মাহে রমজান দয়াবান মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকতপূর্ণ একটা মাস। আসমান থেকে অবিশ্রান্তধারায় নেমে আসে অহরহ বরকত, নিয়ামত, সজীবতা ও করুণা। ইবাদতে রবকত। পুণ্যে বরকত। একে সত্তর। নফল ফরযে, আর ফরয রূপ নেয় সত্তরটার সমান আদায়ে। হয় রিযিকেও বরকত।

 

মহান আল্লাহর তরফ থেকে বান্দার প্রতি এমন মেহেরবানি, করুণা ও অনুগ্রহের ঝর্ণা বহে, বান্দা দিবসভর পানাহার ত্যাগ করেও হয় না ক্লান্তশ্রান্ত। দিনমান অভুক্ত থেকেও রাতে দাঁড়ায় দীর্ঘ আরাধনায়। একান্ত নিষ্ঠায় করে পাক-কালামের তিলাওয়াত আর শ্রবণ। পুণ্যের এ মহিমায় নিঃসন্দেহে বৈধপ্রার্থনা মওলায়ে কায়েনাতের দরবারে কবুল।

 

 

বহুমুখী ইবাদতের সমারোহ নিয়ে এ মহিমান্বিত মহিমার আগমন। পাপকে ফেরায় পূণ্যের পথে। নেকির পথচলা শেখায় বিপথগামী মলিনাত্মাকে। কঠোর হৃদয়ে আনে আল্লাহ-ভীতি। আয়োজন হয় অকৃত্রিম আরাধনা-সাধনার। বহুবিধ বন্দেগির পসরা বসে ঘরেঘরে। রূপ নেয় ভিন্নাঙিকে ভিন্ন পরিবেশ। ইবাদতের পাতা-পল্লবে সাজে মুমিনের ইমান-বৃক্ষ।

প্রখ্যাত সাহাবিয়ে রসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সালমান ফারেসি রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা‘বানের শেষ দিবসে আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে মিম্বর মুবারকে উঠলেন। ইরশাদ করেন, হে আমার সাবাহিরা! এক মহা বরকতময় মাস তোমাদের নিকট আসছে। এক সম্মানিত মহিমা; যাতে আছে হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ ও উত্তম রজনী। মহান আল্লাহ এ মাসের রোজা ফরয করেছেন। আর রাতের বেলা নামায (তারাবিহ) আদায়কে করেছেন নফল (সুন্নাত)। যে ব্যক্তি এ মাসে একটা নফল কাজের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জন করবে সে যেন অন্যমাসে একটা ফরয আদায় করল। আর যে ব্যক্তি একটা ফরয আদায় করবে সে অন্যমাসে যেন সত্তরটা ফরয আদায় করল। [মিশকাতুল মাসাবিহ, পৃ. ১৭৩]

 

পুণ্যের ধারা সীমাহীনভাবে বয়ে চলে এ মাসে। একটা ভালো কাজের প্রতিদান দশ থেকে সাতশত পর্যন্ত বৃদ্ধি হওয়ার সাক্ষ্য বহন করে ঐশী বাণীসমূহ। রোযাদারদের জন্য সজ্জিত বেহেশতে রয়েছে ‘রাইয়ান’ নামক ফটক। এ ফটক কেবল রোযাদারদেরকেই আহ্বান করবে। অবিরত ক্ষমা-করুণার বার্তাই মাহে রমযানের পয়গাম। আত্মিক পরিশুদ্ধির অপার সম্ভাবনা এ মহিনায়। প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে উত্তরণের অনন্য মাধ্যম হিসেবে মহান আল্লাহ বান্দার জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন রোযা পালনের। পাক-কালামের বানী, ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ [আল-কুরআন, সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৩]

 

 

