প্রবন্ধ

বাংলা সাহিত্যে রমজান

লেখকঃ এম সাইফুল ইসলাম নেজামী

কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ্ব ও যাকাত; এ পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলামের ভিত্তি। অন্যতম হচ্ছে রমজান মাসের রোজা। রমজান ও রোজাকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ এক পরিমণ্ডল সৃষ্টি হলেও; বাংলা সাহিত্যে ঋতুভিত্তিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস যেভাবে রচিত হয়েছে সেভাবে ‘রমজান ও সিয়ামথর মাহাত্ম্য নিয়ে পর্যাপ্ত সাহিত্য চর্চা হয়নি।

তারপরও আশার বাণী হলো, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ, পল্লী কবি জসিম উদ্দিনসহ মুসলিম সাহিত্যিকগণ রমজান ও রোজা বিষয়ক বেশ কিছু উৎকৃষ্টমানের কাব্য কর্ম ও গদ্য সৃষ্টি করেছেন। সাহিত্য ভাবনায় যাওয়ার আগে রোজার ব্যাপারে জ্ঞানের মূলমত্র মহাগ্রন্থ কোরআন কী বলে জেনে নিই। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হতে পারো, পরহেজগার হতে পারো। এ আয়াত থেকে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি, রোজার বিধান দেওয়া হয়েছে তাকওয়া অর্জনের জন্য, গুনাহ বর্জন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে জান্নাতের উপযোগী হয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য।

 

রোজাদারদের পুরস্কারের ব্যাপারে অদৃশ্য জ্ঞানের ধারক প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (দ.) ইরশাদ করেন- জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে একটি দরজার নাম রাইয়ান। এ দরজা দিয়ে শুধু রোজাদারগণ প্রবেশ করবে। অন্যরাও এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে চাইবে। কিন্তু রোজাদার ব্যতীত অন্য কাউকে এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। (বুখারী ও মুসলিম)। কোরআন হাদিসের ভাষ্যের পর এবার আমাদের দৃষ্টি সাহিত্যের পাতায়। শুরু করা যাক জাতীয় কবির কাব্য কর্ম দিয়ে।

 

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সুবিশাল কাব্য কর্মে রমজান ও রোজার প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। নজরুল ‘কেন জাগাইলি তোরাথ কবিতায় মাহে রমজানকে রিপ্রেজেন্ট করেছেন এক বিপ্লবী অনুরণন মেখে- মাহে রমজান এসেছে যখন আসিবে শবে কদর, নামিবে রহমত এই ধূলির ধরার পর। এই উপবাসী আত্মা, এই যে উপবাসী জনগণ, চিরকাল রোযা রাখিবে না-আসে শুভ এফতার ক্ষণ। কবি শাহাদাৎ হোসেন রহমতের বারিধারা মাহে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে রমজান কবিতায় লিখেছেন- তোমারে সালাম করি নিখিলের হে চির কল্যাণ, জান্নাতের পুণ্য অবদান! যুগ-যুগান্তর ধরি বর্ষে আসিয়াছ চুমিথ ধরনীর বনান্ত বেলায়। অস্তসিন্ধুকূলে দূর প্রতীচীর নীলিমার গায় দ্বিতীয়ার পুণ্য তিথি প্রতি বর্ষে আঁকিয়াছে তোমার আভাস, দিক হতে দিগন্তরে জাগিয়াছে পুলকের গোপন উচ্ছ্বাস। দিক হতে দিগন্তরে ধরণীর মর্মকেন্দ্র ঘন মুখরিয়া, স্বাগতম রমজান গীতি কণ্ঠে উঠুক রণিয়া। অনাবিল শান্তির ফোয়ারা নিয়ে রমজান উপস্থিত কিন্তু জাতীয় অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের সৃষ্ট কর্ম থাকবে না; এটা অসম্ভব।

 

