জীবনী

রহস্যে আবৃত এক সুফি মনসুর হাল্লাজ (রঃ)

সেনানী ডেস্ক

জন্ম  পরিচয়ঃ

মনসুর আল-হাল্লাজের পুরো নাম আবু আব্দুল্লাহ হুসাইন ইবনে মনসুর আল-হাল্লাজ। তবে আনাল হাক নামেই তিনি বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে (হিজরি ২৪৪) তিনি ইরানের পারস্য প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন সুতা-প্রস্তুতকারক। আরবিতে হাল্লাজ শব্দের অর্থ হলো সুতা-প্রস্তুতকারক, সেই সূত্রে এঁদের বংশধরেরা পেশাধারী পদবী হাল্লাজ ব্যবহার করতেন।

মনসুর আল-হাল্লাজের পিতামহের নাম মাহমি। তিনি ছিলেন পারস্যের অগ্নি-উপাসকদের একজন। পরে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন।

বাল্যকালঃ

সেই সময়ে পারস্যে মুসলমানদের অনেকেই ধর্মাচরণের জন্য সুফি-সাধনার পথ বেছে নিতেন। এই সূত্রে মনসুর হাল্লাজ শৈশব থেকেই সুফিদের মজলিশে মনসুর হাল্লাজ আসা-যাওয়া করতেন। ক্রমে ক্রমে তাঁর ভেতরে আল্লাহর সাথে নৈকট্য লাভের আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়ে উঠতে থাকে। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি কুরআনের হাফেজ হন।

১৮ বছর বয়সে তিনি তুস্তারে যান এবং সেখানকার সুফি সাহল আল-তুস্তারির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দুই বছর এই গুরুর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করার পর তিনি বাগদাদ হয়ে বসরায় যান। বসরাতে তিনি আমর ইবনে ওসমান আল-মক্কির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এখানেও তিনি গুরু আমরের সাহচর্যে প্রায় দুই বছর অতিবাহিত করেন। ঐ সময় তিনি বিয়ে করেন সুফি ইয়াকুব আল-আকতা কার্নাবাইয়ের কন্যা উম্মুল হুসনাইনকে। এই সংসারে তাঁর একমাত্র পুত্রের নাম ছিল আহম্মদ ইবনে হুসাইন ইবনে মানসুর।

শিষ্যত্ব গ্রহণঃ

মনসুর হাল্লাজ তাঁর জীবনে যেসব গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে শুরুর দিকে আমর ছিলেন অন্যতম৷ মনসুর একদিন তাঁর দরবারে বসে ছিলেন৷ গুরু আমর কুরআন তেলাওয়াত করতে শুরু করলে মনসুর বলেন, ওইরকম আমিও লিখতে পারি। এই কথায় আমরের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়৷ মনসুর আমরের দরবার ত্যাগ করে বাগদাদ চলে যান।

অনেকেই মনে করেন, মনসুর এই কথা বলে বুঝাতে চেয়েছিলেন, আমরের চেয়ে তিনি ভাল কুরআন পাঠ করতে পারেন৷ কেউ কেউ এমনও বলেছেন, আমরের দরবারে থাকাকালীনই মনসুর জ্ঞান-বিদ্যা ও সুফি তত্ত্বে আমরকে অতিক্রম করে ফেলেছিলেন। মূলত এ কারণেই আমরের সঙ্গে তাঁর দূরত্বের পথ প্রবলম্বিত হয়েছিল।

বাগদাদে গিয়ে মনসুর হাল্লাজ বিখ্যাত ওলি হজরত জুনায়েদ বাগদাদির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন৷ এবং হিজরি তৃতীয় শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষের দিকে হেজাজে চলে যান।

মক্কায় অবস্থানঃ

২৭০ হিজরিতে তিনি হজ করার জন্য মক্কায় যান। সেখানে কাবার দিকে মুখ করে এক বছর রোজা রেখে নিঃশব্দে ধ্যান করেন। এ সময় প্রতিদিন এক ব্যক্তি কয়েকটি রুটি ও এক পাত্র পানি তাঁর সামনে রেখে যেতেন। হাল্লাজ কদাচিৎ রুটির কিছু অংশ খেতেন বা সামান্য পানি পান করতেন। ফলে তাঁর শরীর শুকিয়ে হাড্ডি সর্বস্ব হয়ে যায়।

