জীবনী

সৈয়দ গেছুদারাজ (রহ:) ও তাঁর অমর বাণী

ড. মুহাম্মদ মাসুম চৌধুরী

সুলতানুল আরেফিন ঈমামুল আউলিয়া সৈয়্যদ্দুস সাদাত হযরত মখদুম সৈয়দ মোহাম্মদ গেছুদারাজ (র.) ছিলেন ভারত উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত অলি। তিনি ৭২১ হিজরী সনের মাহে রজবের ৪ তারিখ দিল্লী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁর পিতা ও নানার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। এরপর শিক্ষকের কাছে কোরআনে হাফেজ হন। তাঁর পিতা ও নানা উভয়েই হযরত খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মুরীদ ছিলেন। তিনি তাঁর পিতা ও নানার জবান মোবারকে নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রাহ.) ও তাঁর যোগ্য খলীফা হযরত খাজা নাসির উদ্দিন মাহমুদ চেরাগে দিল্লী (র.)’র অনেক কারামত ও বুজর্গী ঘটনা শুনেছেন। ফলে গেছুদারাজ (রহ.) এর মাঝে চেরাগ দিল্লির প্রেম, ভালোবাসা অন্তরে জাগ্রত হয়।

তিনি কিছুদিন দিল্লী শহরের বাইরে থাকলেও পুনরায় দিল্লীতে হাজির হয়ে হযরত খাজা চেরাগ দিল্লী (রহ.)’র সাক্ষাৎ করে বিমোহিত হয়ে পড়েন। অতঃপর তাঁর বড় ভাই সৈয়দ হোসাইনসহ তিনি খাজা চেরাগ দিল্লী (রহ.)’র হাতে বায়েত গ্রহণ করেন। বায়েত গ্রহণের পর আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধনায় নিজকে ডুবিয়ে রাখেন। পাশাপাশি জাহেরী জ্ঞান অর্জনের পথটি খোলা রাখেন। মখদুম সৈয়দ মোহাম্মদ গেছুদারাজ (রহ.)’র প্রতি তাঁর পীর হযরত খাজা নাসির উদ্দিন মাহমুদ চেরাগ দিল্লী (রহ.) অত্যাধিক দয়া ও ভালোবাসার হাত প্রসারিত করেন। পীর সাহেব ৭৫৭ হিজরীর ১৫ রমজান রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লে তাঁর কাছে জিজ্ঞেস করা হলো কাকে খিলাফতের ভার অর্পণ করবেন। তিনি বললেন, খলিফাদের মধ্যে হতে যারা এ ক্ষমতা লাভের দাবিদার তাদের নাম লিখে আমার নিকট নিয়ে এসো। খলিফাদের মধ্যে যারা এ ক্ষমতার দাবিদার তাঁদের একটি তালিকা তৈরি করতঃ হযরতের হাতে অর্পণ করেন, তালিকাটিতে হযরত গেছুদারাজের নাম ছিল না। হযরত তালিকাটি দেখে বললেন, এসব কাদের নাম লিখে আনলে। খিলাফতের দায়িত্ব পালন সহজ কথা হয়। নিজের ঈমান রক্ষা করা কঠিন, অপরের রুহ জাগ্রত করবে কী করে। তালিকাটি আরো একটু ছোট করে উপস্থাপন করা হয়, সেখানেও খাজা গেছুদারাজের নাম নেই। পীর সাহেব রাগতস্বরেই বললেন, সৈয়দ মোহাম্মদ-এর নাম কোথায় ? সাথে সাথে তাঁরা হযরত গেছুদারাজের নাম লিখে উপস্থাপন করলেন। হযরত খাজা নাসিরুদ্দিন মাহমুদ চেরাগ দিল্লী(রহ.) হযরত গেছুদারাজের নামের উপর তার সিদ্ধান্ত প্রদান করেন এবং তাকে স্থলাভিষিক্ত করেন।

হযরত গেছুদারাজ (র.) তাঁর পীর হযরত খাজা নাসিরুদ্দিন চেরাগ দিল্লী (রহ.) এর খেদমতে জীবনের ১৭টি বছর উৎসর্গ করেন। তিনি অর্ধরাত অতিক্রম করার পর নিজে ওজু করতেন এবং নিজের মোরাশেদকে ওজু করাতেন অতঃপর সারারাত শরীয়তের ও তরিকতের ইবাদতে মশগুল থাকতেন। তরিকতের কাজ করতে গেলে শরীয়তকে বাদ দিতে হয় না সে শিক্ষা আমরা তাঁর জীবন হতে পাই। প্রতিটি সুন্নাত পালন করা তাঁর জীবনের অঙ্গ ছিল। পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়তেন তিনি জামায়াতের সাথে।

