জীবনী

ইমাম আযম আবু হানিফা (রা.) ও হানাফী মাযহাব

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

কুরআন সুন্নাহ এজমা কিয়াসের দলিল চতুষ্টয়ের আলোকে মুসলিম মিল্লাতের জীবনধারা পরিচালিত। রসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবায়ে কেরামের জীবনাদর্শ, তাবেঈন ও মুজতাহিদ ইমামগণের ইজতিহাদ তথা গবেষণা কর্ম উম্মতের জন্য অনুসরণযোগ্য ও অনুকরণীয় আমল।

পবিত্র কুরআনের আলোকে ইমাম আযম (র.)’র মর্যাদা:

মহান রাব্বুল আলামীন, মহাগ্রন্থ আল কুরআনে মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসরণ করার অপরিহার্যতা প্রসঙ্গে অসংখ্য আয়াত এরশাদ করেছেন। ইমাম আযম আবু হানিফা (র.) মুজতাহিদ ইমামগণের শিরোমনি অভিধায় ভূষিত। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগণ, নির্দেশ মান্য করো আল্লাহর এবং নির্দেশ মান্য করো রসূলের আর তাদেরই যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। (তরজমা, কানযুল ঈমান, সূরা: নিসা, আয়াত: ৫৯)

 

বর্ণিত আয়াতের “উলিল আমর” এর তাফসীর প্রসঙ্গে:

 

হযরত ইবনে আব্বাস, হযরত মুজাহিদ ও হযরত হাসান বসরী (রা.) প্রমূখ তাফসীরকারদের বর্ণনামতে, এর দ্বারা মুজতাহিদ ওলামা ও ফোকাহা ইসলামী আইনজ্ঞদের বুঝানো হয়েছে। তাফসীরে ইবনে কাসীর এর বর্ণনামতে এর দ্বারা মুজতাহিদ ওলামা ও শাসক উভয় শ্রেণিকেই বুঝানো হয়েছে। কারণ ধর্মীয় ব্যবস্থাপনা ও রাষ্ট্র পরিচালনা এ দু’শ্রেণির হাতেই ন্যস্ত।

হাদীস শরীফের আলোকে মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসরণ:

মাযহাবের ইমামগণের অনুসরণ প্রসঙ্গে অসংখ্য হাদীস রয়েছে। এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুযুর পূরনুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মানুষ তোমাদের অনুগামী হবে। তারা ভূপৃষ্ঠের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তোমাদের নিকট দ্বীনি ফিকহ্‌ অর্জন করতে আসবে। যখন তারা তোমাদের কাছে আসবে তোমরা তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করবে। (ইবনে মাযাহ, হাদীস: ২৪৯, তাবরানী হাদিস: ৪০০) বর্ণিত হাদীসের আলোকে প্রমাণিত হলো সাহাবায়ে কেরাম জটিল কঠিন সমস্যার সমাধানে তাঁরা মুজতাহিদ সাহাবীদের শরণাপন্ন হতেন।

 

প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু একদা জাবিয়া নামক স্থানে ভাষণ দেন, তাঁর প্রদত্ত ভাষণে বলেন, যে ব্যক্তি ফিক্‌হ শাস্ত্র সম্পর্কে জানতে চায় সে যেন মুআয ইবনে জাবল এর শরণাপন্ন হয়। (বায়হাকী, সুনানুল কুররা, ৬:২১০)

 

ইমাম আযম (রা.)’র সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:

ইমাম আযম (র.)’র জন্ম ৮০ হিজরি প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী ইরাকের কুফায়। তাঁর নাম নুমান, উপনাম আবু হানিফা, উপাধি ইমাম আযম, পিতার নাম ছাবিত। দাদার নাম যুতী। তিনি ছিলেন পারস্যের অধিবাসী, দাদা অগ্নি উপাসক ছিলেন, ৩৬ হিজরিতে ইসলামে দীক্ষিপ্ত হন, দাদা যুতী স্ত্রীকে নিয়ে মক্কার পথে রওয়ানা হন, সেখান থেকে কুফায় পৌছে হযরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সান্নিধ্য অর্জন করেন। তিনি কাপড় ব্যবসায়ী ছিলেন ৪০ হিজরিতে যুতীর এক পুত্র সন্তান জন্ম নেন। তাঁর নাম রাখা হলো সাবিত, দুআ ও বরকত নেয়ার জন্য পুত্রকে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর দরবারে নেয়া হলো, তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দুআ করেন, সাবিত এর শিশু অবস্থায় পিতা ইন্তেকাল করেন। মায়ের স্নেহে লালিত পলিত হন, তাঁর ৪০ বছর বয়সে ৮০ হিজরিতে পরিবারে এক নুরানী সন্তান জন্ম লাভ করেন। পিতা মাতা স্নেহ করে নাম রাখেন নুমান, তিনি হলেন, বিশ্ব বিখ্যাত ইমাম যুগের শ্রেষ্ঠ মুজতাহিদ ফকীহ যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, মুফাসসির সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন তাবেঈ। সাহাবীর সাথে যার সাক্ষাৎ হয়েছে, তাঁকে তাবেঈ বলা হয়। ইমাম আযম (র.) তাবেঈ হওয়ার বিষয়টি প্রসিদ্ধ ও সর্বজন স্বীকৃত। (তারিখে বাগদাদ, খন্ড: ১৩, পৃ: ৩২৭, আল খায়রাতুল হিসান, পৃ: ৩০, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ২য়, পৃ: ৪৫৫)

