প্রবন্ধ

যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তাবলী

সেনানী ডেস্ক

নিত্যপ্রয়োজনীয় মৌলিকচাহিদা মেটানোর পর এক চন্দ্র বছরের জন্য কমপক্ষে ৮৫ গ্রাম সোনা বা ৫৯৫ গ্রাম রূপা অথবা এর কোনো একটির সমমূল্যের নগদ অর্থ কিংবা অন্যান্য সম্পদ কোনো ব্যক্তির মালিকানায় থাকলে প্রতি যাকাত অর্থবছরে সংশ্লিষ্ট সম্পদ থেকে ২.৫% হারে যাকাত আদায় করা তাঁর উপর ফরজ।

যাকাত প্রযোজ্য হয় এমন সম্পদ সমূহ হলোঃ নগদ টাকা, সোনা, রূপা, সব ধরনের বাণিজ্যিক পণ্য, গবাদি পশু ও নির্দিষ্ট কৃষিপণ্য।

 

কোনো ব্যক্তির ওপর ইবাদাত ফরয হওয়ার জন্য কিছু শর্ত থাকে। যাকাত ফরয হওয়ার জন্যও কিছু শর্ত আছে। এগুলোর মধ্যে কিছু শর্ত ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত; আবার যাকাত আর্থিক ইবাদাত হওয়ায় সম্পদের সাথে সম্পর্কিত কিছু শর্তও আছে। নিন্মে উভয় প্রকারের শর্তগুলো উল্লেখ করা হলো।

 

(ক) ব্যক্তির ক্ষেত্রে শর্তঃ

 

(১) মুসলিম হওয়া

যাকাত ফরয হওয়ার জন্য প্রথম শর্ত হলো মুসলিম হওয়া।

(২) বালিগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া

শাফি‘ঈ, মালিকী ও হাম্বলী মাযহাব মতে, সম্পদশালী শিশুর ওপর যাকাত ফরয হবে। তার সম্পদ হতে তার ওয়ালী বা দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিভাবক যাকাত আদায় করবেন। হানাফী মাযহাব মতে, যাকাত ফরয হওয়ার জন্য বালিগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া শর্ত। অতএব, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্বে শিশুর সম্পদে যাকাত নেই। তবে শিশুর মালিকানাধীন জমিতে উৎপন্ন ফসলে উশর ফরয হবে (ইসলামী ফিকহ বিশ্বকোষ: মাওসূ‘আতুল ফিক্ইয়াহ ২৩:২৩২)

(৩) বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া

হানাফী মাযহাব মতে, যাকাত ফরয হওয়ার জন্য বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়ার শর্ত রয়েছে। তাই পাগলের ওপর যাকাত ফরয নয়। যুক্তি হিসেবে তাঁরা তিন প্রকারের ব্যক্তির ওপর হতে তাখলীফের কলম তুলে নেয়ার হাদীসটি উল্লেখ করেন। অন্যান্য মাযহাব মতে, পাগলের ওপর যাকাত ফরয হবে, তার পক্ষ হতে দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিভাবক যাকাত আদায় করবেন।

(৪) স্বাধীন ব্যক্তি হওয়া

যাকাত ফরয হওয়ার জন্য সম্পদের মালিকের স্বাধীন হওয়া অন্যতম শর্ত।

(৫) নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা

যাকাত ফরয হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা। শরী‘আহ কর্তৃক নির্ধারিত একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদকে নিসাব বলে, যে পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত ফরয হয়।

(৬) সম্পদের ওপর পূর্ণ মালিকানা

যাকাত ফরয হওয়ার জন্য সম্পদের ওপর মালিকানা ও পূর্ণাঙ্গ দখল থাকতে হবে এবং সম্পদ ব্যবহারের ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে, অন্যথায় যাকাত ফরয হবে না।

(৭)যৌথ মালিকানাভুক্ত সম্পত্তির যাকাত

কোনো সম্পদের দুই বা ততোধিক মালিক থাকলে প্রত্যেকে নিজ নিজ অংশের যাকাত দেবেন।

(৮) হারাম সম্পদের যাকাত

হারাম সম্পদ বলতে বুঝায় অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ। চুরি, ডাকাতি, সুদ, ঘুষ, ছিনতাই, রাহাজানি, অবৈধ ব্যবসা ইত্যাদি নানাবিধ অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ হারাম সম্পদ বা অবৈধ সম্পদ বলে গণ্য। হারাম পন্থায় উপার্জনকারী ব্যক্তি ঐ সম্পদের মালিক নয়।

