জুমার-খুৎবা

মহামারীর কারণ প্রসঙ্গে নবীজির ভবিষ্যদ্বাণী

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

জুমার খুতবা

২০ জিলক্বদ|১৪৪২ হিজরি|শুক্রবার|২ জুলাই’২১ইং

মহামারীর কারণ প্রসঙ্গে নবীজির ভবিষ্যদ্বাণী

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন। তাঁরই কর্তৃত্ব ও রাজত্ব সমগ্র আসমান জমিনে প্রতিষ্ঠিত, তাঁর দয়া অনুগ্রহ ছাড়া সমগ্র সৃষ্টি অসহায়, বৈশ্বিক করোনা মহামারীতে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহানত্ব বারে বারে প্রমানিত। গোটা বিশ্ব আজ এক অদৃশ্য ভাইরাসে আতঙ্কগ্রস্ত, তাঁর রহমত ও অনুকম্পা ছাড়া কোথাও কারো জীবন মুহূর্তের জন্যও নিরাপদ নয়। তিনিই সমগ্র সৃষ্টিকুলের মহাক্ষমতাধর সত্তা।

মহামারীর কারণ প্রসঙ্গে নবীজির ভবিষ্যদ্বাণী:

গোটা বিশ্ব আজ কারোনা মাহামারীতে আক্রান্ত। পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো আজ অসহায় বিপর্যস্ত। সকল তথ্য প্রযুক্তি ও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োগ করা সত্বেও করোনা মহামারীর সংক্রমণ ও বিস্তার ঠেকাতে তারা আজ ব্যর্থ। এ ক্রান্তিকাল উত্তরণ কুরআন সুন্নাহর যথার্থ অনুসরণের বিকল্প নেই। প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, (নিম্ন বর্ণিত কারনে মহামারীর বিস্তার ঘটে)

১. যে জাতির মাঝে ব্যভিচার প্রকশ্যে বিস্তার ঘটে, আল্লাহ তাদের মাঝে মহামারী বিস্তার ঘটান। এমন মরণব্যাধি মহামারী তাদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হয় যা তাদের পূর্ববর্তীদের মাঝে ছিল না।

২. যখন তারা (লেনদেন ক্রয় বিক্রয়ে) ওজনে পরিমাপে কম দিবে তখন তাদের মাঝে দুর্ভিক্ষ, অভাব, অনটন গ্রাস করবে ও তাদের উপর অত্যাচারী শাসক চেপে বসবে।

৩. যখন তারা নিজেদের সম্পদের যাকাত দানে বিরত থাকবে আসমান থেকে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে যাবে। পৃথিবীতে যদি জীব-জন্তু,পশু-পাখি না থাকত, কখনো বৃষ্টিপাত হত না।

৪. তারা যখন আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে তখন তাদের শক্রদেরকে তাদের উপর চাপিয়ে দিবেন, তখন শক্রজাতি তাদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নিবে। (যেমন আজকের মুসলিম উম্মাহ বহুধা বিভক্ত, পারস্পরিক অনৈক্য, কুরআন সুন্নাহর বিরুদ্ধাচারণ ও সীমালংঘনের কারণে বিশ্বের দুইশত কোটি মুসলমান আজ বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত নিপীড়িত, পক্ষান্তরে খোদাদ্রোহী কাফির মুশরিক অত্যাচারী জালিম শাসকরাই আজ দোর্দণ্ড প্রতাপে প্রতিষ্ঠিত)।

৫. আর যখন তাদের শাসক শ্রেণি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবে না এবং আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত বিধান গ্রহণ করবে না, তখন তিনি তাদের মাঝে যুদ্ধ ব*াধিয়ে দিবেন। (সুনানে ইবনে মাযাহ, হাদীস ন ৪০১৯, মুসনাদে বাযযার, হাদীস নং ৬১৭৫, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং ৩০৪২)

বর্তমান বিশ্বের সার্বিক চিত্র অবলোকন করলে আমরা প্রিয়নবী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বর্ণিত হাদীসে ঘোষিত ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে এর বাস্তবতা ও সত্যতার প্রমাণ দেখতে পাচ্ছি।

বিপদ আপদ মানুষেরই কর্মফল:

মহান আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা, জান্নাত ও জাহান্নামের সৃষ্টিকর্তা, ভাল মন্দ দুটি তিনিই সৃষ্টি করেছেন। মানুষ তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বিদা মতে মহান আল্লাহ সকল প্রকার কর্মের স্রষ্টা, বান্দা কর্মের অর্জনকারী, বান্দা জন্মগতভাবে স্বাধীন। ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ, ঈমান, কুফর ইত্যাদি যে কোনটি গ্রহণ, বর্জনের এখতিয়ার বা স্বাধীনতা বান্দাকে দেওয়া হয়েছে। তবে এটাও মহান আল্লাহ কর্তৃক ঘোষিত, বান্দা চিরস্থায়ী সুখময় জান্নাত লাভের জন্য একমাত্র সত্যকে গ্রহণ করবে, ন্যায়ের পথে চলবে, অন্যায় পরিহার করবে।

তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের উপর ঈমান আনবে। পক্ষান্তরে কুফর, শির্ক, খোদাদ্রোহিতা , নবীদ্রোহিতা, পৌত্তলিকতা, অবিচার, পাপাচার, কামাচার, ব্যভিচার, নগ্নতা, অশ্লীলতা, বেহেয়াপনা, ইসলাম বিরোধী সকল প্রকার অনৈতিক কার্যকলাপ পরিহার করবে তখনই মানব জীবনে আসবে সাফল্য শান্তি ও পরকালীন মুক্তি। আজকের বৈশ্বিক করোনা মহামারী নি:সন্দেহে বিশ্ববাসীর জন্য এক মহা বিপদ। এ সংকট মানুষেরই কর্মের কুফল। মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তোমাদেরকে যে আপদ বিপদ গ্রাস করেছে তা তোমাদের কর্র্মফল আর তিনি তোমাদের অনেক কিছুই ক্ষমা করেন।” (সূরা: আশ শূরা, আয়াত: ৩০)

আল্লাহই একমাত্র মুক্তিদাতা:

অদৃশ্যের সংবাদদাতা নবী, বিশ্ব মানবতার নবী, রাহমতুল্লীল আলামীন এর পবিত্র জীবনাদর্শ অনুসরণে রয়েছে বিশ্ব মানবমন্ডলীর চিরস্থায়ী শান্তি মুক্তি ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি। পক্ষান্তরে প্রিয় রসূলের বিরোধীতা অবাধ্যতায় রয়েছে দু:খ দুর্দশা অসম্মান অপমান লাঞ্ছনা ও দুনিয়া আখিরাতে সমূহ বিপদ। জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রযুক্তিতে উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোও আজ সম্পূর্ণরূপে অসহায়। পৃৃৃৃৃথিবীর খ্যাতিমান চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফসল করোণা মহামারী প্রতিরোধে টিকা আবিষ্কার করা হলেও এর দ্বারা সুস্থতা অর্জন করা নিশ্চিত একথা বলা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এমনকি এ ধ্বংসাত্মক মহামারী কখন পৃৃথিবী থেকে বিদায় নেবে সেটাও কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়। একমাত্র মহীয়ান স্রষ্টা যিনি মহামারী আযাব দিয়েছেন তিনিই পারেন এ ভাইরাস উঠিয়ে নিতে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “যে কোন বিপদ-আপদ একমাত্র আল্লাহর অনুমতি নিয়েই গ্রাস করে।” (সূরা: তাগাবুন, আয়াত: ১১)

নিজেকে সুস্থ রাখুন, অন্যকেও সুস্থ রাখুন:

করোনা মহামারী থেকে মুক্তির লক্ষ্যে একমাত্র আল্লাহর পথেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। বিশ্বব্যাপী এ মহামারির সংক্রমণ রোধে গৃহীত পদক্ষেপ গুলো বিজ্ঞান সম্মত এগুলো কোনটি কুরআন সুন্নাহ বিরোধী নয়। প্রতিটি ব্যবস্থাপনা ও উদ্যোগের পক্ষে ইসলামের সমর্থন রয়েছে। কারো মাঝে জীবানুর উপসর্র্গ ধরা পড়লে তাকে আলাদা করে চিকিৎসা করার নামই আইসোলেশন। এ ভাবে একজনের কাছ থেকে আরেক জনকে আলাদা করে রাখা যেন সুস্থ ব্যক্তিদের দেহে ভাইরাস সংক্রমিত না হয়। চিকিৎসকের ভাষায় এটাই কোয়ারান্টাইন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “অসুস্থ ব্যক্তিকে যেন সুস্থ ব্যক্তির কাছে প্রবেশ করানো না হয়।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৫, ইবনে মাযাহ, হাদীস নং ৩৫৪১, মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৯৬১২)

জেনে শুনে নিজকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করা মহাপাপ:

ইসলাম আমাদেরকে সুস্থভাবে নিরাপদে বেঁচে থাকার উপর গুরুত্বারোপ করেছে। স্বাস্থ্য বিধি না মেনে নিজের ক্ষতি করা, অন্যজনের ক্ষতির কারণ হওয়া সমান অপরাধ। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তোমরা তোমাদের হস্ত সমূহকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবেনা।” (সূরা: আল বাক্বারা, আয়াত: ১৯৫)

ব্যভিচার ও অশ্লীলতার ব্যাপকতা মহামারীর মূল কারণঃ

মানব জাতির নৈতিক চরিত্র আজ চরমভাবে অধ:পতিত। সমাজ ব্যবস্থায় ইসলামী তাহজীব তমুদ্দুন নীতি নৈতিকতা আজ বিলুপ্তির পথে। পশ্চিমা সভ্যতা ও অপসংস্কৃতির সয়লাভে আদর্শ ও সুস্থ সাংস্কৃতিক জীবন আজ অনেকাংশে নির্বাসিত। তথ্য প্রযূক্তির অপব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণহীনতার সুবাদে মোবাইল, ইন্টারনেট, ইউটিউব, ইলেকট্রেনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াগুলো প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে শিশু কিশোর ও যুবক যুবতীদের চরিত্র ধ্বংশের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। অধিকাংশ মুসলিম পরিবারগুলোতে নিয়মিত নামায, কুরআন তিলাওয়াত, ইসলামী আদব আখলাক, শিষ্টাচারিতা ইত্যাদি আদর্শ সংস্কৃতি বিলুপ্তির পথে। মুসলিম সমাজে সকাল বেলায় ইসলামী শিক্ষার প্রাচীনতম প্রাতিষ্ঠানিক ঐতিহ্য মক্তব এর অস্তিত্ব প্রায় শূন্যের কোটায়। অশ্লীলতা, নগ্নতা, বেহেয়াপনা, শটতা, কপটতা, মিথ্যাচার, সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ধর্র্ষণ, লুণ্ঠন, খুন-খারাবি, সন্ত্রাস, রক্তপাত, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ইত্যাদি গর্র্হিত অপকর্মগুলো আজ সমাজের প্রতিটি সেক্টরে প্রতিষ্ঠিত। এতো অগনিত অপরাধ ডানে বামে সামনে পিছনে দিবা রাত্রি অপরাধের রাজত্বে আমাদের বসবাস। কারো অপরাধ জগতে নির্বিঘ্নে বসবাস, কেউ নীরব দর্শকের ভূমিকায়, কেউ অপরাধ জগতের মহা সম্রাট অভিধায় ভূষিত। একটি আদর্শ সুন্দর ও কল্যাণকামী সমাজ বিনির্মাণের ভূমিকায় যাদের অগ্রণী ভূমিকা ও গুরুদায়িত্ব পালন করা অপরিহার্য ছিল তাঁরা আজ নীরব, নির্র্বিকার অনেকটা উদাসীন।

ফলশ্রুতিতে আল্লাহর ক্রোধ গজব ও আযাব করোনা মহামারীরূপে বিশ্বব্যাপী চেপে বসেছে। এ মহামারীতে যে ভাবে অবাধ্য কাফির মুশরিকরা আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে আবার অনেক নেককার মুত্তাকী দ্বীনদার আল্লাহর প্রিয় বান্দারাও বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। মহামারীতে মু’মীন ও কাফিরদের মৃৃত্যু এক নয়, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “মহামারীতে আমার উম্মতের মৃত্যু শাহাদাত ও রহমত। কাফিরদের জন্য এ মৃত্যু শাস্তি স্বরূপ।” ( মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ২০৭৬৭)

আল্লাহর দয়া, অনুগ্রহ, বিপদে ধৈর্য ধারনই মুক্তির উপায়:

আমরা আল্লাহর বান্দা, তিনিই একমাত্র সাহায্যকারী মুক্তিদাতা, তাঁর দয়া, অনুগ্রহ ও সাহায্য ছাড়া রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় নাই। তাঁরই নিকট অপরাধের ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “হে মু’মীনগণ, তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।” (সূরা: বাক্বারা, আয়াত: ১৫৩)

হে আল্লাহ আমাদেরকে আপনার ধৈর্যশীল মকবুল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। বৈশ্বিক করোনা মহামারী থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন। নিশ্চয় আপনি সমগ্র সৃষ্টি জগতের মালিক, পুণ্যময়, অনুগ্রহশীল ও দয়ালু। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম।
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।close