জীবনী

হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি)’র‌ জীবন ও কর্ম

লেখক : আহমদ শাহ আদীল

ছোজমে রুমী-অ-জা’মী ওয়াইজ ক্বরনিয়ে জমাঁ
ইশক্বমেঁ আত্তার জেয়ছে আ’শেক্বে খাইরুল আনাম

জন্ম ও পরিচয়:

নাম তৈয়ব শাহ। পিতা সৈয়দ আহমদ শাহ ও মাতা সৈয়দা খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান। ১৩৩৬ হিজরি ১৯১৬ সালে বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ হাজারা জেলার সিরিকোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিতৃকুল-মাতৃকুল উভয় দিক দিয়ে ছিলেন সৈয়দ বংশীয়। তাঁর পূর্বপুরুষ ইসলাম প্রচারে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে বাগদাদ আসেন সেখান থেকে আফগানিস্তান,  আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে তাঁর ঊর্ধ্বতন সৈয়দ মুহাম্মদ গফুর শাহ্‌ ওরফে কাফুর শাহ্‌ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্তমান আবাসস্থল সিরিকোটের পাহাড়ের শীর্ষে এসে বসতি স্থাপন করেন।

তাঁর বংশীয় শাজরা:

হযরত নবী মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
১) হযরত ফাতেমাতুজ্জাহরা (রা:) [সহধর্মিনী হযরত মাওলা আলী (রা:)]
২) হযরত ইমাম হুসাইন (রা:)
৩) হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (রা:)
৪) হযরত ইমাম বাক্বের (রা:)
৫) হযরত ইমাম মুহাম্মদ জাফর সাদেক্ব (রা:)
৬) হযরত সৈয়দ ইসমাইল (রা:)
৭) হযরত সৈয়দ জালাল (রা:)
৮) হযরত সৈয়দ শাহ্‌ ক্বায়েম (কায়েন) (রা:)
৯) হযরত সৈয়দ জাফর (ক্বা’ব) (রা:)
১০) হযরত সৈয়দ ওমর (রা:)
১১) হযরত সৈয়দ গাফফার (রা:)
১২) হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ গীসুদারাজ (রা:) ৪২১হি:
১৩) হযরত সৈয়দ মাসুদ মাস্ওয়ানী (রা:)
১৪) হযরত সৈয়দ তাগামমুজ্ শাহ্‌ (রা:)
১৫) হযরত সৈয়দ ছুদুর (রা:)
১৬) হযরত সৈয়দ মুছা (রা:)
১৭) হযরত সৈয়দ মাহমুদ (রা:)
১৮) হযরত সৈয়দ আবদুর রহিম (রা:)
১৯) হযরত সৈয়দ আবদুল গফুর (রা:)
২০) হযরত সৈয়দ আবদুল জালাল (রা:)
২১) হযরত সৈয়দ আবদুর রওফ (রা:)
২২) হযরত সৈয়দ আবদুল করীম (রা:)
২৩) হযরত সৈয়দ আবদুল্লাহ্ (রা:)
২৪) হযরত সৈয়দ গফুর শাহ্‌ (রা:) (প্রকাশ:কাপুর শাহ্‌ সিরিকোট)
২৫) হযরত সৈয়দ নাফ্ফাস্ শাহ্‌ বা তাফাহ্হুছ্ শাহ্‌ (রা:)
২৬) হযরত সৈয়দ আবী শাহ্‌ মুরাদ (রা:)
২৭) হযরত সৈয়দ ইউসুফ শাহ্‌ (রা:)
২৮) হযরত সৈয়দ হোসাইন শাহ্‌ (রা:)[হোসাইন খিল(রা:)]
২৯) হযরত সৈয়দ হাজী হাসেম (রা:)
৩০) হযরত সৈয়দ আবদুল করিম (রা:)
৩১) হযরত সৈয়দ ঈসা (রা:)
৩২) হযরত সৈয়দ ইলিয়াছ (রা:)
৩৩) হযরত সৈয়দ খোশহাল (রা:)
৩৪) হযরত সৈয়দ শাহ্‌ খাঁন (রা:)
৩৫) হযরত সৈয়দ কাজেম (রা:)
৩৬) হযরত সৈয়দ খানী জামান শাহ্‌ (রা:)
৩৭) হযরত সৈয়দ ছদর শাহ্‌ (রা:)
৩৮) হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ্‌ সিরিকোটি (রা:)
৩৯) হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ্‌ (রা:)

খাজা চৌহরভী(রহঃ)’র উপহার ও সুসংবাদপ্রাপ্ত বালক:

একদা আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর পীর খাজা আব্দুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র খিদমতে উপস্থিত হন, তখন খাজা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি নিজের পৃষ্ঠদেশে আল্লামা সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র শাহাদাত আঙ্গুলি রেখে ঘর্ষণ করে বলেন- ‘يه پاك چيز تم لے لو’ “এ পবিত্র বস্তু তুমি নিয়ে নাও”। যেমনটি গাউসুল আযম শায়খ আবদুল ক্বাদির জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এরূপে শায়খ আলী ইবন মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র পৃষ্ঠদেশ ঘর্ষণ করে সন্তান দান করেছিলেন। পরে ঐ সন্তান ইবনুল আরবী নামে খ্যাতি লাভ করেন।

উল্লেখ্য হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি জন্মের সময় আল্লামা সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র বয়স ছিল প্রায় ৬০ বছর। সাধারণত বৃদ্ধ বয়সের সন্তান দুর্বল হয় এবং বংশ পরম্পরা দীর্ঘ হয় না। তাই তা খণ্ডন পূর্বক আল্লামা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ‘পাক ছিজ’ উল্লেখ করে পুত্র ও নাতি উভয়ের সুসংবাদ প্রদান করেছেন। কারণ ‘পাক’ শব্দের আরবী প্রতিশব্দ ‘তৈয়্যব’ ও ‘তাহির’। যেমনটি আল্লাহ্ ইব্রাহীম আলায়হিস সালাম-এর নিকট ইসহাক আলায়হিস্ সালামকে দান করার ক্ষেত্রে ইয়াকুব আলায়হিস সালাম-এর কথা উল্লেখ করেছেন।

শৈশবকাল ও শিক্ষার্জন:

এ মহান ব্যক্তিত্ব মাত্র এগারো বছর বয়সে তাজভীদসহ কুরআন হেফজ সম্পন্ন করেন। বুজুর্গ পিতা হাদিয়ে দ্বীনো মিল্লাত আল্লামা হাফেজ সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র মাধ্যমে তাঁর শৈশব শিক্ষার হাতেখড়ি হয়।

তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল শ্রুতিমধুর ও চিত্তাকর্ষক। তাঁর সুললিত কণ্ঠে কুরআন মজিদের তিলাওয়াত শুনতে সকলেই উদগ্রীব থাকতো। নিজ পিতার তত্ত্বাবধানে হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ‘র প্রতিষ্ঠিত হরিপুর রহমানিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায় ষোলো বছর যাবত কুরআন, হাদিস, তফসির, ফিকহ, নাহু, সরফ, মানতিক, আক্বাইদ, দর্শন, বালাগাত ও আরবি সাহিত্যসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি।

তাছাড়া তৎকালীন সেরা প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ফকিহ ও মুফাসসির আল্লামা সরদার আহমদ শাহ লায়লপুরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র সান্নিধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে পাণ্ডিত্য ও দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি প্রখর মেধার অধিকারী ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন ছিলেন। অসাধারণ মেধা, প্রতিভা ও স্মৃতিশক্তির কারণে মাত্র ২৭ বছর বয়সে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি শিক্ষার সর্বশেষ প্রাতিষ্ঠানিক সনদ অর্জন করেন।

শৈশবকালের কিছু ঘটনা-

●আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র জন্মের ৬/৭ মাস পর খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সিরিকোটে আগমন করেন। তখন তাঁকে শিরনি খাওয়ানোর সময় খাজা আব্দুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বললেন, ‘طيب تم نهيں كهاتے تو هم بهى نهيں كهائنگے’ “তৈয়্যব তুমি না খেলে আমরাও খাব না” এ কথা শুনে তিনি শিরনি খেতে লাগলেন।

●আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র বয়স যখন প্রায় দু’বছর, তখন তাঁর আম্মাজান তাঁকে নিয়ে খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র খিদমতে উপস্থিত হন। সেখানে অবস্থানকালে খাজা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র সম্মুখে তিনি শিশুসূলভ অভ্যাসে মায়ের দুধপান করতে চাইলেন। তখন খাজা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বললেন, ‘تم بڑهاهوگيا دوده مت پيو ’ “ তুমি বড় হয়েছ, দুধপান কর না”। পরে তিনি আর মায়ের দুধ পান করেননি। শত চেষ্টা করেও তাঁকে আর দুধ পান করানো সম্ভব হয়নি।

●শৈশব থেকেই তাঁর আচরণে আধ্যাত্মিকতার প্রভাব পরিলতি হবার কারণে ‘মাদারজাত অলী’ (মাতৃগর্ভের অলী) হিসেবে তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন বাল্যকালেই। পরবর্তীতে স্বয়ং তাঁর আব্বা হুযূর ও চট্টগ্রামে বহুবার তাঁকে মাদারজাত অলী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। একবার সিরিকোটি হুযূরের কোন এক মুরীদ শাহ্জাদা তৈয়্যব শাহ্ হুযূরের জন্য এক জোড়া জুতা বানাতে অনুমতি চান এবং পায়ের মাপ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলেন যে, তাঁর পায়ের একই সাইজে বানালে চলবে। জুতা তৈরী করে আনার পর ঐ জুতা মাপ মতো হয়েছে কিনা পায়ে দিয়ে দেখতে আরজ করেন সিরিকোটি হুযূরকে। তখনই তাঁর মেজাজ আর কে থামায়! তিনি বলেন, ‘খামোশ! মেরে হিম্মত নেহী হ্যায় তৈয়্যবকে জুতো পর পাও রাখে- উয়হ্ মাদারজাত অলী হ্যায়’।

●শৈশবে পিতার সান্নিধ্য লাভ করেছেন মাত্র চার বছর বয়স পর্যন্ত। একদা পিতার নিকট আরজ করে বসলেন, ‘نماز ميں اپ الله كو ديكهتے هيں مجهے بھی ديكهنا هے ’ “ নামাযে আপনি আল্লাহকে দেখেন, আমারও আল্লাহকে দেখা চাই”।

●একদা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র সম্মানিত শিক্ষক স্বপ্নযোগে প্রিয়নবী হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’র সাক্ষাত লাভে ধন্য হন। ঐ সময় প্রিয়নবী উক্ত শিক্ষককে খবর প্রদান করেন যে, ছাত্রদের মধ্যে তাঁর একজন বংশধর আছেন, যেন তাঁর যত্ন নেয়। অতঃপর উক্ত শিক্ষকের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন, কে সেই ? তাই দেরী না করে পরীক্ষা করলেন এভাবে – তিনি প্রত্যেক ছাত্রকে একটি করে কমলা দিয়ে বললেন, যাও! তোমাদের হাতের কমলা এমনভাবে খাও, যাতে আল্লাহ তা‘আলা না দেখেন। শিক্ষকের নির্দেশ পেয়ে প্রত্যেক শিশু নিজ নিজ মত করে কমলা খেয়ে আসল; কিন্তু শিশু তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কমলাটি উক্ত শিক্ষককে ফেরত দিয়ে বললেন- ‘আল্লাহ হার জাগা মে হ্যায়’ “আল্লাহ প্রত্যেক জায়গায় আছেন”। এ কথা শুনে শিক্ষক মহোদয় আউলাদে-ই রাসূলের পরিচয় পেয়ে গেলেন।

বাংলাদেশ আগমন ও খেলাফত লাভ:

পূর্বপুরুষের ধারাবাহিকতায় তিনিও ইসলামের প্রচার ও প্রসারে আপন আরামগাহ ছেড়ে দেশ বিদেশে সফর শুরু করেন। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের শা’বান মাসে বাংলাদেশে তিনি প্রথম আগমন করেন। ১৯৪২’র টগবগে তরুণ এই আল্লামা চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লাহ শাহী জামে মসজিদে রমজান মাসের খতমে তারাবীতে ইমামতি করেন। ১৯৫৮ সাল ছিল তাঁর আব্বা হুজুর আল্লামা সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র বাংলাদেশের শেষ সফর। এ বছরও তিনি বাংলাদেশে তশরিফ আনেন, সম্ভবতঃ দ্বিতীয়বারের মত। এ বছরই চট্টগ্রামের রিয়াজুদ্দিন বাজার শেখ সৈয়্যদ স্টোরে চলমান খতমে গাউসিয়া মাহফিলে তাঁকে আব্বা হুযুর কর্তৃক ৪২ বছর বয়সে জনসম্মুখে খেলাফত দেয়া হয়। এবং ‘খলিফায়ে আজম’ এ ভূষিত করা হয়। আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’র সংবিধান সংশোধনী কমিটিতে তাঁকে প্রধান করে এ বছরই তাঁকে আনজুমান’র জিম্মাদারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিষিক্ত করা হয়। সে থেকে সিরিকোটি হুজুরের ওফাত পরবর্তীকাল থেকে শুরু করে ১৯৮৬ পর্যন্ত তিনি এ বাংলাদেশে সফর করেন (মাঝখানে ক’বছর ছাড়া)। শরিয়ত-ত্বরিক্বতের যে আন্দোলনের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে ১৯৩৭ থেকে শুরু হয়েছিল- তা এক মহাস্রোতে রূপ লাভ করেছিল তাঁর নেতৃত্বে। এখন প্রায় এক কোটিরও বেশি মানুষ এই সিলসিলার ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনকে সুন্দর করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

সংগঠক:

গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ- ১৯৮৬ সনের শেষ সফরের পরে চিঠির মাধ্যমে আনজুমানকে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ গঠনের নির্দেশ দেন আল্লামা তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। আজ এটি সুন্নিয়ত ত্বরিকতের তথা সমগ্র মানবকুলের জন্য এক মহা আর্শীবাদ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে দেশে বিদেশে। বর্তমানে করোনাকালে করোনা রোগীর সেবা ও দাফন কাফনে এ সংগঠনের কাজ জাত ধর্মের উর্ধ্বে উঠে মানবজাতির কল্যাণে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যা ইতোমধ্যেই দেশি ও আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত। মূলতঃ আনজুমানের যাবতীয় নিয়মিত কর্মকাণ্ড ছাড়াও দ্বীনের প্রয়োজনে এ সংগঠনের কর্মীরা অতন্দ্র প্রহরীর মতো সদা সতর্ক থেকে সক্রিয় রয়েছে। সুন্নিয়তের অনুর্বর ক্ষেত্রগুলোতে উর্বরতা ফিরিয়ে আনার কাজে এরা ব্যাপক সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

ছাত্রসেনার অগ্রযাত্রার দিশারী- বাংলাদেশের সুন্নি মুসলমানদের জাগিয়ে তুলতে সুন্নি মতাদর্শের আলোকে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে ১৯৮০ সনের ২১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা প্রতিষ্ঠায় এবং এর অগ্রযাত্রায় দিশারীর ভূমিকায় ছিলেন আল্লামা হাফেজ সৈয়দ তৈয়ব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। ১৯৮২ সনের ২১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মুসলিম হলে ছাত্রসেনার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে হুজুর কেবলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা দেন- ‘ইয়ে হামারি ঈমানি ফৌজ হ্যায়, ইয়ে আউলিয়া কেরাম কি ফৌজ হ্যায়’ (এরা (ছাত্রসেনা) আমাদের ঈমানি সৈনিক, এরা আউলিয়ায়ে কেরামের সৈনিক)।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে অবদান- তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি। রাজনীতিকে দেশসেবা ও জনসেবার উপায় মনে করতেন তিনি। তাঁরই উৎসাহ ও প্রেরণায় রাজনীতিতে এসে ১৯৮৫ সনে নিজ এলাকার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আল্লামা সৈয়দ সাবের শাহ (মু.জি.আ)। ১৯৯৪ সনে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে পাকিস্তান উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন। বর্তমানেও তিনি সিনেটরের দায়িত্ব পালন করছেন।

মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা:

‘কাম করো- দ্বীনকো বাচাও, সাচ্চা আলেম তৈয়ার করো।’ আল্লামা সৈয়দ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’ তাঁর বাবা সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র এই বাণীকে সামনে রেখে ১৯৫৪ তে সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কর্তৃক চট্টগ্রাম ষোলশহরে প্রতিষ্ঠিত ‘জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদরাসা’কে এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ‘সাচ্চা আলেম’ তৈরীর কারখানাতে উন্নীত করেন- যা আজ ‘সুন্নিয়া মাদ্রাসা’ বা ‘জামেয়া’ নামে একক পরিচয়ে সমুজ্জ্বল।

এই মহান মনীষী সত্যিকারের দ্বীন প্রচারে দ্বীনি প্রতিষ্ঠান তথা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার যে বিকল্প নেই, তা সাধারণ মানুষকে বোঝানোর জন্য ১৯৬৮ সনে রাজধানী ঢাকার মুহাম্মদপুরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলীয়া মাদ্রাসা’ যা আজ রাজধানীতে সূফিবাদী সুন্নি মুসলমানদের একমাত্র অবলম্বন। আজ বাংলাদেশের রাজধানীতে এই প্রতিষ্ঠান সুন্নিয়তের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত।

এছাড়াও চট্টগ্রাম হালিশহর তৈয়্যবিয়া (ডিগ্রী) মাদ্রাসা (১৯৭৫), চন্দ্রঘোনা তৈয়্যবিয়া অদুদিয়া (ডিগ্রী) মাদরাসা (১৯৭৬) সহ বাংলাদেশ, বার্মা, পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য মাদ্রাসা।

প্রকাশনায় অবদান:

১৯৭৬ সনের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে তিনি বাংলা ভাষায় সুন্নিয়াত ভিত্তিক সাহিত্য প্রকাশনার উপর গুরুত্বারোপ করে মাসিক ‘তরজুমান এ আহলে সুন্নাত’ প্রকাশের নির্দেশ দেন এবং মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি থেকে আনজুমান কর্তৃক এ প্রকাশনার যাত্রা শুরু হয়।হুজুর কেবলা বলেন, ‘ইয়ে তরজুমান বাতেল ফেরকাকে লিয়ে মউত হ্যায়’।

গাউসে দাঁওরা খাজা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কর্তৃক সংকলিত এ সিলসিলার মাশায়েখ হযরাতে কেরামের বরকতময় দৈনন্দিন অজিফাসমূহের বিরল গ্রন্থ ‘আওরাদুল কাদেরিয়াতুর রহমানিয়া’ প্রকাশনার মাধ্যমে সিলসিলার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

জশনে জুলুছের রূপকার:

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর বিরোধী শক্তি যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করলো এবং নবীজির শানে বিয়াদবীমূলক আকিদার প্রচার প্রসার হতে লাগলো তখনই আল্লামা তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ইশক্বে রাসুলের প্রকাশার্থে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের প্রোগ্রামে সংযোজন করলেন এক নতুন অনুষ্ঠান যার নাম- ‘জশনে জুলুছ’।

আল্লামা সৈয়্যদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র প্রদত্ত রূপরেখা অনুসারে- আলহাজ্ব নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী তাঁর নির্দেশে ১৯৭৪ এ ‘আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া (ট্রাস্ট)’র ব্যবস্থাপনায় সর্বপ্রথম এই নতুন কর্মসূচীর বর্ণাঢ্য মিছিল ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে বলুয়ারদিঘী পাড়স্থ খানকাহ্ এ কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া হতে শুরু করে ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদরাসা ময়দানে এসে মিলিত হয়ে মীলাদ মাহফিল, মুনাজাত ও তবাররুক বিতরণের মাধ্যমে সমাপ্ত করে। ১৯৭৬ সনে স্বয়ং হুযুর কেবলা আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এতে নেতৃত্ব দেওয়ার ফলে এ জশনে জুলুছ দেখতে না দেখতে চট্টগ্রামের স্থানীয় উৎসবে রূপ লাভ করে এবং ১৯৮৬ সালের জুলুছটি ছিল লক্ষ লক্ষ মানুষের উপচেপড়া জোয়ারে ভাসা এক মহানন্দের বন্যা সদৃশ। ‘জশনে জুলুছ’ ‘বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে এনেছিল এক বৈচিত্র্য এবং মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে এনে দিল নতুন প্রাণ ও গ্রহণযোগ্যতা। বর্তমানে এটি পৃথিবীর বৃহত্তম জশনে জুলুছে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হিসেবে পরিচিত।

সাচ্চা আশেকে রাসুল (দঃ):

তিনি ছিলেন একজন সাচ্চা আশেকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম। নবীপ্রেমে তিনি ছিলেন বিভোর ও আত্মহারা। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র শান মর্যাদার কথা বর্ণনাকালে তাঁর দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তো অশ্রুধারা। ভক্ত মুরিদদেরকে ইশক্বে রাসুলে সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র চেতনায় উজ্জীবিত হবার তাগিদ দিতেন তিনি। তিনি প্রায় সময় দেয়া সারগর্ভ বক্তব্যে খাঁটি আশেক্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম, দার্শনিক ও কবি ড. আল্লামা ইকবালের এই লাইনটি উদ্ধৃত করতেন – ‘কি মুহাম্মদ ছে ওয়াফা তো-নে তো-হাম তেরে হ্যায়, ইয়ে জাহাঁ চিজ হে কিয়া, লাওহ কলম তেরে হেঁ।’ অর্থাৎ তুমি যদি হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাদারি ও আনুগত্য কর, তবে আমি (আল্লাহ) তোমার হয়ে যাব। শুধু এই পৃথিবী নয়, লওহ কলম (ঊর্ধ্বজগৎ) সবই তোমার হয়ে যাবে।

পরিবার ও খেলাফত প্রদান:

তিনি দ্বীনি কাজে ব্যস্ত থাকলেও কখনো সংসার বিমুখ ছিলেন না। তিনি ছিলেন দুই পুত্র ও এক কন্যার আর্দশ পিতা। নিজ পরিবারের প্রতি ছিলেন যত্নশীল। এত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি নিজ সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি করে গড়ে তোলেন। ফলে তাঁরাও আধ্যাত্মিকতায় চরম উৎর্কষতা সাধনে সক্ষম হন।

হাফেজ সৈয়দ তৈয়ব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর জীবদ্দশায় সিলসিলার মাশায়েখে কেরামের ইশারায় ১৯৭৬ সনে নিজ সাহেবজাদাদ্বয় যথাক্রমে রাহনুমায়ে শরিয়ত ও তরিকত আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ মুদ্দাজিল্লুহুল আলি ও মুজাহেদে দ্বীন ও মিল্লাত আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ সাবের শাহ মুদ্দাজিল্লুহুল আলীকে সিরিকোট দরবার শরিফে খেলাফত প্রদান করেন। বুজুর্গ পিতা কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে যাচ্ছেন তাঁরা দুজনই। বিশেষত হুজুর কেবলা মুরশিদে বরহক আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ মুদ্দাজিল্লুহুল আলি সিলসিলায়ে কাদেরিয়া আলিয়ার প্রচার-প্রসারে এবং তরিকতের খেদমত ও পীর সাবির শাহ মুদ্দাজিল্লুহুল আলি সাংগঠনিকভাবে বুজুর্গ পিতার আরাধ্য পথে নিজেদের কে নিবেদিত রেখেছেন।

দীদারে ইলাহী:

এই মহান সাধক আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রায় ৭৭ বছর বয়সে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ই জুন, ১৪১৩ হিজরির ১৫ যিলহজ্জ সোমবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে তাসবীহ পাঠ কালে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় দীদারে ইলাহীতে মিলিত হন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।

টীকা-
১|উইকিপিডিয়া
২|আল্লামা তৈয়ব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি স্মারকগ্রন্থ।
৩|মুরশিদে বরহক আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ (রহ.)- কৃত মুফতি মুহাম্মদ অছিয়র রহমান।
৪|সিরিকোট থেকে রেঙ্গুন কৃত মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার।

লেখক:

ছাত্র: জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া ও ইসলামিক স্টাডিজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।