মক্কা থেকে বাগদাদঃ

মনসুর হাল্লাজ মক্কা ত্যাগ করে বাগদাদে ফিরে আসেন। এখানে প্রায় এক যুগ অতিবাহিত করে ২৮৪ হিজরিতে দেশ ভ্রমণে বের হন। তিনি মধ্য এশিয়ার বহু এলাকা, চীন এবং ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেন। এরই মধ্যে তাঁর বহু শিষ্য তৈরি হয়েছিল। এঁদের নিয়ে তিনি তিনবার হজ করেন। তৃতীয় বারের হজের পর তিনি বাগদাদের প্রাণকেন্দ্র আব্বাসিদ এলাকায় বাস করতে থাকেন।

রচনাবলীঃ
তাঁর প্রসিদ্ধ বইগুলো হলো-

১| আল-তাওয়াসিন (كتاب الطواسين)
২| দিওয়ানে -মনসুর হাল্লাজ

আনাল হক  তাঁর বিতর্কিত আকীদাঃ

মনসুর হাল্লাজের সমগ্র জীবন ছিল বিতর্কে মোড়ানো। কথিত আছে একদিন ধ্যানরত অবস্থায় তিনি এক জ্যোতির্ময় পুরুষকে দেখতে পান। মনসুর তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কে। ওই পুরুষ তাঁকে বলেন ‘আনাল হক’ অর্থাৎ ‘আমিই পরম সত্য’। উল্লেখ্য ’আল-হক’ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার ৯৯টি নামের একটি। আল্লার এই রূপ এবং বাণী দ্বারা তিনি এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েন যে, তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো উচ্চারণ করতে থাকেন ‘আনাল হক’। এই থেকে তিনি ‘আনাল হক’ নামে পরিচিতি লাভ করেন

‘আমিই পরম সত্য’ এই অর্থে আল্লাহ বিবেচনা করে, নিজেকে আনাল হক বলাকে অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছিলেন সেকালের বেশিরভাগ ওলামায়ে কেরাম। কেউ কেউ তাঁকে ফেরাউনের সাথে তুলনা করেছিলেন। আনাল হকের সমর্থকরা এর প্রতিবাদ করে বলে থাকেন ফেরাউন আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করে, নিজেকে আল্লাহ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু আনাল হক নিজেকে আল্লাহর অংশ হিসেবে নিজেকে ‘আমিই পরমসত্য’ ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর এরূপ প্রতিটি বাণী ছিল আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করেই। সুফিরা জানতেন, মনসুর কোন অর্থে নিজেকে আনাল হক বলছেন। আল্লাহর সাথে তাঁর নৈকট্য এতটাই গভীর হয়ে উঠেছিল যে, তিনি নিজেকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেন না। তাই তিনি নিজের নাম পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলেন। তার পরিবর্তে নিজেকে ‘আনাল হক’ বলে পরিচয় দিতেন।

তাঁর আরও একটি বহুল বিতর্কিত আকিদা হলো হুলুল ও ইত্তেহাদ। অর্থাৎ তিনি বলতেন আল্লাহ তাঁর মধ্যে প্রবেশ করেছেন; ফলে আল্লাহ্ ও তিনি একই সত্ত্বা হয়ে গেছেন।

সাধারণত সুফিমতাদর্শীদের গুপ্ত জ্ঞান অন্যের কাছে প্রকাশ করাটা অমার্জনীয় কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু মনসুর এসকল বিষয় অগ্রাহ্য করে, সর্বসাধারণের কাছে সকল গুপ্ত বিষয় প্রকাশ করতেন লিখে এবং মৌখিক অভিভাষণে। এই কারণে অন্যান্য সাধকরা তাঁর শত্রু হয়ে উঠেছিলেন। মানসুর হাল্লাজ গদ্য এবং পদ্যে প্রচুর লেখালেখি সুফিবাদের গুপ্ত কথা ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ হলো কিতাব আল-তাওয়াসিন (كتاب الطواسين), যেখানে দুটি সংক্ষিপ্ত অধ্যায় আল্লাহ-তাআলা এবং ইবলিশ-শয়তানের কথোপকথনের বর্ণনা আছে। আল্লার নির্দেশে ইবলিশ হযরত আদম (আ:) কে সেজদা করতে অস্বীকার করেছিল।এই ব্যপারে মানসুর হাল্লাজ তার বইয়ে বলেন-

If you do not recognize God, at least recognise His sign, I am the creative truth —Ana al-Haqq—,
because through the truth, I am eternal truth.

