প্রবন্ধ

ইবাদতের ভরা বসন্ত মাহে রমজান (শেষ কিস্তি)

এম সাইফুল ইসলাম নেজামী

পূর্বে প্রকাশের পর

প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ইসলামী জিন্দেগী পূর্ণ অনুধাবনের মাস মাহে রমজান। প্রকৃতপক্ষে ইলাহ, আবদ ও ইবাদত এ তিন শব্দের পূর্ণ সমন্বয় ঘটে মাহে রমজানে। রোজদাররা এ মাসে রোজামুখে, ভক্তির সাথে, সব ইবাদত পালনে যত্নশীল হন। মসজিদে ভরা মুসল্লি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাতে জুমার পরিবেশ! জুমার দিন ছাড়া মসজিদে যাওয়ার অবসর হয়ে ওঠে না অনেকের। কিন্তু রমজানের প্রতি ওয়াক্ত যেন জুমার মতন উপস্থিতি। অবশ্য জামাতে নামাজ আদায়ের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে নির্দেশ রয়েছে।

 

সুরা বাকারার ৪৩ নং আয়াতে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, “তোমরা রুকুকারীদের সঙ্গে রুকু করো।” অর্থাৎ জামাতে নামাজ আদায়কারীদের সঙ্গে নামাজ আদায় করো।

 

প্রিয় নবীজি (দ.) সারা জীবন জামাতে নামাজ আদায় করে বুঝিয়েছেন, জামাতে নামাজ আদায় করার আবশ্যকতা। বুখারী শরিফে বর্ণিত আছে, মদিনার মুনিব (দ.) সারা জীবন জামাতেই নামাজ আদায় করেছেন। এমনকি ইন্তেকালের আগে অসুস্থতার সময়ও জামাত ছাড়েননি। প্রিয় রাসুলে পাকের সাহাবায়ে কেরামের পুরো জীবনও মসজিদে অতিবাহিত হয়েছে।

 

মুসলিম শরীফের রেওয়াত; রাসুলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করেন, “জামাতে নামাজের ফজিলত একাকী নামাজের চেয়ে সাতাশ গুণ বেশি।” অর্থাৎ জামাতে নামাজ আদায় করলে এক রাকাতে ২৭ রাকাতের সাওয়াব পাওয়া যায়। আলহামদুলিল্লাহ। স্বাভাবিক সময়ে জামাতে নামাজে সাতাশ গুণ সাওয়াব বেশি হলে মাহে রমজানে কতশত গুন বেশি সাওয়াব লাভ হবে সেটা সাওয়াবদাতা মহান আল্লাহই উত্তম জানেন।

 

জামাতে নামাজ আদায়কারী সৌভাগ্যবান ব্যক্তির প্রতি কদমে সাওয়াব হাসিল ও পাপমোচনের সাথে সাথে মর্যাদা বৃদ্ধির সুসংবাদ দিয়েছেন নিখিলের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক প্রিয় নবী (দ.)। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, নবীজি (দ.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি উত্তমরূপে পবিত্রতা লাভ করে মসজিদে এসে নামাজ আদায় করে তার প্রতি কদমে একটি নেকি দেওয়া হয়। একটি করে গোনাহ মাফ করা হয়। একটি করে মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়।” সুবহানাল্লাহ।

 

মসজিদ ও মসজিদে জামাতের গুরুত্ব এবং পুণ্যাত্মা নামাজিদের মর্যাদা বুঝতে জ্ঞানীদের জন্য জাতীয় কবি কাজী নজরুলের কাব্যিক আকুতিই যথেষ্ট। তিনি বলেছেন- মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই। আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে, পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে। গোর আজাব থেকে এ গুনেহগার পাইবে রেহাই। কাজীদার এ ক’লাইন কবিতায় স্পষ্ট হয়ে যায় সবকিছু। অন্য সময় জামাত ছুটে গেলেও দ্বীন অনুশীলনের মাস মাহে রমজানে ব্যতিক্রম ঘটে না। মাহে রমজানের আকর্ষণ মুমিনকে মসজিদ প্রেমিক বানিয়ে দেয়। মাহে রমজান শুধু রোজার সাওয়াব পেতে সহযোগিতা করে না বরং ইবাদতের পূর্ণ স্বাদ পাওয়া যায় অবারিত রহমতের মাস মাহে রমজানে। কেননা মাহে রমজানে মুমিনের ধ্যান-জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। সিয়াম সাধনা বান্দাকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে দূরে রেখে নিরেট মুত্তাকী হওয়ার সুযোগ এনে দেয়।

 

মাহে রমজানের রহমত ও মাগফিরাত শেষে যখন নাজাত উপস্থিত হন তখন এক বিশেষ ইবাদাত মুমিন আত্মাকে প্রভুভক্তিতে পরিপূর্ণ করে। আর তা হলো পূণ্যময় ইতিকাফ। মাহে রমজানের শেষ দশকে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের পরীক্ষিত আমল হলো ‘ইতিকাফ’। রমজানের শেষ দশ দিন মহল্লাবাসী থেকে যে কোন একজন মুসল্লী ইবাদতের নিয়তে শবে ক্বদর তালাশের লক্ষ্যে রমজানের রোজাসহ মসজিদে অবস্থান করা সুন্নাতের মুয়াক্কাদাহ্ আলাল কেফায়া। রমনীদের জন্যও রমজানের শেষ দশদিন নিজ ঘরে ইতিকাফ পালন করা সুন্নাত। রাসূলে খোদা (দ.) এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি মাহে রমজানের দশদিন ইতিকাফ করবে সে দু’টি হজ্জ ও দু’টি ওমরাহ পালনকারীর সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে।” সুবহানাল্লাহ। মাত্র দশদিন মসজিদবাসে এতো বিশাল পূণ্যের পাহাড়। আসলে নির্জনে খোদাপ্রেমের সুধাপান ইতিকাফ। ইবাদতের ভরা বসন্তে মাহে রমজানের অংশ ইতিকাফ।

 

ইবাদতের ভরা বসন্ত রমজান আমাদের দু’হাত পুণ্যে ভরিয়ে দেয়। মাহে রমজানে রয়েছে লাইলাতুল কদর নামক মহিমান্বিত একটি রজনী। লাইলাতুল কদরের অন্য নাম শবে কদর। রমজানের সাথে শবে কদরের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ইংগিতে জাতীয় কবি বলেন- মাহে রমজান এসেছে যখন, আসিবে শবে কদর, নামিবে রহমত এই ধূলির ধরার পর। কদরের রাতে অজস্র ধারায় আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। কুরআনুল কারীমে এরশাদ হয়েছে, “আমি একে নাযিল করেছি শবে কদরে। শবে কদর সম্পর্কে আপনি কি জানেন? শবে কদর হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।” বুখারী শরীফের হাদিস: একদা হজরত উবায়দা (রা.) নবী করীম (দ.)-কে লাইলাতুল কদরের রাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তখন নবীজী সেই সাহাবিকে বললেন রমজানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে তালাশ করো। লাইলাতুল কদরের ফজিলত অপরিসীম। তাই সারা রাত জেগে সঠিকভাবে ইবাদত-বন্দেগীতে মনোনিবেশ করা আমাদের কর্তব্য। মাহবুব নবী শবে কদরে দোয়া পাঠের উপরও গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, যে লোক শবে কদর থেকে বঞ্চিত হয় সে যেন সমগ্র কল্যাণ থেকে পরিপূর্ণ বঞ্চিত হল। এক রাতের ইবাদতে মুক্তির গ্যারান্টি। উম্মতে মুহাম্মদির শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম প্রধান প্রমাণ শবে কদর। রোজামুখে ফরজ, সুন্নাত, নফল আদায়, আল্লাহর জিকির, দরুদ-সালাম, মিলাদ-কিয়াম, দান-খয়রাত, উত্তম আচরণের মাধ্যমে রোজাদারের দিন কাটে। এটাও রমজানের বিশেষত্ব। অন্য মাসে এমন সুন্দর দিন কাটাতে চাইলেও সম্ভব হয় না।

 

নিজের অঢেল সম্পদকে পবিত্র করণের মাসও রমজান। বিত্তশালীদের সম্পদ বৃদ্ধি করার উপযুক্ত সময় রমজান। না মওজুদদারী কিংবা কালোবাজারি করে নয়; বরং সম্পদের যাকাত প্রদানের মাধ্যমে। বিত্তশালীদের সম্পদে আল্লাহ গরিব-দুঃখির বৈধ অধিকার রেখেছেন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ যত জায়গায় নামাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, তত জায়গায় যাকাত আদায়ের তাগিদ দিয়েছেন। মনে রাখবেন, যাকাত গরিবের প্রতি সহানুভূতি নয়। বরং যাকাত গরিবের হক। নিজের ও পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বছরান্তে শরীয়ত নির্ধারিত সম্পদ অবশিষ্ট থাকলে তার আড়াই ভাগ যাকাত দেওয়া ফরজে আইন। যাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। অন্যদিকে এ মাসে রোজার ত্রুটিবিচ্যুতি পূরণার্থে ফিতরাহ দেওয়া আবশ্যক। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, হযরত মহানবী (দ.) ঈদের সালাত আদায়ের আগে ফিতরাহ আদায় করার আদেশ দিয়েছেন। যাকাত ও ফিতরাহ শরীয়ত নির্ধারিত পন্থায় আদায় করাও জরুরি। মাহে রমজান আমাদের আপাদমস্তক সাওয়াবে ভরিয়ে দেয়। উদয়াস্ত ইবাদত আর ইবাদত। রাতেও ইবাদতে ভরা। এটাই রমজান।

 

