জুমার-খুৎবা

হজ্ব সম্পর্কিত পরিভাষা ও হাজীদের করণীয় (ছবিসহ)

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

জুমার খুতবা

০৯ জিলকদ|১৪৪৩ হিজরি|শুক্রবার|১০ জুন’২২ 

হজ্ব সম্পর্কিত পরিভাষা ও হাজীদের করণীয়

হজ্ব সম্পর্কিত পরিভাষা:

 

 

ইযতিবা:

ইহরামের চাদর ডান বগলের নীচের দিক দিয়ে পেঁছিয়ে এনে বাম কাঁধের উপর রাখাকে ইযতিবা বলা হয়।

 

 

জমরাত:

মিনায় তিনটি উঁচু স্তম্ভ রয়েছে সেখানে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হয়। এগুলোর মধ্যে মসজিদে খায়ফের নিকটবর্তী পূর্বদিকে অবস্থিত জমরাকে জমরায়ে উলা বলা হয়। এর পরবর্তীটি যা মধ্যস্থানে অবস্থিত একে জমরায়ে উসতা বলা হয়। এর পরেরটিকে জমরায়ে আকাবা অথবা জমরাতুল উখরা বলা হয়।

 

 

রমল:

তাওয়াফের প্রথম তিন প্রদক্ষিণে বীরের ন্যায় বুক ফুলিয়ে কাঁধ দুলিয়ে দ্রুত চলাকে রমল বলে।

 

 

যমযম: 

কাবা ঘরের ৪০ ফুট পূর্বদিকে মা’তাফ এর ১০ফুট নীচে একটি প্রসিদ্ধ পানির ফোয়ারার নাম যমযম। হযরত ইসমাঈল আলাইহস্‌ সালাম এর পা মোবারকের আঘাতে আল্লাহর কুদরতে এ পানির কুপের সৃষ্টি হয়। এটাও দু’আ কবুলের স্থান। আর যমযম কূপের পানিতো সকল রোগ-ব্যাধির মহৌষধ। এর পানি পান করা, চোখে-মুখে সীনায় মালিশ করা ভাল ও বরকতময়।

 

 

সায়ী: 

সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝখানে বিশেষ পদ্ধতিতে সাতবার দৌড়ানোকে সায়ী বলে।

 

 

মীযাবে রহমত: 

বায়তুল্লাহ শরীফের ছাদে একটি নল লাগানো আছে। এ স্থানটি হাতীমের উপরে অবস্থিত এটিও দু’আ কবূলের অন্যতম স্থান।

 

 

মুলতাযাম: 

হাজরে আসওয়াদ এবং বায়তুল্লাহ শরীফের দরজার মধ্যবর্তী স্থানকে মুলতাযাম বলা হয়। একে জড়িয়ে ধরে দু’আ করা সুন্নাত।

 

 

মসজিদে খায়ফ:

মিনায় সবচেয়ে বড় মসজিদ মিনায় উত্তর দিকে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত।

 

 

মসজিদে নামিরা: 

আরাফাত ময়দানের একটি বড় মসজিদ এই মসজিদ থেকেই ইমাম হজ্বের খুত্‌বা দিয়ে থাকেন।

 

 

মসজিদে আয়েশা: 

মসজিদে হারাম হতে প্রায় তিন মাইল উত্তরে হেরমের সীমানার বাইরে তানঈম নামক স্থানে অবস্থিত। উমরা পালনকারীগণ এখানে এসে ইহরাম বেঁধে থাকেন।

 

 

মীলাইনে আখযারাইন: 

সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে নির্দিষ্ট একটি স্থান। এ স্থানটি দ্রুতগতিতে অতিক্রম করতে হয়। স্থানটির দুই পাশের দেয়ালে সবুজ বাতি দ্বারা চিহ্নিত করা আছে।

 

 

হাদী: 

হাজ্বী সাহেবগণ কোরবানী করার জন্য যে পশু সাথে নিয়ে যায় তাকে হাদী বলে।

 

 

মা’তাফ: 