অর্থাৎ, “যদি আল্লাহকে নাই চিনতে পারো, তাহলে কমপক্ষে তার নিদর্শনকে তো চেনো। আমিই সৃজনশীল সত্য- আনাল হাক্ক, কারণ সত্যের ভিতর দিয়ে আমিই পরম সত্য।

তার মতবাদের সারমর্ম ছিল “সমগ্র মানবজাতির এক নিগূঢ় অন্তর্দর্শন: তিনি তার স্রষ্টাকে অন্তরের অন্তস্থলে খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন এবং চেয়েছিলেন যাতে করে অন্যরাও তা খুঁজে পায়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ঐশ্বরিক বাস্তবতায় পৌঁছানোর জন্য গতবাঁধা আনুষ্ঠানিক ধর্মকর্মের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। তিনি কোনরকম সংশয় ছাড়াই বিরোধী-মতবাদিদের (ধর্মীয়)পরিভাষা কিন্তু নিজস্ব সঠিক এবং শুদ্ধতার মাপকাঠিতে ব্যবহার করতেন, যাতে করে তার প্রতিপক্ষীয়রা খুব সহজেই (ধরাবাঁধা ধর্মীয়) বাধানিষেধের কাঠগড়ায় আসামি হিসেবে দাঁড় করায়। “(Massignon:. “Perspective Transhistorique,” p।76). এমনকি উনার চিন্তার পরিসর ধরাবাঁধা প্রচলিত মুসলিম বিশ্বাসের বহু ঊর্ধ্বে ছিলো, তিনি ছিলেন পুরো মানবতার জন্য উদ্বিগ্ন। তাই তাদের সাথে সেই আন্তরিক যোগসাধনের জন্য উনার আকুতি “ছিল অদ্ভুত, ধৈর্যশীল এবং লজ্জাষ্কর। (আর তা ছিলো) খোদার জন্য বাসনা। আর তা ছিলো ওনার অন্যতম বৈশিষ্ট”(Massignon, p. 77)। আর এই কারণেই উনি (তৎকালীন) মুসলিম বিশ্ব থেকে বহুদূরে ভারত এবং চীনে সফর করেন।

কারাবাসঃ

এই ধরনের কথা উচ্চারণের কারণে তিনি লম্বা বিচারকার্যের সম্মুখীন হন এবং দীর্ঘ ১১ বছর বাগদাদ নগরে কারাবাস করেন। এরপর ৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে মার্চ জনসমক্ষে তৎকালীন সরকারি বিচারকদের নির্দেশে হত্যা করা হয়।

মৃত্যুঃ

মানসুর বিশ্বাস করতেন যে আল্লাহর সঙ্গে আত্মিক মিলন সম্ভব, আর এটাও বিশ্বাস করতেন যে তিনি নিজে তার সঙ্গে এক হয়ে মিলে গেছেন। উনার মৃত্যুদন্ডের পর উনার শরীরকে টুকরো টুকরো করে কাটা হয়, কারণ উনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় একবার ঘোষণা করেন যে “আনা আবরারুল হাক্ক”(আমি সত্যের আবরার)। উনার মৃত্যুদন্ড হয় বাগদাদে প্রকাস্য দিবালোকে। তারা তাকে হত্যার পরে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে আর তারপর সেই কাটা দেহাবশেষকে পুড়িয়ে ফেলা হয়। যখন উনার হাত, পা, জিহ্বা, আর সবশেষে মাথা কেটে ফেলা হয়, তখনো তিনি উচ্চারণ করতে ছিলেন “আনাল হাক্ক(আমিই পরম সত্য)। “যখন সবশেষে তার মাথা কেটে ফেলা হয়। তিনি খোদার সাথে তার গভীর সম্পর্কের প্রমাণ দিতে চেয়েছিলেন এমনকি তাকে হত্যা করে ফেলতেও বলেছিলেন। (Massignon, পৃ: ৭৯)। এবং নিজের মৃত্যুদন্ডকে স্বেচ্ছায় বরন করেন, এই বলে যে “সেই এক স্বত্তার সাথে মিলনেই প্রকৃত আনন্দ।”