অতএব, তা খরচের অধিকারও তার নেই। যাকাত প্রদানও এক ধরনের খরচ। তাই ফকীহগণ বলেন, হারাম সম্পদ হতে যাকাত দেয়া যাবে না। অবৈধ পন্থায় উপার্জিত সমুদয় সম্পদ প্রকৃত মালিককে ফেরত দিতে হবে। যদি প্রকৃত মালিক চিহ্নিত করা সম্ভব না হয় তাহলে সাওয়াবের নিয়াত ব্যতিরেকে পুরো সম্পদ গরিবমিসকীনকে দিয়ে দিতে হবে।

(খ) ধন-সম্পদের ক্ষেত্রে শর্তঃ

 

(১) সম্পদ বর্ধনযোগ্য হওয়া

যাকাত ফরয হওয়ার জন্য সম্পদ বর্ধনযোগ্য হওয়া বা বর্ধনক্ষম হওয়া শর্ত। এটি বাস্তবেও হতে পারে, আবার ধারণাগতভাবেও হতে পারে। কিছু সম্পদে বর্ধনশীলতার বিষয়টি দৃশ্যমান; যেমন, প্রজননের মাধ্যমে চতুষ্পদ জন্তু বৃদ্ধি পায়। উৎপাদিত ফসল তো বর্ধন ছাড়া আর কিছুই নয়। ব্যবসা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে নগদ অর্থ বেড়ে যায়। স্বর্ণ-রৌপ্য বাহ্যিকভাবে না বাড়লেও মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে এগুলো বর্ধনশীলতা প্রকাশ পায় (মাওসূ‘আ, ২৩: ২৪১; কারযাভী)

(২) সম্পদ এক বছর অধিকারে থাকা

যাকাত ফরয হওয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো, মালিকের অধিকারে সম্পদ এক চান্দ্রবছর থাকা।

(৩)সম্পদ মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া

হানাফী মাযহাবের আলিমগণ যাকাত ফরয হওয়ার জন্য অতিরিক্ত একটি শর্তারোপ করেন, সেটি হলো যাকাতযোগ্য সম্পদ মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় সম্পদের ওপর যাকাত ফরয হয় না।

(৪) ঋণমুক্ত হওয়া

যাকাত ফরয হওয়ার জন্য সম্পদ ঋণমুক্ত হওয়া শর্ত। ঋণের পরিমাণ বাদ দিয়ে কারো যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ না থাকে তাহলে তার ওপর যাকাত ফরয হবে না।

 

(গ) যাকাত ফরয হওয়ার শর্তের সাথে সম্পর্কিত আরো কিছু বিষয়ঃ

 

(১) মৃত ব্যক্তির যাকাত

বিষয়টি মালিকানার শর্তের সাথে সম্পর্কিত। কোনো ব্যক্তির ওপর যাকাত ফরয হয়েছে, কিন্তু তিনি তা আদায় না করে মৃত্যুবরণ করেছেন; তাহলে তার রেখে যাওয়া সম্পদ হতে ওয়ারিশগণ বা সম্পদের তত্বাবধায়ক যাকাত আদায় করবে।

(২) বিদেশে রক্ষিত সম্পদের যাকাত

কারো সম্পদ যদি বিদেশের ব্যাংকে থাকে কিংবা কেউ যদি বিদেশে ব্যবসা করেন এবং ঐ সম্পদের ওপর যাকাত ফরয হয়, তাহলে তাকে যাকাত আদায় করতে হবে।

(৩) কয়েদি বা সাজাপ্রাপ্ত আসামীর যাকাত

কারাদন্ড বা বন্দিদশা যাকাত রহিত করে না। কারাবন্দী সে হাজতি হোক বা সাজাপ্রাপ্ত হোক নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তাকে যাকাত দিতে হবে।

(৪) মুসাফিরের যাকাত

সফরের কারণেও যাকাতের বিধান রহিত হয় না। মুসাফির ব্যক্তি যদি নিজ দেশে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন তাহলে ঐ সম্পদের যাকাত দিতে হবে। ঐ ব্যক্তির দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা না করে তার পক্ষ থেকে তার আত্মীয় স্বজন বা সম্পদ -তত্ত্বাবধায়ক যাকাত আদায় করবেন।