জুমার-খুৎবা

জুমার খুতবা | বিসমিল্লাহ শরীফের ফযীলত ও বরকত

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

জুমার খুতবা

২৬ জিলহজ|১৪৪২ হিজরি|শুক্রবার|৬ আগস্ট’২১

“বিসমিল্লাহ শরীফের ফযীলত ও বরকত”

পবিত্র কুরআনের আলোকে বিসমিল্লাহ শরীফ:

আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” আরবিতে একে “তাসমিয়া” অর্থাৎ নাম বাক্য বলে। আল্লাহ তা’আলার গুণবাচক দুটি নাম রহমান ও রহীম তাসমিয়া যোগে পঠিত হয়। “বিসমিল্লাহ” এটি কুরআনের একটি পূর্ণ আয়াত। পবিত্র কুরআনের সূরা তাওবা ব্যতীত অন্যান্য সকল সূরা বিসমিল্লাহ দ্বারা আরম্ভ করতে হবে। কলেমা শরীফ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ” (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পাঠ করা যে ভাবে উত্তম যিকর তেমনি “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” পাঠ করাও আল্লাহর মকবুল ও উত্তম যিকর। (আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড: ৩য়, পৃ: ১৩২)

প্রতিটি কাজ বিসমিল্লাহ শরীফ দ্বারা শুরু করার গুরুত্ব:

সরকারে দোআলম হুজুর পূরনুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “প্রত্যেক প্রকার ভাল কাজ যেটা বিসমিল্লাহ ব্যতীত শুরু করা হয় সেটা অসম্পূূর্ণ থেকে যায়। (মুতালিউল মুসিররাত, কানযুল উম্মাল, খন্ড: ১ম, পৃ:২৭৭, আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড: ২য়, পৃ: ১৩২)

প্রত্যেক ভালো ও বৈধ কাজ বিসমিল্লাহ শরীফ দ্বারা শুরু করা মুস্তাহাব। কিন্তু অবৈধ ও হারাম কাজ বিসমিল্লাহ শরীফ দ্বারা শুরু করা নিষেধ। মদ পানের সময়, যিনা, ব্যভীচার করার সময়, জুয়া খেলা ও চুরি-ডাকাতির সময় বিসমিল্লাহ পাঠ করা কুফরী। (ফাতওয়ায়ে আলমগীরি)

খাবারের সময় বিসমিল্লাহ পাঠ করার বরকত:

প্রতিটি ভালো কাজে বিসমিল্লাহ পাঠে বরকত ও রহমত রয়েছে। বিসমিল্লাহ পাঠ ব্যতীত কাজ বরকত শূন্য হয়। যে খাবারের সময় বিসমিল্লাহ পড়া হয় এতে শয়তান অংশ নিতে পারেনা। বিসমিল্লাহর বরকতে খাবার সমূহ নূর হয়ে পেটে প্রবেশ করে। বিসমিল্লাহ পাঠ ব্যতীত খাবার খাওয়ার পরও ক্ষুধা অবশিষ্ট থেকে যায়। (আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড: ২য়, পৃ: ১৩২)

বিসমিল্লাহ পড়ে সকলে মিলে খাবারে বরকত:

এক সাহাবী নবীজির দরবারে আরজ করলেন “ইয়া রাসূলাল্লাহ” সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাবারের পরও আমার ক্ষিধা অবশিষ্ট থেকে যায়, পরিতৃপ্ত হয়না। নবীজি এরশাদ করেন, সম্ভবত তুমি একা খেয়ে থাকো, সাহাবী জবাব দিলেন, জি, হ্যাঁ, আমি একা আহার করে থাকি। নূর নবীজি এরশাদ করেন, সকলে একসাথে খাবার খাও, খাবারে বিসমিল্লাহ পাঠ করো, তোমাদের খাবারে বরকত হয়ে যাবে। (সুনানে ইবনে মাযাহ, পৃ: ২৩৬, কানযুল উম্মাল, খন্ড: ১৫, পৃ: ১০৩)

প্রত্যেক মুসলমান নিজ স্ত্রীর নিকট বিশেষ মুহূর্তে গমনের পূর্বে বিসমিল্লাহ শরীফ পাঠ করলে শয়তান থেকে পবিত্র থাকবে। যে সন্তান জন্ম নিবে সেটা নেককার ও পুণ্যবান হবে। (আবু দাউদ শরীফ, খন্ড:১ম, পৃ: ২৯৩)

বাহনে আরোহণের সময় বিসমিল্লাহ পড়া:

হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন তোমরা বাহনে আরোহণ করবে “বিসমিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ” পাঠ করবে এতে প্রতি কদমে নেকী প্রাপ্ত হবে। (মাওয়াহিবে লুদুনীয়া)

বাহন যোগে যাতায়াত ও ভ্রমণের সময় বিসমিল্লাহ পাঠ করলে বিভিন্ন বিপদাপদ ও দুর্ঘটনা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

হযরত নূহ(আ:) নৌযানে আরোহণের সময় বিসমিল্লাহ পাঠ:

বিসমিল্লাহ শরীফ পাঠ করা নবীদের সুন্নাত। হযরত নূহ আলাইহিস সালাম জাহাযে আরোহণের সময় দুআ পাঠ করেছিলেন “বিসমিল্লাহি মাজরীহা ওয়া মুরসাহা ইন্না রাব্বী লাগফুরুর রাহীম” বিসমিল্লাহর বরকতে আল্লাহ তাআলা মহাপ্লাবন থেকে নৌযান রক্ষা করেছেন। যে ব্যক্তি সামুদ্রিক জাহাজে আরোহণের সময় এ দুআ পাঠ করবে আল্লাহ তাকে সমুদ্রে ডুবে যাওয়া ও বিপদ থেকে বাঁচাবে। [তাফসীরে নঈমী, খন্ড:১ম, কৃত: হাকীমূল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী (র.)]

বিষপানে প্রতিক্রিয়া হলো না:

সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সত্যতা প্রমাণের জন্য প্রিয় রাসূলের সাহাবী হযরত খালিদ ইবন ওয়ালিদ রাদ্বিয়াল্লাহু এর নিকট কোন এক ব্যক্তি শর্ত আরোপ করল আপনি যদি এই বিষ পান করে সুস্থ থাকতে পারেন আমি ইসলামের সত্যতা স্বীকার করে কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে যাব। হযরত খালিদ ইবন ওয়ালিদ (রা.) বিসমিল্লাহ শরীফ পড়ে লোকটির কথা মতে বিষ পান করার পরও কোন প্রতিক্রিয়া হলোনা। সম্পূর্ণরূপে সুস্থ ছিলেন। হযরত খালিদ ইবন ওয়ালিদের এ কারামত দেখে লোকটি ইসলাম কবুল করলেন। [তাফসীরে নঈমী, খন্ড: ১ম, কৃত: হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী (র.)]

বাদশাহ হিরাক্লিয়াসের মাথা ব্যথা, দুরীভূত হলো:

পবিত্র কুরআন সকল রোগের মহৌষধ, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “এবং আমি কোরআনের মধ্যে অবতীর্ণ করি ঐ বস্তু যা ঈমানদারদের জন্য আরোগ্য ও রহমত। (সূরা: বনী ইস্রাইল, আয়াত: ৮২)

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মু’মেনীন হযরত ওমর ইবন খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর নিকট একদা রোম সাম্রাজ্যের বাদশাহ হিরাক্লিয়াস পত্র লিখলেন। আমিরুল মুমেনীন! আমি প্রচন্ড মাথা ব্যথায় ভুগছি। আপনি আমার একটু চিকিৎসা করুন। খলিফাতুল মুসলেমীন বাদশাহর কাছে একটি টুপি প্রেরণ করলেন, বাদশাহ যখন এ টুপি মাথায় পরিধান করতেন ব্যথা চলে যেতো। মাথার টুপি যখন নামিয়ে ফেলতেন পুনরায় মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যেতো। বাদশাহ আশ্চর্য হলেন এ কি রহস্য নিহিত? এক পর্যায়ে টুপি খুলে দেখলেন টুপির ভেতরে এক টুকরো কাগজে পবিত্র কুরআনের আয়াত “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” লিখা ছিলো। বিসমিল্লাহ শরীফের বরকতে মাথা ব্যথা দূরীভূত হলো। সাহাবায়ে কেরামের কুরআনী চিকিৎসা ইসলামের এক বিস্ময়কর আধ্যাত্মিক শক্তির গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। [তাফসীরে নাঈমী, ১ম খন্ড, কৃত: হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.)]

