জুমার-খুৎবা

হজ্ব: ফাযায়েল ও মাসায়েল | জুমার খুতবা

সৈয়দ মুহাম্মদ জালাল উদ্দিন আযহারী

ইসলামের মূল স্তম্ভসমূহের পঞ্চমটি হল হজ্ব। ঈমান, নামাজ, যাকাত ও রোজার পরই হজ্বের অবস্থান। হজ্ব মূলত কায়িক ও আর্থিক উভয়ের সমন্বিত একটি ইবাদত। তাই উভয় দিক থেকে সামর্থ্যবান মুসলিমের উপরই হজ্ব পালন করা ফরজ। অর্থাৎ হজ্ব আদায়ে সক্ষম এমন শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি হজ্বে যাওয়া- আসার ব্যয় এবং হজ্ব আদায়কালীন সাংসারিক ব্যয় নির্বাহে সক্ষম এমন সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর হজ্ব আদায় করা ফরজ। যা সক্ষম ব্যক্তির জীবনে একবারই ফরজ। হজ্ব অস্বীকারকারী সম্পূর্ণরূপে ইসলাম থেকে বারিজ হয়ে যায়। আল্লাহ তা’লা বলেন, “এবং সামর্থ্যবান মানুষের উপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ্ব করা ফরজ। আর যে কুফরী করে, তবে আল্লাহ তো নিশ্চয় সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াতঃ ১৭)

হজ্ব পালন উত্তম ইবাদাত:

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে সর্বোত্তম আমল সম্পর্কে আরয করা হলে তিনি এরশাদ করেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনা। জিজ্ঞেস করা হলো, অতঃপর কোনটি? তিনি বলেনঃ আল্লাহর পথে জিহাদ করা। জিজ্ঞেস করা হলো, অতঃপর কোনটি তিনি বলেনঃ হজ্ব-ই-মাবরূর (মাকবুল হয়)। (বুখারী, হাদিস নং-১৫১৯)

তিনি আরও এরশাদ করেনঃ এক উমরা হতে অন্য উমরা, এ দুয়ের মাঝে যা কিছু (পাপ) ঘটবে তার জন্য কাফফারা। আর মাবরূর হজ্বের বিনিময় জানতে ভিন্ন অন্য কিছু নয়।” (বুখারি: হাদিস নং – ১৫১৯)

তিনি আরও এরশাদ করেন: ইসলাম গ্রহণ পূর্বকৃত সকল পাপকে মুছে দেয়। হিজরত তার পূর্বের সকল শুনাহ মুছে দেয় ও হজ্ব তার পূর্বের সকল পাপ মুছে দেয়। (মুসলিম: হা-১৭৩)

তিনি আরও এরশাদ করেনঃ ‘তোমরা পর পর হজ্ব ও উমরা আদায় করো। কেননা তা দারিদ্র্য ও পাপকে সরিয়ে দেয় যেমন সরিয়ে দেয় কামারের হাপর লোহা স্বর্ণ-রুপার ময়লাকে। আর হজ্বে মাবরূরের সাওয়াব তো জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়। (নাসায়ী ২/৫৫৮)

 

হজ্ব ও ওমরা পালনকারীগণ আল্লাহর মেহমান:

 

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: আল্লাহর পথের সৈনিক, হজ্বযাত্রী ও ওমরাযাত্রীগণ আল্লাহর প্রতিনিধি। তারা আল্লাহর নিকট দোয়া করলে তিনি তা কবুল করেন এবং কিছু চাইলে তা তাদের দান করেন। (ইবনু মাজাহ, হাদিস -২৮১৩)

তিনি আরও এরশাদ করেন: হজ্বযাত্রীগণ ওমরাযাত্রীগণ আল্লাহর প্রতিনিধিদল। তারা তাঁর নিকট দোয়া করলে তিনি তাদের দোয়া কবুল করেন এবং তাঁর নিকট মাফ চাইলে তিনি তাদের ক্ষমা করেন। (ইবনু মাজাহ, হাদিস নং-২৮১২)

মাবরুর হজ্বের প্রতিদান:

মাবরুর (মাকবুল) হজ্বের একমাত্র প্রতিদান হলো জান্নাত। যে অশ্লীল কাজ ও কথা থেকে বিরত থেকে হজ্ব আদায় করল, সে তার মাতৃ-গর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনের মতো গুনাহ থেকে পবিত্র হয়ে ফিরে এলো (বুখারী, হাদিস-১৪৩১)

হজ্বের প্রত্যেকটি কাজে আল্লাহর যিকর বিদ্যমান:

হজ্ব এমন একটি ইবাদাত যার প্রত্যেকটি কাজে আল্লাহর যিকর রয়েছে। তাওয়াফ, সাঈ, রমল, জিমার (পাথর নিক্ষেপ), মিনা, মুযদালিফাহ, আরাফাহসহ প্রত্যেকটি নির্দেশনায় আল্লাহর যিকর ধ্বনিত হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তারপর যখন তোমরা তোমাদের হজ্বের কাজসমূহ শেষ করবে, তখন আল্লাহকে স্মরণ কর, যেভাবে তোমরা স্মরণ করতে তোমাদের বাপ-দাদাদেরকে এমনকি তার চেয়েও অধিক স্মরণ। আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে যে বলে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়াতেই দিয়ে দিন। তাদের জন্য আখিরাতের কোন অংশ নেই। (সূরা আল বাকারাহ, আয়াতঃ২০০)