 

মাযহাবের ইমামদের মধ্যে একমাত্র ইমাম আযম সাহাবীদের সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। আল্লামা কাযী ইবনে খাল্লিকান (র.)’র মতে, ইমাম আবু হানিফা (র.) চারজন সাহাবীদের সাক্ষাৎ লাভ করেছেন-3

 

১. কুফায় হযরত আনাস ইবন মালিক (রা.) (ওফাত ৯৩ হিজরি),
২. আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা (রা.) (ওফাত ৮৭ হিজরি),
৩. মদীনা শরীফে হযরত সাহল ইবনে সাদ আস্‌ সায়িদী (রা.) (ওফাত: ৮৮ হিজরি),
৪. মক্কা শরীফে হযরত আবুত্‌তুফাইল আমের ইবনে ওয়াসিলা (রা.) (ওফাত, ১১০ হিজরি)
(ইবনে খাল্লিকান, ওয়াফায়াতুল আয়ান ওয়া আম্বাউ আবনায়িযযামান, খন্ড: ৫, পৃ: ৪০৬)

 

নির্ভরযোগ্য বর্ণনা মতে তিনি আরো যেসব সাহাবীদের সাক্ষাৎ লাভ করেছেন-

 

৫. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হারিস যুবায়দী (র.) (ওফাত ৯৯ হিজরি)
৬. হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ আল-আনসারী (রা.) (ওফাত ৭৮ হিজরি),
৭. হযরত ওয়াসিলা ইবনুল আসকা (রা.) (ওফাত ৮৩ বা ৮৫ হিজরি)
(আয্‌যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খন্ড: ৩, পৃ: ১৯৪, ইবনে হাজর আল-আসকালানী, তাহযীবুত তাহযীব, খন্ড: ১১, পৃ: ৮৯)

 

সাহবী হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.)’র সাথে সাক্ষাতের কথা ইমাম আযম নিজেই বর্ণনা করেছেন, “আমি হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.)কে নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখেছি। (মুসনাদু ইমাম আবী হানীফা, পৃ: ২৪) ইমাম ইবনে হাজর আল-হায়তমী (র.) বলেন, অন্য বর্ণনায় এসেছে, আমি তাকে বহুবার দেখেছি, তিনি লাল বর্ণের খেজাব লাগাতেন।

 

তাঁর তাকওয়া ও আমল:

ইমাম আযম (রা.) ছিলেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাদর্শের বাস্তব নমুনা। তাকওয়া পরহেজগারী ইবাদত বন্দেগী ইলমে দ্বীনের খিদমত ও সাধনা ছিল তাঁর মহান ব্রত, ইশকে এলাহী ও ইশকে রাসূল তথা নবী প্রেমে বিভোর ইমাম আযম হজ্বে বায়তুল্লাহ ও যিয়ারতে মদীনার লক্ষ্যে জীবনে ৫৫ বার হারামাঈন শরীফাঈন গমন করেন। এক রমজানেই ওমরা করেছেন ১২০ বার। একাধারে চল্লিশবছর এশার অযুতে ফজরের নামায আদায় করেছেন। বছরে ১২ মাস একাধারে ৩০ বছর রোযা রেখেছেন, প্রতি রমজানে ৬১ বার কুরআন মজীদ খতম করতেন। ৯৬ হিজরি থেকে ১৫০ হিজরি প্রতি বছর হজ্বে বায়তুল্লাহর উদ্দেশে মক্কা মদীনা সফর করতেন। ১৩০ হিজরি থেকে ১৩৬ হিজরি পর্যন্ত ছয় বছর মক্কা ও মদীনা শরীফে অবস্থান করেন। (আল মুওয়াফফাক আল মক্কী, মানাকিবুল ইমামিল আযম, আবী হানীফা, খণ্ড: ২)

 

ইমাম আযম ছিলিন মুহাদ্দিসকুল শিরোমণি:

 

