জুমার খুতবা

১০ মহররম| ১৪৪৩ হিজরি| ২০ আগস্ট| ২০২১

ইসলামে মহররম ও আশুরার গুরুত্ব

মহররম ও আশুরা:

মহররম মাস ইসলামী হিজরি বর্ষের প্রথম মাস। মাসটি ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যমন্ডিত, হিজরি বর্ষের সূচনা মাস হিসেবে এটি প্রসিদ্ধ। মহররম শব্দটি আরবি হরমুন ধাতু হতে নির্গত। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “মিনহা আরবাআতুন হুরুমুন” যার অর্থ:- সম্মানিত, মর্যাদা সম্পন্ন, হুরুম শব্দের এক অর্থ নিষিদ্ধ যেমন ইসলামে মুহররম, জিলক্বদ, জিলহজ ও রজব এ চার মাস অতি পবিত্র মাস হিসেবে ঘােষণা করা হয়েছে যার অবমাননা, অসম্মান নিষিদ্ধ। অর্থাৎ এ মাসগুলােতে যুদ্ধ বিগ্রহ, রক্তপাত, সংঘাত সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।

আশুরা:

আরবি আশরা হতে আশুরা, আশারা অর্থ দশ, আশুরা অর্থ দশম। ইসলামী পরিভাষায় মহররম মাসের দশম তারিখকে আশুরা বলা হয়। আশুরার নামকরণ প্রসঙ্গে
“গুনীয়াতুত তালেবীন কিতাবে উল্লেখ হয়েছে এ দিবসটি যেহেতু মহররমের দশম তারিখে তাই একে আশুরা বলা হয়। অনেকের মতে আল্লাহ তা’আলা উম্মতে মােহাম্মদীকে বিভিন্ন দিবসে যে বুজুগী ও মর্যাদা দান করেছেন তারই ধারাবাহিকতায় এ দিবসের স্থান দশম হিসেবে হওয়ায় একে আশুতরা বলা হয়। (গুনীয়াতুত তালেবীন, পূঃ ২৪৮)

আশুরা দিবসে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী:

আশুরা দিবসের অসংখ্য ফযীলতের প্রমাণ পাওয়া যায়, আংশিক বর্ণনা করা হলাে:

১. আল্লাহ তা’আলা এ দিবসে আসমান-জমিন, লওহ-কলম সুষ্টি করেছেন।

২. এ দিনে আল্লাহ তা’আলা হযরত আদম (আ:) ও হযরত হাওয়া (আ:) কে সৃষ্টি করেছেন।

৩. এ দিবসে আল্লাহ হযরত আদম আলায়হিস সালাম’র তাওবা কবুল করেছেন।

৪. এ দিবসে হযরত নূহ (আ:)’র কিস্তি ইরাক ও আরমেনিয়ার অন্তর্গত জুদী নামক পর্বতে এসে থেমেছে।

৫. এ দিবসে আল্লাহ তা’আলা হযরত ইবরাহীম (আঃ) কে খলিলুল্লাহ উপাধিতে ভূষিত করেন। এ দিনেই নমরুদের অগ্নিকুন্ড থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিলেন।

৬. এ দিনেই চল্লিশ বৎসর পর হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন।

৭. এ দিবসে হযরত ইদরীস আলাইহিস সালাম ৩৬৫ বছর বয়সে সশরীরে চতুর্থ আসমানে আরােহণ করেন।

৮. এ দিবসে হযরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম দীর্ঘ রােগ থেকে মুক্তি লাভ করেছিলেন।

৯. এ দিবসে হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন।

১০. এ দিবসে হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এর তাওবা কবুল করেছেন, এ দিবসে তিনি নিজ রাজ্য পুনরুদ্ধার করেছিলেন।

১১. এ দিবসেই হযরত সােলায়মান আলাইহিস সালাম কে গােটা পৃথিবীর রাজত্ব দান করেছেন।

১২. এ দিবসে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম কে আসমানে তুলে নৈওয়া হয়। মিরাজ রজনীতে আসমানী জগতে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল।

১৩. এ দিবসে হযরত মুসা আলাইহিস সালামকে ফিরআউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছেন।

১৪. এ দিবসে উম্মুল মুমেনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা.) এর সাথে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র আকদ মুবারক সম্পন্ন হয়েছিল।

১৫. আল্লাহ তা’আলা এ দিবসেই সর্ব প্রথম আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন।