হজ্বের প্রকারভেদ:

হজ্ব তিন প্রকার। যথাঃ ১. তামাত্তু, ২. ক্বিরান, ৩.ইফরাদ।

তামাত্তু: হজ্বের মাসগুলোতে (শাওয়াল, যিলকদ ও যিলহজ্ব) শুধু ওমরার নিয়ত করে ইহরাম বেঁধে মক্কায় পৌঁছার পর ওমরার ফরজ ও ওয়াজিবসমূহ আদায় করে ইহরাম খুলে ফেলা এবং উকুফে আরাফার পূর্বে শুধুমাত্র হজ্বের নিয়ত করে পুনরায় ইহরাম বাঁধার নাম হজ্বে তামাত্তু।

ক্বিরান: একই ইহরামে ওমরা ও হজ্ব কার্য সম্পাদন করাকে হচ্ছে ক্বিরান বা কেরান হজ্ব বলে।

ইফরাদ: শুধুমাত্র হজ্বের নিয়ত করে ইহরাম বেঁধে হজ্ব করার নাম ইফরাদ হয়।

হজ্বে তামাত্তু ও হজ্বে কেরান এ শোকরানা স্বরূপ দম দেয়া ওয়াজিব। হজ্বে ইফরাদ-এ কুরবানি ওয়াজিব নয়।

 হজ্ব যাদের উপর ফরজ:

(১) মুসলিম হওয়া (২) বালিগ হওয়া (৩) স্বাধীন হওয়া (8) বিবেকবান হওয়া (৫) নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া, তথা যে ব্যক্তির এ পরিমাণ ধন সম্পদ আছে যে, সে হজ্বের সফর (পথ খরচ) বহন করতে সক্ষম এবং তার অনুপস্থিতিকালীন তার পরিবারবর্গের প্রয়োজন মেটানোর মতো খরচ রেখে যেতে সক্ষম, এমন ব্যক্তির ওপর হজ্ব ফরজ। (৬) যাতায়াতে নিরাপত্তা (৭) মহিলাদের সাথে মুহরিম থাকা

হজ্ব একবারই ফরজ:

হজ্ব একবারই ফরজ হয় প্রত্যেক মুসলমানের উপর সারা জীবনে একবারই ফরজ। একবার ফরজ হজ্ব আদায়ের পর পরবর্তী হজ্বগুলো নফল হিসেবে গণ্য হবে।

বিনা ওযরে হজ্ব বিলম্ব করা অনুচিৎ:

হজ্ব যেহেতু একবারই ফরজ তাই যার উপর হজ্ব ফরজ হয়েছে সে যদি মৃত্যুর আগে যে কোনো বছর হজ্ব আদায় করে, তবে তার ফরজ আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু হজ্ব বিধানের মৌলিক তাৎপর্য, তার যথার্থ দাবি ও আসল হুকুম হচ্ছে হজ্ব ফরজ হওয়ার সাথে সাথে আদায় করা। বিনা ওযরে বিলম্ব না করা। কারণ বিনা ওযরে এভাবে বিলম্ব করাও শুনাহ। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি হজ্ব করার ইচ্ছে করে, সে যেন তাড়াতাড়ি তা আদায় করে নেয়। কারণ যে কোনো সময় সে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে বা বাহনের ব্যবস্থাও না থাকতে পারে অথবা অন্য কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। (মুসনাদ-এ আহমদ, হা: ১৮৩৩)

তিনি আরও ইরশাদ করেন, ফরজ হজ্ব আদায়ে তোমরা বিলম্ব করো না। কারণ তোমাদের কারো জানা নেই তোমাদের পরবর্তী জীবনে কী ঘটবে। (মুসনাদে আহমদ, হা: ২৮৬৭)

তিনি আরও ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমি আমার বান্দার শরীরকে সুস্থ রাখলাম, তার বিযিক ও আয়-উপার্জনে প্রশস্ততা দান করলাম। পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যদি সে আমার গৃহের হজ্বের উদ্দেশ্যে আগমন না করে তবে সে হতভাগা, বঞ্চিত। (সহীহ ইবনে হিব্বান, হা: ৩৬৯৫)

হজ্ব না করার ভয়াবহতা:

হজ্ব করার শক্তি-সামর্থ্য ও অর্থ-বিত্ত থাকার পরও যে ব্যক্তি হজ্ব করে না তার সম্পর্কে হাদীস শরীফে কঠোর হুমকি প্রদান করা হয়েছে। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- যে ব্যক্তি হয় করার সামর্থ্য রাখে, তবুও হজ্ব করে না সে ইহুদী হয়ে মৃত্যুবরণ করল কি খৃষ্টান হয়ে তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৫৭৮)

যারা হজ্বের সফরের সৌভাগ্য লাভ করেন তারা আল্লাহর মেহমান। তাই প্রত্যেকের উচিত সর্বদা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য ও মুহাব্বতের অনুভূতি নিয়ে বায়তুল্লাহ ও অন্যান্য শেআর ও নিদর্শনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। সকল প্রকার শুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। মন্দ-কলহ, ঝগড়া-বিবাদ এবং অন্যায়-অশ্লীলতা থেকে সর্বাত্যকভাবে দূরে থাকা।

আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুক, আমীন।