আল্লাহর সাথে তার মিলিত হবার বাসনার কারণে তত্কালীন বহু মুসলিম একেশ্বরবাদী ইসলামিক মতাদর্শকে বিকৃত করার অভিযোগ করে উনাকে “ছদ্ম-খ্রিস্টান” বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। (Mason, পৃ: ২৫)। আরেকজন তত্কালীন বিখ্যাত সূফি আত্তার(রাহ্ঃ) উনার কাজকে বীরত্বপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ উনাকে (হাল্লাজকে) যখন বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়, একজন সূফি উনাকে জিগ্গেস করেন যে, “প্রেম কি?”। তিনি জবাব দেন যে, “তুমি আজ, কাল, আর পরশুদিন তা নিজ চোখেই দেখবে”। সেদিন তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়, তার পরের দিন তার দেহাবশেষ পুরানো হয়, আর তার পরের দিন তার দেহভস্ম বাতাসে মিলিয়ে ফেলা হয়। আত্তার(রাহ্ঃ) বলেন যে, “এটাই প্রেম”। যখন উনার পা কেটে ফেলা হয়, তখন তিনি বলেন যে, “এই পা দিয়ে আমি দুনিয়াতে চলাফেরা করতাম, এখন তো জান্নাত তো মাত্র এক কদম দুরে; পারলে সেই পা কাটো”। আর যখন হাত কেটে ফেলা হয়, তখন তিনি সেই কাঁটা বাহুর রক্ত মুখে মেখে নেন। “কেন এমন করলেন” জিজ্ঞেস করলে উনি জবাব দেন যে, “আমার শরীর থেকে অনেক রক্ত পাত হয়েছে, তাই আমার মুখ হলুদে দেখাচ্ছে, আমি নিজের মুখ ফ্যাকাশে দেখাতে চাই না(যেন মনে হয় যে আমি ভয় পাচ্ছি)”।

তাঁর কিছু কবিতাঃ

দিওয়ানে আল-হাল্লাজ হতে-

১.
ভালোবাসার সমুদ্রে আমি ভাসতে শুরু করি,
একটি উত্তাল তরঙ্গ আমাকে উপরে তোলে, অপরটি নিচে নামিয়ে দেয়;
আর এভাবেই আমি এগিয়ে যাই, এই উঠছি, এই নামছি.
যতক্ষণ পর্যন্ত না দেখতে পাই গভীর সমুদ্রের একেবারে মাঝখানে,
ভালোবাসা আমাকে নিয়ে গেল এমন এক স্থানে যেখানে কোনো বেলাভূমি নাই
ভয় পেয়ে আমি সাহায্যের জন্য ডাকলাম তাকে (পরম) যার নাম আমি খোলাসা
করব না,
এমন একজন যার ভালোবাসার কাছে কখনও মিথ্যা ছিলাম না আমি:
‘প্রকৃতই ন্যায়ানুগ তোমার নিয়ম’ আমি বললাম, ‘আমি আমার এই জীবন দিয়ে
তোমার সুষমাচারের সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত। ’
আমাদের ভেতরের চু্ক্তিনামার কোনো বিষয় এটি নয়।

২.
অনেক বেদনার ব্যাপার যে আমি নিরন্তর ডাকছি তোমাকে,
যেন আমি অনেক দূরে তোমার থেকে কিংবা তুমি অনুপস্থিত আমার কাছে,
আর আমি অবিরাম চেয়ে যাচ্ছি তোমার করুণা, যদিও জানি না কী প্রয়োজন,
কখনওই আগে এমন বাসনাপূর্ণ তপস্বী দেখি নাই আমি।

৩.
আমার হৃদয়ে তোমার স্থান হৃদয়ের পুরোটা জুড়ে,
কেননা আর কেউই নিতে পারে না তোমার স্থান।
আমার আত্মা তোমাকে স্থাপন করেছে আমার ত্বক আর হাড়ের মাঝখানে,
সুতরাং কী করব আমি কখনও যদি হারাতে হয় তোমাকে?

সংগ্রহেঃ আহমদ শাহ আদীল