রায়তুল্লাহ শরীফের চতুর্দিকস্থ তাওয়াফ করার স্থান এ স্থানে মরমর পাথর দ্বারা বাঁধানো রয়েছে।

 

 

ইয়াওমুল আরাফা: 

৯ই যিলহজ্ব যেদিন হজ্ব অনুষ্ঠিত হয় এদিন হাজ্বী সাহেবগণ আরাফার ময়দানে অবস্থান করে থাকেন।

 

 

মুযদালিফা:

 

 

 

মিনা ও আরাফাতের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত একটি ময়দান যা, মিনা হতে তিন মাইল পূর্ব দিকে অবস্থিত ৯ যিলহজ্ব দিবাগত রাতে হাজ্বীগণকে এ ময়দানে অবস্থান করতে হয়।

হাজরে আসওয়াদ: 

 

অর্থ কালো পাথর। খানায়ে কাবার পূর্ব দক্ষিণ কোণে বুক সমান উঁচু করে দেয়ালের সাথে সেঁটে দেয়া হয়েছে। চারদিকে রূপা দিয়ে মোড়ানো। তাওয়াফের সময় একে চুম্বন করতে হয়।

হাতীম:

আল্লাহর ঘরের উত্তর পাশের সীমানা সংলগ্ন একটি জায়গা প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে, তাকে “হাতীম” বলে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নুবুওয়াত প্রকাশের কিছু দিন পূর্বে কোরাইশরা কাবা শরীফ পুণ:নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং সকলে ঐক্যমত হয়েছিল যে, এ ঘর নির্মাণে কেবলমাত্র হালাল সম্পদই ব্যবহার করা হবে। পরিশেষে দেখা গেল তাদের যে সম্পদ তা দিয়ে পুরো অংশ পুণ:নির্মাণ সম্ভব নয়। তখন উত্তর দিকে তার ছয়গজ পরিমাণ জায়গা ছেড়ে দিয়ে কাবা ঘর পুণ: নির্মাণ করলো সেই ছেড়ে দেয়া অংশই ‘হাতীম’ নামে পরিচিত।

মীকাত:

হাজ্বীগণ যে স্থান থেকে ইহরাম বেঁধে থাকেন সেস্থানকে মীকাত বলা হয়।

রমী: 

শয়তানের উদ্দেশ্যে কঙ্কর নিক্ষেপ করাকে রমী বলে।

হজ্বের নিয়ত:

অজু অথবা গোসল করে ইহরাম পরিধান করবেন এবং দু’রাকাত নফল নামায আদায় করবেন। অত:পর নিম্নোক্ত হজ্বের নিয়্যত করবেন, আল্লাহুম্মা ইন্নী উরীদুল হাজ্জা ফায়াস সিরহু লী ওয়া তাকাব্বালহু মিন্নী। এর পর তিনবার তালবিয়া পড়বেন। তা নিম্নরূপ: লাব্বায়কা আল্লাহুম্মা লাব্বায়ক, লাব্বায়কা লা-শারীকালাকা লাব্বায়ক, ইন্নাল হাম্‌দা, ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলকা লা-শারীকা লাক।

তাওয়াফ ও মাসায়েল:

শরীয়তের পরিভাষায় বায়তুল্লাহ শরীফের চতুর্দিকে ৭ বার প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলা হয়। হাজরে আসওয়াদ হতে তাওয়াফ আরম্ভ করে পুনরায় হাজরে আসওয়াদে আগমন করাকে শওত বা চক্কর বলে। এভাবে সাত চক্কর পূর্ণ করলে এক তাওয়াফ পূর্ণ হবে। তাওয়াফ শেষ করে মকামে ইব্রাহীমকে সামনে রেখে দু’রাকাত নামায আদায় করবে। এর পর যমযমের নিকট এসে পানি পান করবেন। তাওয়াফের রুকন তিনটি। যথা:

১. তাওয়াফের অধিকাংশ চক্কর পূর্ণ করা,

২. তাওয়াফ বায়তুল্লাহ শরীফের বাইরে মসজিদুল হারামের ভিতরে করা,

৩. নিজের তাওয়াফ নিজে করা

তাওয়াফ সহীহ হওয়ার ছয়টি শর্ত:

১. মুসলমান হওয়া।

২. নিয়্যত করা।

৩. নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাওয়াফ করা।

৪. বায়তুল্লাহ শরীফের বাইরে তাওয়াফ করা।

৫. মসজিদুল হারামের ভিতরে তাওয়াফ করা ছাদের উপরে করলেও সহীহ হবে।

৬. হাজরে আসওয়াদ হতে তাওয়াফ আরম্ভ করা।

তাওয়াফের নিয়্যত:

আল্লাহুম্মা ইন্নী উরীদু তাওয়াফা বায়তিকাল হারাম, ফায়াস সিরহু লী ওয়া তাকাব্বালহু মিন্নি সাব’আতা আশওয়াতিন লিল্লাহি তা’আলা আযযা ওয়াজাল্লা।

তাওয়াফকালে যখন হাজরে আসওয়াদের সামনে আসবেন কাউকে কষ্ট দেয়া ব্যতিরেকে সম্ভব হলে চুম্বন করুন। বেশী ভীড় থাকলে ইস্তিলাম করুন, হাতের ইশরায় চুম্বন করুন। অর্থাৎ যদি হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত হাত পৌঁছানো যায় তাতে হাত লাগিয়ে হাতে চুম্বন করুন। তাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে কোন কাঠ বা লাঠি দিয়ে স্পর্শ করবেন এবং ঐ কাঠ বা লাটিকে চুম্বন করুন। কাঠ বা লাঠি দ্বারা স্পর্শ করাও সম্ভব না হলে দূর থেকে মা’তাফের রেখার উপর দাঁড়িয়ে হাজরে আসওয়াদের দিকে ফিরবেন এবং উভয় হাত হাজরে আসওয়াদের দিকে দেখাবেন এবং আল্লাহ আকবার ও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল হামদু লিল্লাহ বলবেন, আর দরূদ শরীফ পড়বেন।

মুলতাযাম:

হাজরে আসওয়াদ এবং খানায়ে কাবার দরজার চৌকাঠের মধ্যবর্তী স্থানকে মক্বামে মুলতাযাম বলে। এই জায়গাটি দু’আ কবূল হওয়ার স্থান। এখন মক্বামে মুলতাযামের কাছে দাঁড়িয়ে নিম্নের দু’আটি পড়ুন এবং বায়তুল্লাহ শরীফের দরজার চৌকাঠে হাত লাগিয়ে বিগত জীবনের সকল প্রকার গুনাহর জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং বায়তুল্লাহ শরীফের উসিলা নিয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তাওয়াফ শেষ করে মক্বামে ইব্রাহীমের আশে পাশে দুই রাকাত ওয়াজিবুত তাওয়াফ নামায আদায় করুন।

যমযম:  যমযম কূপের অভ্যন্তরে বায়তুল্লাহ শরীফকে সামনে রেখে দাঁড়িয়ে তিন নিঃশ্বাসে তৃপ্তি সহকারে এর পবিত্র পানি পান করুন এবং মাথায় , চোখে, মুখে ও বুকে মালিশ করুন। মহিলারা যমযম কূপের পৃথক সিঁড়িতে প্রবেশ করবেন। পানি পান করার সময় নিম্নের দু’আটি পড়বেন, “বিসমিল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়াচ্ছালাতু ওয়াচ্ছালামু আ’লা রাসূলিল্লাহ”। সাথে সাথে এই দু’আটিও পড়ুন, “আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকা ইলমান না-ফিআন, ওয়া রিযক্বান ওয়া-চি’আন, ওয়া শিফা-আম মিন কুল্লি দা-ইন ওয়াচাক্বামিন।”

হে আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে কাবা শরীফে মর্যাদা সুরক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাওফিক নসীব করুন। নিশ্চয়ই তুমি মহান দানশীল, সৃষ্টিজগতের মালিক, পূন্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু, হারামাঈন শরীফাইনের যিয়ারত আমাদেরকে নসীব করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।