‘সিয়ামের তাৎপর্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে রোজার তাৎপর্য তুলে ধরে তিনি লিখেছেন- ‘কাম প্রবৃত্তির অসংযত সন্তোষ বিধানের ফলে মানুষ পশুত্বের চরম স্তরে নেমে যায়। ক্রোধ মানুষকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে তোলে। লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য সামাজিক জীবনে বিশৃংখলতার সৃষ্টি করে। এ জন্যে এগুলোর দাহনের জন্যে এ দুনিয়ায় আল্লাহ সিয়ামের প্রবর্তন করেছেন। যাতে এ দাহনের ফলে মানুষ এ বিশ্বে তার প্রকৃত স্থান নির্দিষ্ট করতে পারে, সে যাতে আল্লাহর প্রতিনিধি বা ঠরপব-মবৎবহঃ হিসেবে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে। রমজান সম্পর্কে এনে দেয় এক নতুন মাত্রা। রমজানের প্রধান দু’টি দিক, সিয়াম আর কিয়াম। কিয়াম তথা নামাজ। আরেকটু পরিস্কার করে বললে, রাতে ২০ রাকাত তারাবির নামাজ। তারাবির নামাজ রমজানের মূল অনুসঙ্গ। এ নামাজ মুমিনপ্রাণ রাঙিয়ে দেয় ঈমানের রঙে- তারই হৃদয় ছোঁয়া বর্ণনা দেখি আমরা পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের তারাবি কবিতার ছত্রে ছত্রে- ‘নামাজ পড়িতে যাইব মোল্লাবাড়িতে আজ, মেনাজদ্দীন, কলিমদ্দীন, আয় তোরা করি সাজ। চালের বাতায় গোঁজা ছিল সেই পুরাতন জুতা জোড়া, ধুলাবালু আর রোদ লেগে তাহা হইয়াছে পাঁচ মোড়া। তাহারি মধ্যে অবাধ্য এই চরণ দুখানি ঠেলে, চল দেখি ভাই খলিলদ্দীন, লুন্ঠন-বাতি জ্বেলে। ঢৈলারে ডাক, লস্কর কোথা, কিনুরে খবর দাও। মোল্লাবাড়িতে একত্র হব মিলি আজ সার গাঁও।থ পবিত্র মাস রমজানে রয়েছে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রজনী মহিমান্বিত লাইলাতুল কদর। এ রাতের মহিমাও উঠে এসেছে কাব্যের মেলায়। কবির কলমে।

 

ইসলামী ঐতিহ্যের কবি ফররুখ আহমদ ‘শবে-কদর’ শিরোনামে কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতায়- এখনো সে পুণ্য রাত্রি নামে পৃথিবীতে, কিন্তু প্রাণ এক অন্ধকার ছেড়ে অন্য এক আঁধারে হারায়, ঊর্ধ্বের ইঙ্গিত আসে লক্ষ মুখে, অজস্র ধারায়; নর্দমার কীট শুধু পাপ-পঙ্কে খোঁজে পরিত্রাণ। আত্মার প্রশান্তি গ্রাস করে ছায়া উ™£ান্ত মতের; সে আজ দেখাতে রাহা এ সংশয়ে, শবে কদরের কত অপলক দৃষ্টি জাগে আজও যে পথ-সন্ধানে; জুলমাতের এলাকায় বলে দাও নিঃসঙ্গ খিজির। সৈয়দ এমদাদ আলী কলমেও উঠেছে লাইলাতুল কদরের মহিমা। ‘বর্ষে বর্ষে আসে সে রজনী, ল’য়ে তার স্মৃতির সম্ভার, বহাইতে মোসলেম অন্তরে, অনাবিল পুণ্যের পাথার। কবি ফজল-এ-খোদা রমজানকে খোশ আমদেদ জানিয়েছেন ঠিক এভাবে- হে রমজান হে রমজান! দাও স্বস্তি দাও শাস্তি, ধরণীতে করো মনোরম, তোমারে হেরিয়া বিশ্ব বিবেক সংযম হোক দুর্দম। অন্য এক কবিতায় লিখেছেন- ‘আল্লাহ তোমার হাজার শোকর, দিলে মাহে রমজান- অধম নাদান বান্দার তরে, তুমি যে মেহেরবান। রমজানের এই রহমতী মাস, মিটায় প্রাণের বেহেশতী আশ, খোদা আমরা তোমার দাসানুদাস, চাই যে শান্তি সত্য জ্ঞান।থ তিনি সেহরি নিয়েও বলেছেন- ‘জাগো জাগো রোজাদাররা জাগো, জাগো রে এবার, লও সেরে লও থাকতে সময়, সেহরি তোমার।

 

কবি আজিজুর রহমানের ‘রোযা’ কবিতায় রোজার গুরুত্বারোপ ফুটে উঠেছে ভিন্ন আঙ্গিকে- ‘রোজা রেখে করো অনুভব, ক্ষুধার কেমন তাপ, দেহমনের সেই সাধনায়, পুড়িয়ে নে তোর পাপ। প্রভুভক্তি দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করার মাস রমজান। সিয়াম কিয়ামের মাধ্যমে মহান আল্লাহর কাছে যাওয়ার মাস। একজন স্বার্থক রোজাদারের কার্যপ্রণালী উল্লেখ করে ড. আইয়ুব আলী তাঁর নিবন্ধে বলেন- ‘সিয়ামের উদ্দেশ্যাবলী সার্থক করতে হলে সিয়াম পালনকারীকে প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও রিপুসমূহকে অন্যায় থেকে বিরত রাখতে হবে এবং ন্যায়ের অনুশীলন করতে হবে।

 