রোযা, ইফতার, তারাবিহ, তিলাওয়াতে কুরআন, তাহাজ্জুদ সহ হরেক ইবাদতের যথেষ্ট সুযোগ এ মাসে। প্রতিটি আমলে আছে পাহাড়সম নেকি। হাদিসে পাকের ঘোষণা, যে কেউ এ মাসে কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে, তা হবে ঐ ব্যক্তির পাপমোচন ও জাহান্নাম-মুক্তির হাতিয়ার। সে রোযাদারের সমান সাওয়াব লাভ করবে, কোনো হ্রাস হবে না রোযাদারের প্রাপ্য সাওয়াবে। পূণ্যের এ লোভনীয় মহাযাত্রায় সাহাবায়ে কিরাম জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রসুল! আমাদের প্রত্যেকের নিকট রোযাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই।

 

তখন আল্লাহর প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এ সাওয়াব আল্লাহ তা‘আলা ঐ ব্যক্তিকে দান করবেন, যে কোনো রোযাদারকে দুধের শরবত, খেজুর অথবা পানির শরবত দিয়ে ইফতার করাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে পরিতৃপ্ত করে খাওয়াবে, দয়াময় আল্লাহ তাকে আমার ‘হাউয’ থেকে এমন পানীয় পান করাবেন, সে জান্নাতে প্রবেশ করা অবধি আর পিপাসিত হবে না। এটি এমন মহিমান্বিত মাস যার প্রথমাংশ রহমত, মধ্যের অংশ মাগফিরাত আর শেষাংশ জাহান্নাম থেকে মুক্তির সময়। [মিশকাতুল মাসাবিহ, পৃ. ১৭৪।]

 

মাহে রমজানের প্রতিটি ক্ষণ-মুহূর্ত বান্দার জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মহানিয়ামত স্বরূপ। এ মাসের প্রতিটি মুহূর্ত বান্দা পাপপঙ্কিলতা হতে মুক্তির অনন্য স্মারক। আত্মার উন্নতি, রুহানি শক্তির উন্মেষ সহ যাবতীয় পুণ্যবলে বলীয়ান হওয়ার মোক্ষম সময় এ মহিনা। ক্ষমা-করুণার স্বর্গীয় এ মিছিলে যোগদান করা আমাদেরও উচিত। নয়তো আমাদের চেয়ে হতভাগা আর কেউ হবে না। রসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র হাদিসের বর্ণানা থেকে জানা যায়, একবার তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে কদম মুবারক রেখে বললেন আমিন! দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সিঁড়িতেও কদম মুবারক রেখে একইভাবে বললেন আমিন!! সাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসুল (দ.)! আপনি প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সিঁড়িতে কদম মুবারক রেখে আমিন বলেছেন- এর রহস্য কী? রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘জিবরাইল তখন তিনটি দোয়া করেছেন। আমি আমিন বলেছি।

 

দোয়া তিনটি হলো- এক. ধ্বংস তার জন্য, যে মাস পেয়েও গোনাহ মাফ করিয়ে নাজাত নিশ্চিত করেনি। দুই. বৃদ্ধ মাতাপিতা পেয়েও যে জান্নাত অর্জন করতে পারল না। তিন. রসুলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র নাম শুনেও যে দরুদ শরিফ পড়ল না। (মিশকাতুল মাসাবিহ) অন্য বর্ণনায় আঁ হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তার নাক ধুলোকতায় মলিন হোক যে পেলো অথচ নিজের গোনাহসমূহ ক্ষমা করাতে পারল না। [মুসনাদে বাযযার]

 

 

তাই, অপার পুণ্যের সমাহার মাহে রমযানে আমাদের নেকির পাল্লা ভারী আর পাপের নিক্তি শূন্যময় করার জন্য এগিয়ে আসা উচিত। জীবনের সুরক্ষিত পঞ্জিকা থেকে প্রতি মুহূর্তে ক্ষয়ে যাচ্ছে আমাদের বরাদ্দ হায়াত। এ সুযোগ যেনো হারিয়ে না যায় নিজেদের অবহেলায়।

 

লেখক- মুদাররিস, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মহিলা মাদ্রাসা।