ইমাম আযম (র.) হাদীস শাস্ত্রের বিশাল জ্ঞান ভান্ডার আহরণের জন্য তৎকালীন সময়ে হারামাইন শরীফাইনের পর হাদীস শাস্ত্রের চর্চা ও গবেষণার প্রাণকেন্দ্র ছিল বাসরা তিনি ইলমে হাদীসে গভীর পান্ডিত্য ও বুৎপত্তি অর্জনের জন্য জীবনে ২০ বার বসরা সফর করেছেন। পবিত্র কুরআনের পর আসমানের নীচে জমীনের উপরে ইসলামী বিশ্বের সর্বত্র সমাদৃত সর্বাধিক সহীহ গ্রন্থ সহীহ আল বুখারীর প্রণেতা ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল আল-বুখারী (র.) স্বীয় বুখারী শরীফে ইমাম আযম (র.)’র প্রখ্যাত ৭০ জন শিষ্যের শিষ্য থেকে হাদীস গ্রহণ করেছেন এতে প্রতীয়মান হয় ইমাম আযম কেবল ফিক্‌হ শাস্ত্রের জগতে মহান দিকপাল ছিলেন তা নয় বরং হাদীসের জগতেও তাঁর অসাধারণ বুৎপত্তি ছিল। সাতজন সাহাবী ও তিরানব্বইজন প্রসিদ্ধ তাবেঈ ছিলেন

ইমাম আযম (র.)’র শিক্ষক:

ইমাম আযমের শিক্ষকদের তালিকায় সাতজন সাহাবী এবং তিরানব্বইজন প্রসিদ্ধ তাবেঈ রয়েছে। ফিকহ শাস্ত্রে তাঁর প্রধান ওস্তাদ হলেন হযরত হাম্মাদ ইবনে আবী সুলাইমান (ওফাত ১২০ হি.)

 

আল্লামা জালালউদ্দীন সুয়তী (র.)’র বর্ণনা মতে ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সর্বপ্রথম শরীয়তের বিভিন্ন বিধানাবলী আহকামে শরীয়ত মাসআলা মাসায়েল সংকলন করেন। তাঁর ওস্তাদ হাম্মাদ (রা.)’র ইন্তিকালের পর তিনি ফিকহ শাস্ত্র প্রণয়নের কাজ শুরু করেন। বিভিন্ন অধ্যায় ভিত্তিক বিন্যাস করেন। ৩৮ হাজার ইবাদত সম্পর্কিত ৪৫ হাজার মানব জীবনের বিভাগ ও অধ্যায় সম্পর্কিত নিত্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা উদ্ভাবন করেন যা ব্যাপক পর্যালোচনা গবেষণা বিশ্লেষণ ও পরিবর্ধনের পর ছয় লক্ষ্যে উন্নীত হয়। উপমহাদেশে হানাফি ফিকহ শাস্ত্রের উপর রচিত বিশাল গ্রন্থ ফাতাওয়া-ই হিন্দিয়া যা “ফাতাওয়া-ই আলমগীরি” নামে সর্বত্র সমাদৃত। এ বিশাল গ্রন্থের পর হানাফী মাযহাবের উপর সর্ববৃহৎ ফাতাওয়া গ্রন্থ হিসেবে ইমাম আহমদ রেযা বেরলভী (র.) প্রণীত “ফাতওয়া-ই রেযভীয়্যাহ” মুসলিম উম্মাহর এক বিশাল জ্ঞান ভান্ডার ও অমূল্য সম্পদ। (মাযহাব অনুসরণ ও বিভ্রান্তি নিরসন, কৃত: অধ্যক্ষ মোহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি, পৃ: ২২)

 

হানাফী মাযহাব:

মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মতে প্রসিদ্ধ চার মাযহাব হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বলী মাযহাব চতুষ্টয়ের যে কোন একটির অনুসরণ অপরিহার্য। (তাফসীরাতে আহমদীয়া, পৃ: ৩৪৬)

 

যে ব্যক্তি ইমাম চতুষ্টয়ের বিরোধীতা করবে সে “ইজমা” উম্মাহর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত বিরোধী হিসেবে গণ্য হবে। (আল আশবাহ ওয়ান নাযাযির, পৃ: ১৩১)

 

হানাফী মাযহাব সহীহ হাদীস নির্ভর:

ইমাম আবু হানিফা (র.) বলেছেন, কোনো সহীহ হাদীস পাওয়া গেলে সেটিই আমার মাযহাব, (ইবন আবিদীন, আল হাশিয়্যাহ, খন্ড: ১, পৃ: ৬৩)

 

আলহামদুলিল্লাহ বর্তমানে বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ মুসলমান হানাফী মাযহাবের অনুসারী। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়ামেন, তুরস্ক, গায়ানা, ত্রিনিদাদ, মিশরসহ বিশ্বে অসংখ্য রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ট সুন্নী মুসলমান হানাফী মাযহাবের অনুসারী। ঊনবিংশ শতাব্দীতে উসমানি শাসকগণ হানাফী মাযহাবের আইনকে রাষ্ট্রীয় আইনে পরিণত করেন। (ড. আবু আমীনাহ বিলাল, মাযহাব, পৃ: ১১০)

 

ইমাম আযম (র.)’র ওফাত:

ইমাম আযম ২ শাবান ১৫০ হিজরিতে ৭০ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। ইরাকের বাগদাদে শরীফে শায়িত হন। হে আল্লাহ আমাদেরকে এই মহান ইমামের মাযহাব অনুসরণ পূর্বক তাঁর ফুয়ুজাত নসীব করুন। আমীন।

 

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী)