জীবনী

ড. আল্লামা ইকবাল (রহ.)

তাহের হোসাইন

জন্মঃ ৯ নভেম্বর ১৮৭৭ শিয়ালকোট, পাঞ্জাব, ব্রিটিশ ভারত।

ড. আল্লামা ইকবাল (র.) একাধারে আশেকে রাসুলﷺ, মুসলিম দার্শনিক, বিশ্ব বিখ্যাত সাহিত্যিক, আইনজীবী, গবেষক, পাকিস্তানের জাতীয় কবি ও আধ্যাত্মিক জনক, মুসলিম স্বাধীন রাষ্ট্রের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা।

 

তিনি ভারতীয়, পাকিস্তানি, বাংলাদেশী, ইরানিয়ান এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি হিসাবে এবং “আধুনিক সময়ের মুসলিম দার্শনিক চিন্তাবিদ” হিসাবেও অত্যন্ত প্রশংসিত। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ আসরার-ই-খুদী ১৯১৫ সালে পারস্য ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং কবিতার অন্যান্য গ্রন্থগুলিতে রুমুজ-ই-বেখুদী, পয়গাম-ই -মাশরিক এবং জুবুর-ই -আজাম। এর মধ্যে তাঁর বিখ্যাত উর্দু রচনাগুলি হ’ল বাং -ই -দারা, বাল -ই -জিবরাইল এবং আরমাঘান -ই -হিজাজ। ১৯২২ সালের নিউ ইয়ার্স অনার্সে তাকে রাজা পঞ্চম জর্জ তাকে নাইট ব্যাচেলর এ ভূষিত হয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়া ও উর্দু-ভাষী বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলে ইকবালকে শায়র-ই-মাশরিক (প্রাচ্যের কবি) হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তাঁকে মুফাক্কির-ই-পাকিস্তান (পাকিস্তানের চিন্তাবিদ), মুসোয়াওয়ার-ই-পাকিস্তান (পাকিস্তানের শিল্পী”) এবং হাকিম-উল-উম্মাত (উম্মাহর ভরসা) ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। আল্লামা ইকবাল অমর হয়ে আছেন তার কয়েকটি কবিতা ও রচনার জন্য। এরমধ্যে আসরার ই খুদি, শিকওয়া ও জবাবে শিকওয়া, দ্যা রিকনস্ট্রাকশন ওফ রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম, বাআল ই জিবরাইল, জাভেদ নামা, ইত্যাদি অত্যন্ত গভীর দার্শনিক ভাব সমৃদ্ধ রচনা। আল্লামা ইকবালের লেখনিতে যে ইসলামী পুনর্জাগরণের আওয়াজ উঠেছিল তা সমসাময়িক অনেক ব্যক্তি ও আন্দোলনকে সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত করেছে। তাঁর একটি বিখ্যাত চিন্তা দর্শন হচ্ছে ভারতের মুসলমানদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন। এই চিন্তাই বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে।যার ফলপ্রসু আজকের বাংলাদেশ। পাকিস্তানের সৃষ্টি না হলে বাংলাদেশ নামে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের কল্পনাও করা যেতো না, এই দেশ ভারতের অঙ্গরাজ্যই থেকে যেতো।

 

>আশেকে রাসুল ﷺ আল্লামা ইকবালঃ
ড. আল্লামা ইকবাল (র.) ছিলেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতাদর্শী ও সাচ্চা আশেকে রাসুল। তিনি তাঁর সমসাময়িক যুগের বিশ্ববিখ্যাত আরেক আশেকে রাসুলﷺ, মুজাদ্দিদে মিল্লাত আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (র.)’র প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। আলা হযরত সম্পর্কে ড. আল্লামা ইকবাল বলেন, আ’লা হযরতের ফাতাওয়া সমূহ পড়ে আমি এ অভিমত ব্যক্ত করলাম যে,ভারতবর্শে শেষ যুগে আ’লা হযরতের মত বিজ্ঞ ও মেধাসম্পন্ন ফক্বীহ জম্মগ্রহন করেননি।তার প্রতিভা, বুদ্ধিমত্তা,উন্নত স্বভাব, জ্ঞানের গভীরতা,দ্বীনি বিষয়াদিতে  জ্ঞান সমূদ্রের ন্যায় গভীর।আ’লা হযরত একবার যেই মত প্রতিষ্টা করে নেন সেটির উপর তিনি অটল থাকেন।তবে তিনি নিঃসন্দেহে তাঁর মতের বহিঃপ্রকাশ ঘটান অতি গভীর চিন্তা ভাবনা করেই।তার কৃত শরিয়তের কোন ফয়সালা বা তাঁর প্রদত্ত কোন ফাতাওয়া তাঁকে কোনদিন বাতিল বা পরিবর্তন করতে হতো না। জ্ঞানগত দিক দিয়ে আ’লা হযরত হলেন যুগের ইমাম দ্বিতীয় আবু হানিফা।
[মক্বালাতে ইমামে রেজা,৩য় খন্ড, লহোর, এপ্রিল১৯৭১]

 

আল্লামা ইকবাল (র.) তাঁর লেখনি শেয়ারে মুসলমানের অন্তরে আল্লাহ তা’আলাও নবী প্রেম জাগিয়ে তুলেছিলেন, অন্যদিকে জাগ্ররণী শেয়ার ও নেতৃত্ব দিয়ে উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে পুনর্জাগরণ করে তুলেছিলেন।

 

ড. আল্লামা ইকবাল (রহঃ) বলেন,

 

”দর দীলে মুসলিম মকামে মুস্তফাস্ত

 

আবরূয়ে মা যে নামে মুস্তাফাস্ত।”

অর্থাৎ, মুসলমানদের অন্তরে হুজুর ﷺ এর-ই মর্যাদার স্থান রয়েছে, আর আমরা মুসলমান জাতির মান-সম্মান, হুজুরের নামে পাকের বদৌলতে আছে।

 

“জাহা রওযায়ে পাকে খায়রুল ওয়ারা হে, উয়হ জান্নাত নেহী হে,তো পির আওর কিয়া হে?”

 

অর্থাৎ, যেখানে রওজা পাক শ্রেষ্ট মাখলুকে খোদার, যদি না হয় জান্নাত এটি, তাহলে সেটা হবে কি আর?

 

তাঁর একটি নাত গাউসে জমান তৈয়্যব শাহ কেবলা সবসময় পড়তেন,

 

“কী মুহাম্মদ সে ওয়াফা তুনে, তো হাম তেরে হ্যায়, ইয়ে জাহা চিজ হ্যায় কেয়া? লওহ কলম তেরে হ্যায়”।। (‘জওয়াবে শেকওয়া’র শেষ চরণ’)।

 

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যানুবাদ,

 

“আল্লাহ্ কে যে পাইতে চায়,
হযরতকে ভালবেসে, আরশ-কুরসী,লওহ-কলম না চাহিতে পেয়েছে সে।”

“মগজে কুরআ, রুহে ঈমান,জানে দ্বীন, হাসত হুব্বে রাহমাতুল্লিল আলামীন।”

 

অর্থাৎ -“কুরআনের মগজ, ঈমানের আত্মা, ধর্মের প্রাণ শক্তি হলো,

 

সৃষ্টির তরে অপার করুনার(নূর
নবীজী)প্রতি, অকুণ্ঠ ভালবাসা।।”

 

“হাত কার ওয়াল, দীল

 

ইয়ার ওয়াল”

অর্থাৎ – ‘হাত দিয়ে কাজ কর, মন দিয়ে আল্লাহ্ কে স্মরণ কর’।

 

“মিটাদো আপনি হাস্তি কো আগর কুছ মরতবা চাহিয়ে, কে দানা খাকপে মিল কর গুলে গুলজার বনতি হ্যায়”।

 

অর্থ- ‘হও যদি তুমি প্রত্যাশী ভবে মর্যাদার, মিটিয়ে দাও তবে নিজের অস্তিত্বের পাহাড়, বীজের চরম আত্ম বলিদান, গড়ে তোলে সুশোভিত ফুল বাগান’।

 

“জান দি তো উস কিহি থি,

 

পর হক ইয়ে হ্যায় কেহ হক আদা না হুয়ি”।

‘দিয়েছি জীবন, হয়েছে কী তাতে?
তাঁর দেয়া জীবন ফিরিয়েছি তাঁকে,
এতে নাই মোর কৃ্তিত্ব এক রত্তি,
বরং প্রতিষ্ঠিত হলো এক মহা সত্যি,
আদায় হলো না, তাঁর দায়-দেনা,
আসল কথাটা এবার হয়ে গেল জানা।”

 

“তু গঞ্জী আয হার দু আলম মান ফকীর, রোজে মাহশর উযর হায়ে মান পযী গার তুমী বীনী হেসাবাম না গজীর, আয নেগাহে মুস্তাফা পেনহা বগীর”।

 

কাব্যানুবাদ-“হে আল্লাহ্! দোজাহানে কারো মুখাপেক্ষী নও তুমি,
ওগো দয়ালু! উভয় জগতের সবাই তব করুণাকামী, হাশরের দিনে বুঝে নিবে সবে, নিজ নিজ প্রতিদান,
হিসাব আমার নাও যদি প্রভূ
করোনা অপমান।

 

“চীন ও আরব হামারা,হিন্দুসতা হামারা, মুসলিম হ্যায় হাম ওয়াতান হ্যায় সারা জাহা হামারা”

 

ড. আল্লামা ইকবাল (রহঃ) আরো বলেনঃ

 

“ধর্ম শুধু কিতাব সমূহে তালাশ করো না, কিতাব দ্বারা শুধু বিদ্যা ও বিজ্ঞান অর্জিত হয় কিন্তু দ্বীন অর্জিত হয় কামেল ব্যক্তিদের কৃপা দৃষ্টিতে।যদি কোরআনের অনুবাদ পড়ে ধর্ম অর্জিত হতো তাহলে  আবু জাহেল, আবু লাহাব ও ইবলিশরা প্রথম স্তরের ঈমানদার হতো, কারণ তারা অনুবাদ জানত। তারা শুধু নবী করিম ﷺ হতে ফয়েজ হাসিল না করার কারণে ধ্বংস হয়েছে।”

 

“সরকারে দো আলমকা, মিলাদ মানাতে হ্যা” এই বিখ্যাত নাতটিও তাঁর রচনা।

 

এই মহান দার্শনিক ২১ এপ্রিল ১৯৩৮ সাল ৬০ বছর বয়সে লাহোর, পাঞ্জাবে ইন্তেকাল করেন। মহান আল্লাহ যেন আমাদের তাঁর ফয়ুজাত দান করেন এবং তাঁকে উঁচু মক্বাম নসিব করেন।