আস্তে আস্তে সূর্যটাও ফিরে যায় আপনালে। ক্রমেই বাড়তে থাকে আনন্দের মাত্রা। চলে মহাপুণ্যের ইফতার আয়োজন। নবীপ্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম সুন্দর বলেছেন- এই উপবাসী আত্মা, এই যে উপবাসী জনগণ, চিরকাল রোযা রাখিবে না, আসে শুভ এফতার ক্ষণ। ঘরে ঘরে খুশির জোয়ার। রোজা ছাড়াও আমরা সন্ধ্যাকালীন নাস্তা করি। কিন্তু তাতে এতো আনন্দ থাকে না। হয় না ইবাদতের খাতায় গণ্য। ইফতারের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে বুখারী ও মুসলিম শরীফের রেওয়াত: স্বয়ং রাসুল (দ) বলেছেন, “রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দের সময় রয়েছে : ১. ইফতারের সময় ২. মহান আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।” ইসলামী পরিভাষায় সূর্যাস্তের পর খেজুর, পানি বা কোনো খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণের মাধ্যমে রোজা ছেড়ে দেয়াকে ইফতার বলে। অদৃশ্য শক্তির আদেশ পালনার্থে ভীষণ ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকা সত্ত্বেও বনি আদম প্রহর গুনতে থাকে সূর্যাস্তের। এ সময় মহান আল্লাহ মানব জাতির ওপর সন্তুষ্ট হয়ে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন। রাসূল (দ.) বলেছেন, “ইফতার করার সময় রোজাদারের দোয়া কবুল হয়ে থাকে।” ইফতার করানোও মহাপুণ্যের কাজ। মাহে রমজান ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহানুভূতির শিক্ষার এক অন্যন্য পাঠশালা। এ মাসের কারণে মানুষ ক্ষুধা ও তৃষ্ণার জ্বালা বুঝতে পারে। এ জন্য এক মুমিনের হৃদয় ধাবিত হয় অন্য মুমিনের সুখ-দুঃখের খবর সন্ধানে। যার বাস্তব রূপ প্রকাশ পায় ইফতারের মাধ্যমে। প্রিয় নবী ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে পরিতৃপ্তি সহকারে খাওয়াবে আল্লাহ তাকে আমার ‘হাউজে কাওছার’ থেকে এমন ভাবে পানি পান করাবেন যার ফলে, সে জান্নাতে না পৌঁছানো পর্যন্ত আর তৃষ্ণার্ত হবে না। সুবহানাল্লাহ। উল্লেখিত ইবাদতমালা ছাড়াও একজন পরহেজগার আল্লাহর প্রিয় বান্দা সালাতুত তাসবিহ, সালাতুল ইশারাক, সালাতুল আওয়াবিল, সালাতুল হাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে দয়া ভিক্ষা চায়। এ মাসে আত্মীয় স্বজনের খবরা-খবর নেওয়াও ইবাদত। একে অন্যের সাথে ইফতার শেয়ার করা সম্পর্কে আনে দৃঢ়তা। সামর্থ্যবানরা সহমর্মিতায় অসহায়ের পাশে দাঁড়ায়। কেউ কেউ লাইব্বাঈক আল্লাহুমা লাব্বাঈক সুর তোলে পাড়ি জমায় আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ শরীফে; ওমরাহ ও ইতেকাফের নিয়তে। এ মাসে ওমরাহ পালনে রয়েছে বিশেষ ফজিলত। নবীপ্রেমেসিক্ত হৃদয় ছুটে যায় ঈমানের বাড়ি সোনার মদিনায়। মহান আল্লাহর ঘোষণা: “আমি জিন ও মানবজাতিকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি।” মহান আল্লাহর এ বাণীর পূর্ণ প্রতিচ্ছবি মাহে রমজান। পবিত্র রমজান মাস বান্দাকে পাপরাশি থেকে মুক্ত করে প্রভুধ্যানে মগ্ন করে দেন। মুক্তির গ্যারান্টি মাহে রমজান। রোজাদারের নিষ্পাপ আত্মা আল্লাহর কাছে যা-ই চাই আল্লাহ তা পূরণ করেন। এ মাসের মতো ইবাদতের সুযোগ অন্য আর কোন মাসে থাকে না। এ মাস যেমন শ্রেষ্ঠ, এ মাসে যারা ইবাদত করে তাঁরাও শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন হন। পরম ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মহা ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ঈমানদাররা। আত্মশুদ্ধি আর আত্মসংযমের রমজানকে বিদায় জানানোর সময় এসে যায়। হারানোর বেদনায় অশ্রুসিক্ত মুমিন আত্মা। উঠে শাওয়ালের চাঁদ। মুমিন প্রাণে বেজে উঠে কাজীদার সেই প্রেমের সুর- “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ”। এসে যায় মহা খুশির ঈদ। আর এটাই মালিক কর্তৃক রোজাদারদের জন্য দুনিয়ায় শ্রেষ্ঠ প্রতিদান। অবশ্য আখেরাতে এর চেয়ে অধিক থেকে অধিকতর পুরস্কার জমা আছে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে মাহে রমজান ইবাদতে কাটানোর তৌফিক দান করুন। আমিন।