১৬. এ দিবসেই আসমান থেকে সর্ব প্রথম রহমত অবতীর্ণ হয়েছে।

১৭. এ দিবসেই হযরত জিব্রাইল (আ:) কে সর্ব প্রথম জমীনে রহমতসহ প্রেরণ করেন।

১৮. ৬১ হিজরির ১০ মহররম শুক্রবার ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে ৫৬ বৎসর ৫ মাস ৫ দিন বয়সে প্রিয় নবীর দৌহিত্র বেহেস্তী যুবকদের সরদার, মওলা আলী শেরে খােদার নয়নমনি, মা ফাতেমার কলিজার টুকরা, নানা জান রাহমাতুল্লীল আলামীনের উম্মতের দিশারী, সত্য মিথ্যার পার্থক্য বিধানকারী, হক-বার্তিলের নীতি নির্ধারক, মিল্লাতে ইসলামিয়ার মুহসেনে আজম, তাজেদারে কারবালা, হযরত ইমাম হােসাইন রাদিয়ল্লাহু তা’আলা আনহু সপরিবারে ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে ইতিহাসে অভিশপ্ত, ঘৃণিত, কলংকিত ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শাহাদত বরণ করেন।(আনােয়ারুল বয়ান, খন্ড: ১ম, পৃঃ ২২২-২৪০)

১৯. এ দিবসে ইসরাফীল আলাইহিস সালাম কর্তৃক সিঙ্গায় ফুকারের মাধ্যমে কিয়ামত তথা মহা প্রলয় সৃষ্টি হবে। (নুজহাতুল মাজালিস, খন্ড:১ম, পৃ: ১৮১)

হযরত ইমাম হােসাইন (রা.)’র মর্যাদা:

নবীজির দৌহিত্র নবী কাননের প্রস্ফুটিত গােলাপ হযরত ইমাম হােসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু ৪ হিজরির ৫ শাবান মদীনা মনােওয়ারায় জন্ম গ্রহণ করেন।

তাজেদারে মদীনা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কান মুবারকে আজান দিয়েছেন। নবীজি থুথু মুবারক তাঁর মুখে প্রবেশ করিয়ে তাঁর জন্য দুআ করেন। সপ্তম দিনে তাঁর আক্বীকা করেন। এবং হােসাইন নামকরণ করেন। নবীজি এরশাদ করেছেন, হযরত হারুন আলায়হিস সালাম নিজের সন্তানদের নাম রাখেন শিব্বির ও শব্বির এ নামের অর্থ হাসান ও হােসাইন, আমিও আমার সন্তানদের (দৌহিত্র) নাম হাসান ও হােসাইন নামকরণ করলাম।

হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হাসান ও হােসাইন জান্নাতবাসী নাম সমূহের দুটি নাম। ইতােপূর্বে কারাে নাম হাসান ও হােসাইন রাখা হয়নি। (আস সাওয়ায়েকুল মুহরিকা, পৃঃ ১১৮, আশশরফুল মুআয়যাদ, পৃ: ৭০)

হযরত হােসাইন রাদিয়ল্লাহু আনহুর মর্যাদা প্রসঙ্গে রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “হােসাইন আমার থেকে আমি হােসাইন থেকে। আল্লাহ ঔই ব্যক্তিকে ভালবাসেন যিনি হােসাইনকে ভালবাসেন।” (তিরমিযী, খন্ড: ২য়, পৃ: ২১৯, মিশকাত, ৫৭১, বরকাতে আলে রসূল, পূ: ১৪৪)

হযরত ইমাম হাসান ও হােসাইন (রা.)’র প্রেমিকদের জন্য নবীজির দুআ:

একদা প্রিয় রাসূলের কোলে হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হােসাইন (রা.) উপবিষ্ট, এ দুজনকে লক্ষ্য করে নবীজি এরশাদ করেন, এ দুজন আমার সন্তান এবং আমার কন্যা ফাতেমার সন্তান এবং এরশাদ করেছেন, হে আল্লাহ আমি এ দুজনকে ভালবাসি তুমিও তাদেরকে ভালবাস, এবং যে ব্যক্তি এ দুজনকে ভালবাসবে তাদেরকেও ভালবাস। (তিরমিযী, খন্ড:২য়, পূ: ২১৮, মিশকাত, পৃঃ ৫৭০)

হযরত হাসান হােসাইন জান্নাতী যুবকদের সরদার:

হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হাসান ও হাসাইন জান্নাতী যুবকদের সরদার। (তিরমিযী, খন্ড: ২য়, পৃ: ২১৮, মিশকাত: পৃঃ ৫৭০)

নবীজি আরাে এরশাদ করেছেন, (হাসান, হােসাইন) এ দুজন দুনিয়াতে আমার দুটি ফুল। (বুখারী শরীফ, খন্ড:১ম, পৃঃ ৫২০)

মহররমের দশম রজনীতে ইসলামে ইবাদত ও রিয়াযত:

মহররমের দশম তারিখের রজনীতে হক ও বাতিলের সাথে ঈমান রক্ষার চূড়ান্ত অগ্নি পরীক্ষায় কারবালার মরু প্রান্তরে সপরিবারে কাফেলার সকল সাথীদের নিয়ে মহান প্রভুর সমীপে ইবাদুত রিয়াজত, তাসবীহ, তাহলীল, যিকর, ও কুরআনুল করীমের তিলাওয়াতের মধ্যদিয়ে রজনী অতিবাহিত কুরলেন, তাবুতে ফজরের আজান ধ্বনি উচ্চারিত হলাে হােসাইনী মুসলমানরা ইমামে পাকের পিছনে ফজরের নামায আদায় করলেন।সম্মুখে ইয়াজিদী সৈন্যদের অসংখ্য উন্মুক্ত তরবারী, হত্যার নেশায় মত্ত, এদিকে সত্য প্রতিষ্ঠার আদর্শিক সংগ্রামে অকুতােভয় হােসাইনী কাফেলার ক্ষুদ্র বাহিনী কঠিন মুহূর্তেও খােদায়ী প্রেমে বিভাের ইশকের নামায আদায়ে নিয়ােজিত।

ভিনদেশী মুসাফির ক্ষুধার্ত পিপাসার্ত:

নবী পরিবারের নূরানী সদস্যবর্গ নিজেদের জীবনের সর্বশেষ ফজরের নামায আদায় করে নিলেন। ৬১ হিজরির ১০ই মহররম যেন বিশ্বময় মহাপ্রলয়ের সৃষ্টি হলাে। সূর্য উদিত হলাে, কুখ্যাত নরাধম ইয়াজিদের প্রেতাত্না আমর বিন সাদের নেতৃত্বে বাইশ হাজার ইয়াজিদী সৈন্যদের বর্বরােচিত মহড়া শুরু হলাে, পৃথিবীর ইতিহাসে এক অসম যুদ্ধের বিভৎস উল্লাস । নবী মুস্তফার দ্বীনের ঝান্ডাকে সমুন্নত রাখার দিপ্ত শপথে জীবনের বিনিময়ে ইসলামের দিপ্ত মশাল প্রজ্জ্বলিত রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নবী মুস্তফার পবিত্র রক্তের উত্তরাধিকার আওলাদ পাকগণ ধৈর্য, বীরত্ব, সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল। আদর্শের উজ্জ্বল প্রতীক সকলে যেন শাহাদতের সুধা পানে জান্নাতের অপেক্ষায়।

ইমামের শাহাদত ও আমাদের শিক্ষা:

ইমামে আলী মকাম হযরত ইমাম হােসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সপরিবারে ৭২ জন আহলে বায়তে রসূল বুকের তাজা রক্ষ দিয়ে ইসলামের ঝান্ডাকে সমুন্নত করেছেন, তারই শাহাদাত ও আত্মত্যাগ অনন্তকাল সত্যান্বেষীদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। কারবালা ছিল মূলত: জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধ। সকল প্রকার অন্যায়, অসত্য, শটতা, কপটতা, মিথ্যাচার, পাপাচার, ব্যভিচার, জুলুম, নির্যাতনের বিরূদ্ধে সােচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ করা, সকল প্রতিকূলতা প্রতিবন্ধকতা, বাধা অতিক্রম করে সত্যের পথে অটল অবিচুল থাকা কারবালার প্রকৃত শিক্ষা ও ইমামে হােসাইনের জীবন্ত আদর্শ।

তাই আসুন আশুরার ফজীলত অর্জনে নফল রোজা পালন, কুরআন তিলাওয়াত, শােহাদায়ে কেরামের জীবন-কর্ম, আলােচনা ও শাহাদতে কারবালা মাহফিল আয়ােজনের মাধ্যমে আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তুষ্টি অর্জন করি।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়বিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মােবারক শাহী জামে মসজিদ