হযরত খাজা গেছুদারাজ (রহ.) তাঁর অমর বাণীতে লিখেগেছেন যে, হযরত মাওলানা ফখরুদ্দীন রাজি (রহ.) সূর্যকে বশীভূত করে রেখেছিলেন। ঈমাম সাহেব বশীভূত করা সম্বন্ধে ‘ছিররে মাকতুম’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি বলেছেন বশীকরণ করা ভালো আমল নয়। এতে বাতেনী শক্তির অন্ধকার হয়। হযরত খাজা সাহেব বললেন, আল্লাহ পাক কোন ব্যক্তিকে বেলায়াত প্রদান করলে তাকে তারকার প্রভাবও দান করেন। সকল অলির মাথার উপর থাকে চন্দ্র, সম্মুখে থাকে সূর্য, পিছনে শুকতারা, ডানে শনিগ্রহ, বায়ে বৃহস্পতি এবং পায়ের নিচে মঙ্গলগ্রহ। এসব ব্যবস্থা এ জন্য করা হয় যে যদি কোন শত্রু অলির বিপক্ষে দণ্ডায়মান হয় তাহলে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে।

হযরত গেছুদারাজ (রহ.) বলতেন, কালিম, আরিফ ও মুহাক্কাকীনদের নিকট পীরের খেদমত ও আদর করা কর্তব্য। খেদমত দ্বারা আল্লাহর পক্ষ হতে অশেষ নেয়ামত পাওয়া যায়। হযরত খাজা কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রহ.) ‘দলিলুল আরেফী’ এ লিখেছেন, আমার পীর মোরশেদ হযরত খাজা গরীব নেওয়াজ মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.) বলতেন, ‘হযরত খাজা ওসমান হারুনী (রহ.) এর নিকট বায়াত হওয়ার পর বিশ বছর পর্যন্ত পীরের খেদমতে ২৪ ঘন্টা নিয়োজিত ছিলাম। দিন রাতের কোন হিসেব আমার কাছে ছিলনা। সফরেও আমি তাঁর খেদমত সঙ্গে থাকতাম। তাঁর সমস্ত জিনিসপত্র নিজের মাথায় বহন করে নিয়ে চলতাম এবং আমি যে নিয়ামত লাভ করেছি তা তারই দয়ার দান।

খাজা গিছুদারাজ (রহ.) বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, ‘আউলিয়ায়ি তাহতি কাবায়ি’ অর্থাৎ আমার আউলিয়া আমার জুব্বার নিচে। একথাটির গভীরতা বুঝতে হবে। আউলিয়াগণ ইলাহির কোন না কোন সিফাতের মধ্যে নিমজ্জিত থাকেন। লোকজন প্রকাশ বিরোধিতা করলে তারা আল্লাহর আজাবে পতিত হবে। তাদের বিরুদ্ধাচরণ করা আল্লাহরই বিরুদ্ধাচারণ করা এবং তাদের প্রতি আনগত্য করা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য করা। তাঁদের ভালোবাসা আল্লাহকেই ভালোবাসা।

হযরত খাজা গিছুদারাজ (রহ.) একদিন তাঁর ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন, হযরত খাজা ওসমান হারুনী (রহ.) বর্ণনা করেছেন, মানুষের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, আশা, বাসনা ও লোভ লালসার মধ্যে নিমজ্জিত। ইবাদতের সময় ঐ খায়েশ ও লোভ লালসা ইবাদতকারীর জন্য প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। যে পর্যন্ত মানুষ ঐ সকল বিষয় হতে তাওবা না করবে এবং জাহেরী ও বাতেনী অপবিত্রতা হতে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও নিজেকে পবিত্র না করতে পারবে সে পর্যন্ত ইলাহীর নৈকট্য লাভের ‘মাকামে কুরবে ইলাহী’ তে পৌঁছতে পারবে না। যে নিজের মধ্যে আল্লাহ প্রাপ্তি-ঘটাতে চায় তাকে দিবা রাত আল্লাহর বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকতে হয়।

হযরত খাজা বান্দাহ নেওয়াজ গেছুদারাজ (রহ.) তাঁর সময়কালের মধ্যে সবচেয়ে বড় কামিল লোক ছিলেন। তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার ধারণা করা দুরূহ ব্যাপার। তাঁর কামলিয়াত জাহেরী ও বাতেনী উভয় দিকেই বিদ্যমান ছিল। তিনি অত্যন্ত সূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। চিশতিয়া তরিকার বুজুর্গদের মধ্যে হযরত খাজা হাসান বসরী (রহ.) হতে হযরত খাজা নাসিরুদ্দিন মাহমুদ চেরাগী দিল্লী (রহ.) পর্যন্ত অনেকেই কোন কিতাব রচনা করেননি। কিন্তু প্রত্যেকের মলফুজাত রয়েছে। কিন্তু হযরত গেছুদারাজ (রহ.) শরীয়ত ও তরিকতের ১০৫টি কিতাব রচনা করেছেন। কিতাবগুলো তাসাউফপন্থীদের জন্য বিশেষ সহায়ক হিসেবে কাজ করে।