ইন্তেকালের পূর্বে এক ব্যক্তির ওসীয়ত:

ইন্তেকালের পূর্বে এক ব্যক্তি ওসীয়ত করে গেল যখন আমার ইন্তেকাল হয়ে যাবে তখন আমার সীনা ও কপালে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” লিখে দিবে। এ ভাবে করা হলো, অত:পর কোন ব্যক্তি ঐ সৌভাগ্যবান ব্যক্তিকে স্বপ্নে দেখে তাঁর অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে মৃত ব্যক্তি জবাব দিলো যখন আমাকে কবরে রাখা হলো ফিরিস্তার আগমন হলো, যখন কপালে “বিসমিল্লাহ শরীফ” লিখা দেখলেন, ফিরিস্তারা বললো, তুমি আযাব থেকে রক্ষা পেয়েছো। (দুররে মুখতার, জানাযা শীর্ষক অধ্যায়, খন্ড: ৩য়, পৃ: ১৮৫)

হযরত আল্লামা শামী (র.) প্রণীত প্রসিদ্ধ ফিকহ গ্রন্থ রদ্দুল মুখতার এ উল্লেখ করেন, মৃত ব্যক্তির গোসলের পর কাফন পরিধানের পূর্বে তাঁর কপালে “বিসমিল্লাহির রাহিমানির রাহীম” লিখবে। এবং সীনার উপর কলেমা শরীফ “লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ” সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আঙ্গুল দিয়ে লিখবে। কালি দিয়ে নয়। (রদ্দুল মুখতার, সালাতুল জানাযা অধ্যায়, খন্ড: ৩য়, পৃ: ১৮৬)

ঘরের বাইরের দরজার উপর বিসমিল্লাহ শরীফ লিখা:

হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু স্বীয় প্রণীত বিশ্ব বিখ্যাত তাফসীরে কবীরীতে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি ঘরের বাইরের দরজার উপর “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” লিখে রাখবে ঐ ঘর ধ্বংস থেকে রক্ষা পাবে। অর্থাৎ ঐ ঘরে অকল্যাণ ও অনিষ্ঠতা আসবেনা। (তাফসীরে কবীর, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ৩, পৃ: ১৩৮)

বিসমিল্লাহর বরকতে ওস্তাদ ও মাতা-পিতার ক্ষমা:

হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে বলে পড়ো, “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” তখন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষর্থীর পিতা-মাতার জন্য ক্ষমা লিপিবদ্ধ করা হয়। (দায়লামী, আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড: ৩, পৃ: ১৩৫)

হযরত সুলায়মান(আ:) কর্তৃক প্রেরিত চিঠিতে বিসমিল্লাহ শরীফ:

হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম রাণী বিলকিস এর নিকট লিখিত চিঠিতে প্রথমে লিখেছিলেন “ইন্নাহু মিন সুলায়মানা ওয়া ইন্নাহু বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” (সূরা: ২৭ আন নাম্‌ল, আয়াত: ৩০)

বিসমিল্লাহ’র “বা” অক্ষরের রহস্য:

আলমে আরওয়াহ তথা আত্মার জগতে আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টিকূলের উদ্দেশে বলেছিলেন, আমি কি তোমাদের প্রভূ নই। প্রত্যেকে জবাব দিলো “বালা” অর্থ্যাৎ হ্যাঁ মানুষের মুখ থেকে সর্ব প্রথম “বা” অক্ষর বের হয়েছিল। পরম করুণাময় আল্লাহ তা’আলাও তাঁর বাণী “বিসমিল্লাহ ” “বা” দিয়ে শুরু করেছেন। যেন কুরআনুল করীম তিলাওয়াতের শুরুতেই আল্লাহর সাথে কৃত বান্দার অঙ্গীকারের কথা স্মরণ হয়ে যায়। (তাফসীরে নাঈমী)

আল কুরআনের সংখ্যাতাত্ত্বিক রহস্য:

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” আয়াতে আরবি বর্ণমালার ১৯টি অক্ষর রয়েছে। গোটা কুরআনের সূরা সংখ্যা ১১৪ টি যা ১৯ দিয়ে বিভাজ্য। (১৯দ্ধ৬=১১৪), কুরআনে ইসম শব্দটি এসেছে ১৩৩ বার (১৯দ্ধ৭=১৩৩), আল্লাহ শব্দটি এসেছে ২৬৯৮ বার (১৯দ্ধ১৪২), রহমান শব্দটি এসেছে ৫৭ বার (১৯দ্ধ৩=৫৭), রাহীম শব্দটি এসেছে ১১৪ বার (১৯দ্ধ৬=১১৪) এ মৌলিকত্ব আল কুরআনের এক বিস্ময়কর মুজিযা। (আল কোরআন ও ছাহেবে কোরআন, পৃ:-১১)

আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে কুরআনুল করীমের জ্ঞানগর্ভ নসীহত দ্বারা উপকৃত করুন। নিশ্চয়ই তিনি মহান দানশীল, রাজাধিরাজ পুণ্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী),
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।close