আরবি মাসগুলোর মাঝে যিলহজ সম্মানিত একটি মাস। এই মাসের মধ্যেই রয়েছে ইসলামের ফরয রুকন হজ। এছাড়াও এই মাসের প্রথম দশকে রয়েছে ঈদুল আজহা, কোরবানি, তাকবীরে তাশরীকসহ প্রভৃতি আমল। বস্তুত এই মাসের ইবাদত-বন্দেগী আমল ও ফযিলত এই মাসকে গুরুত্ববহ করে তুলেছে। আজ আমরা এই মাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল তাকবীরে তাশরীক সম্পর্কে জানবো।

তাকবীরে তাশরীক:

তাকবীর শব্দটি আরবি। এটি বাবে তাফয়িল এর মাসদার। তাকবির অর্থ- শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা করা। অপরদিকে তাশরিক শব্দটিও বাবে তাফয়িলের মাসদার। অর্থ হলো- সূর্যের আলোতে গোশত শুকানো।

আরবরা তাদের কোরবানির মাংস ঈদের তিন দিন পর্যন্ত রোদে দিয়ে শুকাতো, এজন্য এ দিনগুলো আইয়ামে তাশরিক বা মাংস শুকানোর দিন বলা হয়।

ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, তাকবিরে তাশরিক হলো- নির্দিষ্ট দিনগুলোতে প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর পুরুষরা উচ্চস্বরে আর মহিলারা নিম্নস্বরে ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’- বাক্য বলা।

তাকবীরে তাশরীকের দো’আ:

الله أكبر الله أكبر لااله إلا الله والله أكبر الله أكبر ولله الحمد

তাকবীরে তাশরীকের ইতিহাস:

হযরত ইবরাহীম (আঃ) যখন তাঁর পুত্র নবী হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে কোরবানী করার জন্য মাটিতে শুয়ে তাঁর গলায় ছুড়ি চালাচ্ছিলেন, ঠিক এমনই মূহুর্তে আল্লাহ তা’য়ালা ফেরেশতা হযরত জিবরাইল (আঃ) কে নির্দেশ দিলেন, একটি জান্নাতী দুম্বা নিয়ে দ্রুত হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর কাছে পোঁছার জন্য৷ তখন হযরত জিবরাইল (আঃ) খুব দ্রুত আসছিলেন৷

কিন্তু দূর থেকেই দেখতে পেলেন হযরত ইবরাহীম (আঃ) তার পুত্রের গলায় ছুরি চালাচ্ছেন৷ তখন জিবরাইল আঃ আশংকা করলেন যে, তিনি পৌঁছার পূর্বেই বুঝি ইসমাইল (আঃ) জবাই হয়ে যাবেন৷ তাই তিনি ঘাবড়ে গিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলেনঃ
الله أكبر، الله أكبر

হযরত জিবরাইল (আঃ) এর তাকরীর পাঠ শুনে হযরত ইবরাহীম (আঃ) বলে উঠলেনঃ
لا إله إلاالله والله أكبر

আর হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর তাকবীর শুনে এবং দুম্বা জবাই হতে দেখে হযরত ইসমাঈল (আঃ) বলে উঠলেনঃ
الله اكبر ولله الحمد

এভাবে তিনজনের যিকিরকে একত্রিত করে হয়েছে তাকবীরে তাশরিক।

“الله أكبر الله أكبر لااله إلا الله والله أكبر الله أكبر ولله الحمد”

তাকবীরে তাশরীকের বিধান:

যিলহজ মাসের ৯’তারিখ ফজর থেকে ১৩’তারিখ আসর পর্যন্ত ৫’দিনে মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরয নামাযের পর একবার করে তাকবীরে তাশরীক পাঠ করাটা ওয়াজিব৷

অর্থাৎ প্রত্যেক বালিগ পুরুষ-মহিলা, মুকিম-মুসাফির, গ্রামবাসী-শহরবাসী, জামাতে নামায আদায়কারী কিংবা একাকী নামায আদায়কারী প্রত্যেকের উপর একবার করে তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা ওয়াজিব৷

আর ওয়াজিব ছেড়ে দেওয়া কবীরা গুনাহ৷ তাই আইয়ামে তাশরীকের দিনসমূহে প্রতি ফরয নামাযের পর ইচ্ছাকৃতভাবে তাকবীরে তাশরীক পাঠ না করা কবীরা গুনাহ৷ (ফতোয়ায়ে আলমগীরী)

তাকবীর সম্পর্কিত কিছু মাস’আলা:

মাস’আলা- ১: আইয়ামে তাশরীকের দিন সমূহে অর্থাৎ ৯ই যিলহজ এর ফজর থেকে ১৩ই যিলহজের আছর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর পুরুষগণের উপর উচ্চস্বরে একবার তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব, মতান্তরে সুন্নত এবং মহিলাগণ আস্তে বলবে যাতে নিজে
শুনে। (শামী ও তাহতাবী)

মাস’আলা- ২: তাকবীরে তাশরীক একবারের অধিক বলবে না কারণ একের অধিক বলার উল্লেখ নাই।(তাহতাবী)

মাস’আলা- ৩: যদি ইমাম সাহেব সালামের পর তাকবীর বলাকে ভুলে ছেড়ে দেয় তাহলে মুক্তাদীগণের উপর সঙ্গে সঙ্গে উচ্চস্বরে তাকবীর পড়া ওয়াজিব। (শামী)

মাস’আলা- ৪: ফরজ নামাজ চাই জামা’আতের সাথে পড়া হোক অথবা পৃথক একাকী, ওয়াক্তের মধ্যে পড়া হোক অথবা নামাজ কাজা হোক, চাই নামাজী স্থানীয় লােক হোক অথবা মুসাফির, শহরের বাসিন্দা হোক অথবা গ্রামের লােক, পুরুষ, মহিলা সকলের উপর নামাজ শেষে তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজীব। (শামী)

মাস’আলা- ৫: মাসবুকের উপর (অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইমামের সাথে সম্পূর্ণ নামাজ পায় না তার উপর) বাকি নামাজ আদায় করার পর তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা ওয়াজিব। লাহেকের মত অর্থাৎ যে ইমামের সহিত সম্পূর্ণ নামাজ পেয়েছে। (শামী)

মাস’আলা- ৬: নফল, বিতর ও জানাজার নামাজের পর তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব নয়। ঈদের নামাজের পর তাকবীর পাঠ করার ব্যাপারে ফকিহগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। (রদ্দুল মুখতার)

মাস’আলা- ৭: যদি ফরজ নামাজ আদায় করার পর কোন ব্যক্তি বিপরীত (যেমন মসজিদ হতে বাহির হয়ে যাওয়া, ইচ্ছায় অথবা ভুলে বলা অথবা ইচ্ছা করে অজু ভঙ্গ করা) তাহলে তার তাকবীর আদায় হয়ে যাবে।(শামী)

মাস’আলা- ৮: যদি কোন পুরুষ তাকবীরে তাশরীক উচ্চস্বরে না পড়ে আস্তে আস্তে পড়ে তাহলে ওয়াজিব আদায় হবে না। (তাহতাবী)

মাস’আলা- ৯: তাকবীরে তাশরীক একবার বলা ওয়াজিব, তবে যদি (কেউ) একাধিকবার বলে, তাহলে তা ফযীলতের কারণ হবে। (দুররুল মুখতার)