সারাদিন হালাল দ্রব্য গ্রহণে বিরত থেকে ইফতারির সময় যদি অন্যায় ও অবৈধভাবে উপার্জিত খাদ্যাদির দ্বারা ইফতার করা হয়, তবে সওয়াবের পরিবর্তে আরও গুনাহর কাজ করা হল তা সাধারণ জ্ঞানেও বোঝা যায়। কবি সাবির আহমদ চৌধুরীর কবিতায় উঠেছে রমজানের মাহাত্ম্য- একটি বছর পরে আবার, কুল মুসলিম বিশ্ব ধরায়, সিয়ামের মাস এলো রমজান, আব হায়াতের শান্তি সুধায়। আত্ম অহং চিত্তদহন, বিনয় নম্র সংযমী মন। কুল রোজাদার সব কে-খোদা, খাস রহমতের শিরনী বিলায়। রমজানে পাপ মার্জনার দিক তুলে ধরে তিনি লেখেন- মাগফেরাতের সওদা নিয়ে, এলো মাহে রমজান, সকল মাসের শ্রেষ্ঠ এ মাস তৌহিদী ফরমান। ফজল-এ-খোদা রমজান নিয়ে বেশ অনেক কবিতা রচনা করেছেন। এক কবিতায় লিখেছেন- ‘আল্লাহ তোমার হাজার শোকর, দিলে মাহে রমজান- অধম নাদান বান্দার তরে, তুমি যে মেহেরবান। রমজানের এই রহমতী মাস, মিটায় প্রাণের বেহেশতী আশ, খোদা আমরা। তোমার দাসানুদাস, চাই যে শান্তি সত্য জ্ঞান। রোজাদারদের দোয়া কবুলের মুহূর্ত সেহরি নিয়ে তিনি বলেছেন- ‘জাগো জাগো রোজাদাররা জাগো জাগো রে এবার, লও সেরে লও থাকতে সময় সেহরি তোমার।

 

শরিয়তে ইসলাম মাসিক পত্রিকার ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর সংখ্যায় রমজান সংবর্ধনা শীর্ষক নিবন্ধে রমজানকে তুলে ধরেছেন বিশেষ মর্যাদায়- তুমি, তিব্বত-তাতার, আন্দালুসিয়া, অস্ট্রীয়া, সিকিম, আজারবাইজান, কাজানে সুধা ঝরনার বর্ষণে এস! আফগানিস্তানে, কান্দাহারে, পারস্যে, তুরস্কে, মরক্কো, আরব-মিসরে, ইস্পাহানে, রোমে, শামে, বিশ্বের প্রতি কেন্দ্রে তুমি নবজাগরণের পুলক শিহরণ নিয়ে এস! দজলা-ফোরাত, জর্দান-নীলনদ ও সিন্ধু গঙ্গা জোয়ারে পূর্ণ করে এস! শোকতাপ জর্জরিত, অনশন-অর্ধানশন কিষ্ট, বন্যা পীড়িত, লাঞ্ছিত মুসলিম আমরা, আজ সত্য সত্যই তোমার আগমনে আনন্দিত। আল্লাহু আকবার! দূর মিনারে অনুরণিত হলো মাগরিবের আযান। ছোট ছোট বাচ্চারা হৈ-হুল্লোড় করে দৌড়ানো শুরু করল খালি মাঠের দিকে, কেউ উঠল গাছের মগডালে, আবার কেউবা উঠল বাড়ির ছাদে; ছোট ছোট এই বাচ্চাদের সাথে বড়রাও আছে। সবার দৃষ্টি ঐ পশ্চিম আকাশে। সবাই হন্যে হয়ে যেন খুঁজছে কিছু। অবশেষে দেখা দিল সুতার মত চিকন রমজানের নতুন চাঁদ। সবার মন খুশিতে ভরে উঠল। বাচ্চারা খুশির অতিশয্যে নাচানাচি শুরু করেছে, আর বড়রা শুকরিয়া সরূপ বলল আল-হামদুলিল্লাহ; সবাই নতুন চাঁদ দেখার দোআ পড়ল। কারো মুখে হাসি,কারো চোখে আনন্দের অশ্রু। রমজানে আমাদের আসলেই করণীয় কী; এ বিষয়ে দু’লাইন লিখে নিবন্ধের ইতি টানছি- নিশিথে ভোজন, দিবসে বর্জন, সংযত রাখো চোখ মুখ মন, হরদম করো মওলার স্মরণ। তাকওয়ার মাধ্যম, খোদার রাহে সংযম, তিনিই বুঝবে মরম, বদলা দিবেন আল্লাহ পরম। করেছ যত পাপ, হও অনুতপ্ত, চাও ক্ষমা, প্রভু করবে অনুগ্রহ, পাপ মাফ, অমাবশ্যা কেটে উঠবে পূর্ণিমা।